পাহাড় আর সমুদ্রের এক অদ্ভুত ডাক আছে। বুনো লতার বন পেরিয়ে, কৃষকের সদ্য লাগানো শিমের খেত পেরিয়ে চলার মাঝে হাজার বছরের পরিতৃপ্তি। আকাশের মেঘের ভেলায় ছুটতে ছুটতে সাদা পেজা তুলার দল পাহাড় চুড়ায় বাসা বাঁধে। পাহাড়ে সারা বছরই চোখের অশ্রু পাতানো সৌন্দর্য। ঝিরি পথের একপাশ ধরে ক্রমান্বয়ে ছুটে চলা। বাঁধভাঙ্গা জলের স্রোতের হিমেল ধারা এখানে সৌন্দর্যের খেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সৌন্দর্যরা এখানে পাখা মেলে। প্রাণহীন শ্রাবণ জলের দিনে এখানবসে দিবা কাব্যের মায়ার ছোঁয়া।
আমাদের এবারের রুট ছিলো পাহাড়ি কন্যা নাপিত্তাছড়ায়। আগে থেকে সবাই কে জানানো হলো। কিন্তু শুক্রবার নাকি শনিবার তা নিয়ে খানিকটা বোঝাপড়া হলো। কিন্তু যখন শুক্রবারই সিদ্ধান্ত হলো, মনের আনন্দে ঘুমাতে গেলাম।
সকালে উঠেই দে ছুট নয়াদুয়ারির হাটে। বেলাটা চড়ে এসেছে। সূর্যি মামা খোলস ছেড়ে বেরিয়েছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের বড়ভাইরা এসে হাজির। আর অপেক্ষা নয়। এমনিতেই সকালের স্নিগ্ধ সময়টুকু ছাড়িয়েছে। কলা বন ব্যাগে পুরে হাঁটতে শুরু করলাম। পথের সৌন্দর্য না বললেই নয়। কৃষকের মাঠ পেরিয়ে, সবুজ দিগন্তের ধান খেত পেরিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। পাকা রাস্তা একজায়গায় এসে থামলো। কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। রেল লাইন পেরিয়ে পথের ধার ধরে ক্রমাগত এগিয়ে চলা।
কিছুক্ষণ নাগাদ এসে পৌঁছলাম টিপরা পাড়ায়। গোটা কুড়ির বেশী ত্রিপুরার আবাস এখানে। পাহাড়ি ঝিরি পথ ধরে চলার নিয়ম একটি। স্রোত বরাবর এগিয়ে চলা। যদিও গাইড পাশে ছিলো। পাথুরে পথের বাঁকে কুমে জমে থাকা নুড়ি পাথরে সাবধানে পা ফেলার পালা।
পথ পিচ্ছিল। বাঁকা ফাঁদ গুলো টোপর গিলে আছে। বুনো লতার ঝোপ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাদের রাজ্যে। ঝিরির পাথুরে পথ বেয়ে এসে পৌঁছলাম টিপরা কুমের কাছে। এখান থেকেই পাথরের বড় সারি শুরু। সতর্কতার সাথে পাথরে পা ফেলতে হয়। একবার পিচ্ছিল পথে আছাড় খেলেই মাথা ফেটে যাওয়া এখানে খুব সামান্য। ঝোপ ঝাড়ের লতা পেরিয়ে টিপরা কুমের শ্যাওলা ধরা গা বেয়ে চলতে লাগলাম। পাথুরে পথের শেষ এখানে। কলকল ধ্বনিতে জলের ধারা নামছে। দু চোখের সম্মুখে ঝরনা। স্থানীয়দের সুপরিচিত কুপিকাটা কুম।
মিনিট দশেক বিশ্রাম নেয়ার পরেই উঠতে হলো। মূল ঝরনা এখনো বহু দূর। পথের দিশা সহজেই খুঁজে নিতে হয়। পথের দুপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠা ঝোপঝাড়ের দিশা পেয়ে জলের নাচন এখানে স্তব্ধ। পাহাড়ে এবার চড়তেই হয়। পাহাড়ি পাড়া উজাইল্লা এক কোনে দেখা মিলে। সরু আঁকা বাঁকা দুর্গম পথ পেরিয়ে মাথায় বাঁশের বোঝা চাপিয়ে চলছে দুই ত্রিপুরা নারী। আমাদের দেখে খানিক টা লজ্জা পেলো বোধহয়। মাঝে আবার নেমে পড়া। ছোট ছোট গর্ত পিচ্ছিল গা গেয়ে লেপটে আছে। ভেজায় পা না মাড়ানোই ভালো। কেইবা সাধে আছাড় খেতে চায়! দশ ফুতের দুটি ঢাল পেরিয়ে পাথর খণ্ডের পাশ কেটে পাহাড়ের গা ধরে নেমে এসেছে দুটি ভিন্ন পথ।
পাথরের পথ বেয়ে চলতে লাগলাম। পানির স্রোত কিছুটা বাড়ছে। বুনো কুলের কাঁটা গায়ে বিঁধতে পারে একটু হলে। বনের পাখিরা ভিড় জমায় শীতকালে। তখন ঝিরি থাকে প্রায়ই শুকনো। গাইডের সতর্ক বার্তা। বড় পাথর কমে এসেছে। প্রকৃতির বাঁধানো পথে এ যেনো সহস্র বছরের প্রান্তহীন দৃষ্টি। কিছুটা টেরও পেলাম। ধারণা সত্যি হয়ে ঝিরির ঢাল নেমেছে মূল ঝরনার বাঁকে। নামটা একটু অচেনা সবার কাছে। “বাঘ বিয়ানি ঝরনা”। প্রবাদ আছে কোন এককালে ঝরনার চুড়া থেকে বাঘ পড়ে মারা যায়। সাথে বাঘ শাবক জন্ম নেয়। বাঘ চলে গেলেও বাঘের নাম যেনো পরিপূর্ণতা পায়।
পাহাড়ের দেড়শ ফুট উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে জলের অবিশ্রান্ত ধারা। দুপাশে পাথুরে পাহাড়ের খাঁজ আটকানো। খানিকটুকু বিশ্রাম নিয়ে পথ চললাম ফেলে আসা ঝিরির দুপথের কোনে। ভিন্ন পথ মাড়িয়ে, পাথুরে জলের ধারা পেরোলাম। এবার বুনো ঝোপের সংখ্যা বাড়লো সাথে জলের ধারা। চোখে ধরা দিলো নাপিত্তাছড়ার মূল ঝরনা। দুটি ভিন্ন খাঁজে জল গড়িয়ে পড়ছে। উঁচু পাহাড়ের পাথুরে ঢালে শুদ্ধতার নাচন। সস লতাপাতা মেলে ধরা ঝরনার গায়ের মতো আমাদের চোখেও প্রশান্তির ছোঁয়া।
বিকেল গড়িয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা। ঝরনার জলের ধারার কোনো বিশ্রাম নেই। দুচোখে প্রশান্তির ছোঁয়ায় আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
যেভাবে যাবেন – ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গামী যেকোনো বাসে উঠবেন। বাসের হেল্পার কে নয়াদুয়ারি হাট বললেই নামিয়ে দিবে। অথবা মিরসরাই বাজারে নেমে সিএনজি করে আসতে পারেন। রাস্তার বাঁ পাশ ধরে আধা ঘণ্টা হাঁটলেই পাহাড়ি নাপিত্তাছড়া।
নয়াদুয়ারি বাজারে দুপুরে খাওয়ার ব্যাবস্থা নেই। মিরসরাই বাজারে এসে খেতে হবে।
গাইড নিয়ে এখানে ঝামেলায় পড়বেন না। তবুও একজনের মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিলাম, গাইড হিসেবে খুব আন্তরিক। মিয়া খান – ০১৮১৮২৩১৩৫
বিঃ দ্রঃ- দয়া করে অযথা পলিথিন, চানাচুর চিপসের প্যাকেট, আজেবাজে অপচনশিল জিনিস ফেলে প্রকৃতির ক্ষতি করবেন না। যা নিয়ে যাবেন তা ফিরিয়ে আনবেন। আপনার পরবর্তী প্রজন্ম যাতে আপনার মতোই প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:১৩