somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৌ অপারেশান

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৯ এপ্রিল ১৯৭১।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। ভারতের বোম্বে বিমানবন্দরে অবতরণ করল জেনেভা থেকে আসা বিশালদেহী বোয়িং একটি বিমান।
ভেতরে যাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। যাত্রীদের সবার পেছনে বিমানের সিঁড়িতে টানা ৯ দিনের লাগাতার ক্লান্তি, অনিশ্চয়তা আর দুর্বিসহ দুর্ভাবনার ধুলাবালি ঝেড়েমুছে, শিথিল ক্লান্ত পায়ে যে আটজন যাত্রী নেমে আসছে তাঁদের চোখ-মুখ এবং লেবাসের দিকে তাকালে খুব সহজেই অনুমান করা যায় এ আটজন যাত্রীর সবাই বাঙালি। বাংলাদেশের বাঙালি।
ফ্রান্সে পাকিস্তান সাবমেরিন থেকে অনিশ্চিত জীবনের যাত্রাপথে তাঁরা পালিয়েছিল শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, মুত্যুর ঝুঁকি নেবার জন্যও। তবে সে মুত্যু তাঁরা কখনেই বিদেশ-বিভুঁয়ে’র মাটিতে কামনা করে না। তাঁরা মরতে চায় স্বদেশের মাঠিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে একেকজন বীর মুক্তিসৈনিকের মতোই মৃত্যুকে তাঁরা স্বাগত জানাতে চায়।

১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে আইয়ুব খান এই নৌসেনা প্রশিক্ষণের জন্য দ্বারস্থ হন ফ্রান্সের।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী জ্বালাও- পোড়াও আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময় অত্যাধুনিক সাবমেরিনারদের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি দল পাঠনো হয় ফ্রান্সে। শত্রুদেশ ভারতের শক্তিশালী নৌশক্তিকে মোকাবেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। যে কারণে তার নৌবহরে উন্নত সাবমেরিনের পাশাপাশি নৌসেনাদের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর যে দলটি প্রশিক্ষণের জন্য ফ্রন্সে পাঠানো হয় তার মোট সদস্যসংখ্যা ছিল সাতান্ন। এর মধ্যে তেরো জন ছিল বাঙালি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানি এবং বাকিরা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি। বেশিরভাগই ছিল পাঞ্জাবি। ওই একই বছর পাকিস্তান তার নৌবাহিনীর জন্য ফ্রান্স থেকে তিনটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন কেনে। কথা ছিল, প্রশিক্ষণ শেষ করে পাকিস্তানি সাবমেরিনারা নিজেরাই সাবমেরিন চালিয়ে পাকিস্তানের করাচির নৌঘাটিতে ফিরবে।
বাংলাদেশে মার্চের ক্র্যাকডাউন শুরু হবার আগেই ফ্রান্স থেকে কেনা দুটি সাবমেরিন যথারীতি পাকিস্তানের নৌঘাটিতে পৌঁছে যায়। তুলনের নৌঘাটিতে এরপর বাকি থাকে পিএনএস ম্যাংগ্রো। এই ম্যাংগ্রোর অভ্যন্তরেই ঘটেছিল বাঙালিদের উপর ২৫ মার্চের পাকিস্তানি সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অলইন্ডিয়া রেডিওর সংবাদ বুলেটিন শোনার পীড়াদায়ক ঘটনা।
২৬ মার্চ সংবাদ বুলেটিনে বাংলাদেশের সর্বশেষ এবং চরম পরিস্থিতির ঘটনা শোনার পর তাঁরা সাংঘাতিক রকম মুষড়ে পড়েন। বুলেটিনে স্পষ্টতই বোঝা গেছে, পূর্ব পাকিস্তান এখন আর বৃহত্তর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত কোনো প্রদেশ নেই। সেখানে এখন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মরণপণ যুদ্ধে নেমেছে মুক্তিকামী জনগণ। দুর্দমনীয় রক্তের টান অস্থির করে তোলে তাঁদের।
সুপ্ত জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে রক্তের মধ্যে। স্বাধীনতার এই যুদ্ধে শরীক হতেই হবে। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের ফাঁকি দিয়ে পালাতে হবে প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে। প্রবাসী বাঙালি নৌসেনাদের অন্তরে বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ওইদিনই সন্ধ্যার দিকে নৌঘাটি সংলগ্ন ক্যাফেটরিয়ার লনে একান্ত বৈঠকে বসে পিএনএস ম্যাংগ্রোর নয়জন বাঙালি সাবমেরিনার। অতিরিক্ত পাকিস্তানমনা সন্দেহে মোট তেরোজন বাঙালির মধ্যে চারজনকে বাদ রাখা হল।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, ফ্রান্সে ইতোমধ্যেই এই নৌসেনাদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং এই পর্যায়ে সাবমেরিন নিয়ে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনের তারিখও নির্ধারিত হয়েছে ১ এপ্রিল ১৯৭১। সে অনুয়ায়ী হাতে সময় আছে আর মাত্র পাঁচদিন। তাঁরা প্রতিদিন রেডিওতে বিভিন্ন স্টেশন ধরে বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবরগুলো টেপ রেকডিং-এ সংগ্রহ করে তা সকলকে শোনাতে থাকে।
পাকিস্তানি সহকর্মীদের কৌতুহলী দৃষ্টিকে ফাঁকি দেবার জন্য বিদ্রোহীরা সবাই পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্তব্য কাজে আগের চেয়েও বেশি আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে থাকে।
পিএনএস ম্যাংগ্রো ছেড়ে যাবার ঠিক আগের দিন ৩১ মার্চ সন্ধ্যার আগে থেকেই পুরাপুরি প্রস্তুত হয়ে পড়ে বিদ্রোহী দলটি। শপিং এ যাবার নাম করে একজন একজন করে এরপর যে যার পথে পায়ে হেঁটে বাস ধরে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে মারসেলি নামক একটি শহরে এসে পৌঁছে বিদ্রোহীরা। সেখান থেকে কয়েকটি দেশ অতিক্রম করতে গিয়ে তাদের সহযোগী আবদুল মন্নান নামক একজন দলছুট হয়ে যায়। বাকী আটজন টানা ৯ দিনের লাগাতার ক্লান্তি শেষে বিমানযোগে ৯ এপ্রিল ১৯৭১ ভারতের বোম্বে বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন।
পালিয়ে আসা আটজন সাবমেরিনার হলেনণ্ড
১. সৈয়দ মোশারফ হোসেন (আই আর এ-৪), ২. আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী ( আর ও), ৩. রহমত উল্লাহ ( সি আর ও), ৪. বদিউল আলম ( ই এম প্রথম শ্রেণি), ৫. আমিন উল্লাহ শেখ ( ই এ), ৬. আহসান উল্লাহ ( ই এম), ৭. আবিদুর রহমান (এ বি), ৮. আবদুর রকিম মিঞা (ই এম) শহীদ ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন দিল্লীতে এবং থাকার ব্যবস্থা করা হয় রনজিৎ হোটেলে।
ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। এবার তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় একই নগরীর খাজা নাজিমউদ্দিন রোডের একটি বাংলো টাইপের বাড়িতে। এই বাংলোবাড়িতেই একদিন ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এসে হাজির। কুশল বিনিময় শেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসার সাথে সাথেই এ ব্যাপারে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং মি. গুপ্তের কাছে যুদ্ধে যাবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দেবার আবেদন জানায় তাঁরা।
গুপ্ত বললেন, হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধে যোগ দেবার চেয়েও তাদের জন্য উপযুক্ত হবে নৌযুদ্ধে অংশ নেয়া। তিনি তাদেরকে বোঝালেন, বাংলাদেশে নৌপথে প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হলে তা স্থলযুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি কাজ দেবে। এই লক্ষ্য অর্জনে নেভাল কমান্ডো বা নৌকমান্ডো বাহিনী গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।

তাঁদেরপক্ষে যেহেতু রণতরী নিয়ে নৌযুদ্ধ সূচনা করার মতো অবস্থা নেই সেকারণে এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে নৌকমান্ডো অপারেশন চালানোই বেশি যুক্তিযুক্ত। বাঙালি সাবমেরিনাররা নির্দ্বিধায় মি. গুপ্তের এই ঐতিহাসিক পরামর্শটি গ্রহণ করলো। তাঁদের সম্মতি পাবার পর ব্রিগেডিয়ার মি. গুপ্ত কমান্ডার শর্মাকে এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিলেন।
এবার সম্পূর্ণ নতুন উদ্দীপনা দেখা গেলো সাবমেরিনারদের মধ্যে। তাঁরা মি. শর্মার ব্যবস্থাপনায় দিল্লীর পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীতে বিশেষ নৌ-প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নেয়। প্রশিক্ষণ দেবার দায়দায়িত্ব অর্পিত হলো ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট সমীর কুমার দাসের উপর। কঠোর শ্রমসাধ্য এই প্রশিক্ষণ। ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে তা শেষ হয় ১৫ মে।


নৌ-প্রশিক্ষণ চলার সময়েই একদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী এলেন তাঁদের সাথে দেখা করতে। ভবিষ্যতের নৌকমান্ডো বাহিনী গঠনের প্রশ্নে এখানে ওসমানীর সাথে বিশদ আলোচনা হলো। স্বভাবতই কর্নেল তাঁদের প্রস্তাব যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখবেন বলে আশ্বাস দিলেন। বলাই বাহুল্য অচিরেই তিনি এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিলেন।
এরই মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল গুলজারী লাল নন্দাও এলেন নিজামউদ্দিন রোডের বাংলো বাড়িতে। বাঙালি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণ এবং পরবর্তী কর্মপন্থা সম্পর্কে আলেচনা হল তাঁর সাথে। নৌকমান্ডো বাহিনী গঠনের ব্যাপারে তিনিও পুরাপুরি একমত। এ অবস্থায় প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের আর কোনো বাধাই থাকে না। এখন বাকি রইল কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য স্থান নির্ধারণ।
১৫ মে দিল্লীর নিকটবর্তী যমুনা নদীতে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের প্রশিক্ষণ শেষ করে ফ্রান্সের তুলন থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি নৌসেনাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী ও ভারতীয় নৌবাহিনীর একান্ত সহায়তায় ওই ঘটনার বারোদিন পর ২৭ মে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে নৌ-প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সচল করা হয় মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশীর ভাগিরথী নদীর তীরে। সর্বাত্মক গোপনীতায় স্থাপিত এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় ‘সি-২পি’। পরবর্তীকালে এই সি-২পি ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌকমান্ডোরা গোটা বাংলাদেশের জলসীমায় ধ্বংসাত্মক ও মরণঘাতী অভিযান চালায়। ভবিষ্যতের বিরাট সাফল্যের কথা চিন্তা করে তার সাংকেতিক নাম রাখা হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’।
ক্যাম্পের প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি এম মার্টিস। ক্যাম্পের অন্য প্রশিক্ষকরা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার লেফটেন্যন্ট এস কে দাস, মেন সিং এবং ফ্রান্সের তুলন থেকে পালিয়ে আসা আটজন বাঙালি সাবমেরিনার।
২৭ মে পলাশী ক্যাম্পের উদ্বোধনী দিনে স্বাগত ভাষণ দেন নৌকমান্ডো পরিকল্পনার অন্যতম সংগঠক কমান্ডার সুমন্ত। এরপর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মার্টিস তার বক্তব্য রাখেন। সবশেষে বাঙালি সাবমেরিনারদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী।
প্রশিক্ষণ শেষে এই সাবমেরিনারদের নেতৃত্বে নৌ-অপরেশনের জন্য কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে কমান্ডোদের পাঠনো হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন সমুদ্র ও নদীবন্দরে।
এ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বেই চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালিত হয় পৃথিবী ব্যাপী আলোচিত অপারেশন জ্যাকপট।
প্রথম অভিযানে পলাশীর মোট ৩১৫ জন নৌকমান্ডোর মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ১৪০ জন চৌকস কমান্ডোকে বাছাই করা হয়। প্রথম পর্বের অভিযানে দলনেতা হিসাবে চারজন সাবমেরিনার পলাশী ত্যাগ করার পর পর্যায়ক্রমে অন্য সাবমেরিনারদেরকেও দলনেতার ভার দিয়ে বিভিন্ন অভিযানে পাঠানো হয়।
পলাশীতে প্রশিক্ষণ চলার শেষদিকে এক ফাঁকে গোপনে আটজন সাবমেরিনারকেই বিশেষ বোয়িঙে নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ নির্দেশ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।
দিল্লীতে সামরিক বাহিনীর একটি সুরক্ষিত কক্ষে তাঁদেরকে এই গুরুত্ববাহী নির্দেশাবলী বুঝিয়ে দেয়া হলো। এখানে তাঁদেরকে টেপ রেকর্ডারে পুরানো দিনের দুটি বাংলা গান পরপর বাজিয়ে শোনানো হয়। প্রথম গানটির প্রথম চরণ ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি’ণ্ডসন্ধ্যা মুখার্জীর গান। দ্বিতীয় গানটি পংকজ মল্লিক কিংবা সায়গলের গাওয়াণ্ড ‘আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান’।
এই গান দুটি পর্যায়ক্রমে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কয়েকবারই বাজিয়ে শোনানো হল, যাতে গানের প্রথম কলি বহুদিন মনে রাখা যায়।
অনেক্ষণ গান দুটি শোনানোর পর টেপ রেকর্ডার বন্ধ করা হলো। এবার মৌখিক নির্দেশে এর মর্মার্থ বুঝিয়ে দেবার পালা। গান দুটির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলা হলো, এই গান শোনার ওপরেই নির্ভর করবে অপরেশন জ্যাকপট কার্যক্রমের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন। কিন্তু সময়মতো গান শুনতে ব্যর্থ হলে সব পরিকল্পনাই পণ্ড হয়ে যাবে।

পলাশীতে চট্টগ্রাম অপারেশনের জন্য ষাটজনের যে বড় একটি কমান্ডো দল তৈরি করা হলো অপরেশনের বৃহত্তর সাফল্যের কথা বিবেচনা করে তাকে আবার ভাগ করা হয় তিনটি গ্রুপ বা উপদলে। একজন গ্রুপ নেতার অধীনে এর প্রতিটি গ্রুপেই কমান্ডোর সংখ্য ছিল কুড়িজন করে। তিনটি গ্রুপের সমন্বিত দলের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় সাবমেরিনার ওয়াহিদ চৌধুরীকে। সমন্বিত নেতৃত্বের পাশাপাশি কুড়িজনের একটি গ্রুপের দায়িত্ব নিলেন তিনি। অর্থাৎ সরাসরি তাঁর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সীমান্ত পার হয়ে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে।
অন্যদিকে গ্রুপের যাত্রাপথের নেতা নির্বাচিত করা হয় ফারুকী আজম এবং শাহ আলম নামক দুই তরুণকে। এ তিনটি গ্রুপ ভারত সীমান্ত থেকে তিনটি ভিন্ন পথে চট্টগ্রামের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে পৌঁছবে। বন্দর সোজা নির্দিষ্ট করে দেয়া এ জায়গাটির নাম চরলক্ষ্যা। পশ্চিম পটিয়ার চরলক্ষ্যা গ্রামে একটি খামার বাড়ির দুটি ছোট ঘর তাঁদের জন্য ঠিক করে রাখা আছে। নৌকমান্ডোদের তিনটি গ্রুপ ভিন্ন পথ ধরে যথাসময়ে ওই বাড়িতে গিয়ে পৌঁছবে। বাড়ির লোকজনদের আগেই অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হবে, যাতে তাঁরা নৌকমান্ডোদের এবং তাদের তৎপরতা দেখতে না পায়।
তিনটি গ্রুপের মধ্যে দুটি গ্রুপণ্ডএক নম্বর এবং দু’নম্বর গ্রুপ যথাক্রমে মূল দলনায়ক ওয়াহিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে স্থলপথে মীরসরাই ও সীতাকুণ্ড হয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে পৌঁছবে। চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট অবস্থানস্থলগুলো থেকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তাঁরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মাঝিরঘাট দিয়ে কর্ণফুলী পার হবে। ওপারেই গ্রাম চরলক্ষ্যা। অপারেশনপূর্ব সর্বশেষ ঘাঁটি।
কুড়িজন কমান্ডোর তৃতীয় গ্রুপটি শাহ আলমের নেতৃত্বে নৌপথে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছবে চরলক্ষ্যায়। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সংকেত অনুযায়ী তিনটি গ্রুপের সম্মিলিত দলটি মূল অপারেশন শুরু করবে।
এটা ধরেই নেয়া হয়েছিলো যে, ষাটজন নৌকমান্ডো দলের সবাই শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশনে অংশ নিতে পারবে না। যাত্রাপথেই হয়তো কেউ কেউ পথ ভুল করে কিংবা অন্য কোনো কারণে গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
সেক্ষেত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও যাত্রাপথে শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে চলার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও এ ধরনের অঘটনের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপরন্তু যথাস্থানে যথাসময়ে সকল কমান্ডোর উপস্থিতি সম্ভব নাও হতে পারে। কিংবা কেউ কেউ ধরাও পরে যেতে পারে শত্রুপক্ষের কাছে। এ
সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত একটি গ্রুপও যদি চরলক্ষ্যা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারে, তা-ই যথেষ্ট। বন্দরে অপারেশনের জন্য কুড়িজন কমান্ডো যদি দায়িত্ব পালনে সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক হয় তাহলে তাঁরা অসাধ্য সাধন করতে পারবে।
এসব বিবেচনা করে ষাটজনের দলটি তিনভাগে ভাগ করে চট্টগ্রাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ধরে নেয়া হয়, শেষ পর্যন্ত অন্তত একটি গ্রুপ চরলক্ষ্যায় গিয়ে পৌঁছবেই।
তিনটি গ্রুপের প্রতিটির পথ-প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় গাইড, গ্রেনেড, স্টেনগান, গুলি এবং পথ-খরচের জন্য দেয়া হয় কিছু টাকা। দিনতিনেক চালানো যায়, এমন কিছু শুকনা খাবারও সাথে দেয়া হলো। প্রতিটি গ্রুপের প্রতিজন নৌকমান্ডোকে দেয়া হয় দুটি করে লিমপেট মাইন, একটি ধারালো ছুরি, একজোড়া কাপড়ের জুতা, একজোড়া ফিন্‌স, একটি সুইমিং কস্টিউম, একটি হাফ প্যান্ট এবং মালামাল বহনের জন্য একটি করে কাঁধে ঝোলানো চটের ব্যাগ। সবশেষে দলনেতাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে দেয়া হলো একটি ক্ষুদ্রাকার হালকা অথচ শক্তিশালী ট্রানজিস্টার। এ ট্রানজিস্টারের প্রয়োজনীতাও সাথে সাথে তাকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।
তিনটি গ্রুপের একটি ১১ আগস্ট সাব্রুম সীমান্ত থেকে সারারাত হাঁটাপথ অতিক্রম করে পরদিন খুব ভোরে এসে পৌঁছলো চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাইর ইছাখালি গ্রামে। পলাশী ক্যাম্পের নির্দেশ অনুযায়ী সারাদিন তাঁদেরকে আত্মগোপন করে থাকতে হবে। দিনের আলোয় কিছুতেই পথচলা যাবে না। কাজেই ১২ অগাস্টের দিনটি তাঁরা ইছাখালির একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকে। সন্ধ্যার পর আবার পথচলা।
কিছুদূর পরপরই গাইড পরিবর্তিত হচ্ছে এবং নতুন গাইড এসে সে স্থান পূরণ করছে। পথে নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ ঘটছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একটি গেরিলাঘাঁটি থেকে পরবর্তী নিরাপদ গেরিলাঘাঁটির ঠিকানা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ দীর্ঘ হাঁটাপথ দুস্তর ও কষ্টকর হলেও শেষ পর্যন্ত পথে তাঁদের তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হলো না। অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ভিন্ন পথে দুটি গ্রুপই মিলিত হন ইছাখালী গ্রামে।

১২ অগাস্ট মধ্যরাতে এ বৃহত্তর কমান্ডোদলটি এসে পৌঁছলো সমিতিরহাট নামক একটি স্থানে। চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশনের জন্য নির্ধারিত নৌকমান্ডো দলের কুড়িজনের একটি গ্রুপ ১৪ আগস্ট এসে ওঠে চট্টগ্রাম শহরের কাকলীতে। কমান্ডোদের মূল দলনায়ক ওয়াহিদ চৌধুরীও এ বাড়িতেই অবস্থান নেন।
পরদিন ১৫ আগস্ট শহরের নিভৃত এলাকায় অবস্থানরত কমান্ডোরা প্রস্তুত হলো শহর পাড়ি দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপারে চরলক্ষ্যায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু শহর পাড়ি দেয়া এখন খুবই বিপজ্জনক।
শহরে দিনের আলোতে লোক-চলাচল থাকলেও পাকিস্তানিদের শকুনচোখ প্রতিনিয়তই তাদের উপর তীক্ষ্ন নজর রাখে। শহরের ভেতর প্রতি রাস্তার মোড়েই চেকপোস্ট। এ অবস্থায় দিনের আলোয় শহরে বেরুলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যেতে হবে। রাতেও বেরুনো সম্ভব নয়। সন্ধ্যার পর থেকেই কারফিউ। সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন রাস্তায় এমনকি কুকুর দেখলেও গুলি ছোঁড়ে।
কমান্ডোদের হাতে সময়ও বেশি নেই। এরই মধ্যে আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র থেকে সম্প্রসারিত প্রথম সাংকেতিক গানটি শোনা গেছে। এই গান সম্প্রচারিত হবার ঠিক চব্বিশঘণ্টা পর দ্বিতীয় গানটিও শোনা যাবে। কমান্ডো অধিনায়ক পরবর্তী গান শোনার জন্য এখন চঞ্চল হয়ে রয়েছেন। সুতরাং দ্বিতীয় গান শোনার আগেই শেষ ঘাঁটি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায় মধ্যবর্তী চরলক্ষ্যা গ্রামে পৌঁছতে হবে। এ অবস্থায় তাড়াহুড়ার মধ্যে দিনের আলোতেই শহর পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো।
১৫ আগস্ট ভোরের দিকে কারফিউ শেষ হবার পরপরই কমান্ডোরা মরণপণ প্রস্তুতি নিলো। মুত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে হলেও আজই শহর পাড়ি দিতে হবে। তাঁদের পরিবহনের জন্য হাসপাতালের একটি এম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের পিকআপ ভ্যানটিও প্রস্তুত। কমান্ডোরা এবার তাঁদের পোশাক-আশাকও বদল করে নেয়। সবাই আধময়লা এবং ছেঁড়াগেঞ্জি পরে কাঁধে ব্যবহৃত গামছা, যেনো দেখলেই মনে হয় এরা সবাই শ্রমিক, কাজে যাচ্ছে। গাড়ি দুটির মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র ও মাইনগুলোও লুকিয়ে নেয়া হলো। গাড়ি এখন কমান্ডোদের নিয়ে শহর পাড়ি দিয়ে যাবে কর্ণফুলীর মাঝিরঘাটে। এই মাঝিরঘাট দিয়েই নদী পাড় হতে হবে।

যেমনটি ভাবা হয়েছিলো, সারা বাংলাদেশের অন্যন্য এলাকার মতো চট্টগ্রামেও পাকিস্তানিরা ১৪ আগস্টের সতর্কতা জোরদার করছে। ওইদিন পূর্ব আশংকা অনুযায়ী বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলাও জোরদার করা হয়। তাঁরা পাকিস্তানিদের স্বাধীনতা দিবসের উৎসব পণ্ড করে দেবার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অসংখ্য বিক্ষিপ্ত হামলা চালায়। পরদিন ১৫ আগস্টেও পাকিস্তানিরা এ তীব্র হয়ে ওঠা গেরিলা হামলার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পরেনি। যে কারণে এদিনও চট্টগ্রামে আগের দিনের সতর্কতা পূর্বাপর বলবৎ থাকে। অসমসাহসী নৌকমাণ্ডোরা এ অবস্থার মধ্যেদিয়েই সদলবলে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। তাদের জন্য নির্ধারিত পিকআপ ভ্যানটিতে বিদ্যুৎ লাইন মেরামতের লম্বা মইটিও ঝুলিয়ে রাখা হয়।
গাড়ি লাইন মেরামতে যাচ্ছে, এটা বুঝানোর জন্যই এ কৌশল অবলম্বন। সাথের অপর গাড়িটি হচ্ছে এ্যম্বুলেন্স।
দুটি গাড়ি সকালের উজ্জ্বল রোধের মধ্যেই ফাঁকা রাস্তায় মেনে পড়ে। একে একে নির্বিঘ্নেই পার হয়ে যায় পাকিস্তানিদের চেকপোস্টগুলো। মেসিনগান বসানো কয়েকটি জিপও তাদের পাশ কেটে গেলো। হাসপাতালের এ্যম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের মই লাগানে পিকআপের দিকে তারা তেমন মনোযোগী হলো না। এভাবে একটির পর একটি প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে চললো তাঁরা। গাড়ির ভেতরে কমান্ডোদের অন্তরাত্মা তখন দুরু দুরু করছে অজানা আতংকে।
কখন একটি বিকট চিৎকার শোনা যাবেণ্ডহল্ট। কিংবা কোনো আগাম জানান না দিয়েই আকস্মিক এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ। একসাথে কয়েকটি মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার। এরকম আবোল-তাবোল দুশ্চিন্তার মধ্যে কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসে সবার। কিন্তু না, কোনো বিপদই ঘটলো না। এখানেও পাকিস্তানিদের সবগুলো সতর্ক চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা একসময় পৌঁছে যায় কর্ণফুলীর পাড়ে মাঝিরঘাটে।
ঘাটের কাছেই বাজার। কমান্ডোরা বাজার থেকে প্রচুর তরিতরকারি কিনে কয়েকটি ঝুঁড়ি ভরে ফেলে। কৌশলে ঝুঁড়িগুলোর নিচে লুকিয়ে রাখা হয় অস্ত্রপাতি এবং মাইনগুলো। তারপর তাঁরা বাজারফেরত দিনমজুরের মতোই হেঁটে নেমে আসে ঘাটের দিকে। খেয়াঘাটেও বসেছে পাকিস্তানিদের চেকপোস্ট। সশস্ত্র সৈনিকরা সতর্ক চোখ ঘোরাচ্ছে চারিদিকে। ঝুড়ি মাথায় কমান্ডোরা এই জিঘাংসু চোখগুলোর সামনে দিয়েই একে একে খেয়ানৌকায় গিয়ে ওঠে। অনাকাঙিক্ষত কোনো আপতিক অঘটন এখানোও ঘটলো না। নির্বিঘ্নেই খেয়ানৌকা নদী পাড় হলো। এরপর গিয়ে পৌঁছলো দীর্ঘ প্রতিক্ষার শেষ ঘাঁটি চরলক্ষ্যায়।
কিন্তু চরলক্ষ্যায় পৌঁছার আগেই তাঁরা একটি দুসংবাদ শুনে হতাশ হলো। তাঁরা জেনে যায়, তাঁদের তৃতীয় গ্রুপটি তখনো সীতাকুণ্ড থানার জেলেপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবরোধের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। এ অবস্থায় ধরে নেয়া হলো, তৃতীয় গ্রুপের কমান্ডোদের বাদ রেখেই তাদেরকে অপারেশনে নামতে হবে।
চরলক্ষ্যার নির্দিষ্ট বাড়িতে কমান্ডোদের তখন বিশ্রাম নেবার পালা। রাতেই মূল অপারেশনে জন্য নামতে হবে কর্ণফুলীর পানিতে। সন্ধ্যার পর যে কোনো সময় শোনা যাবে আকাশবাণীর শেষ সাংকেতিক গান। দলনায়ক তার সব কাজকর্মের মধ্যেও মনোযোগ নিবন্ধ করে আছেন সেদিকে।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কমান্ডোরা খানিক ঘুমিয়ে নেয়ার জন্য শুয়ে পড়লো। বিকেলের দিকে দলনায়কের নেতৃত্বে আধামাইল দূরে অপারেশনস্থলে অর্থাৎ কর্ণফুলীর পাড়ে জাহাজের অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য রেকি করা হলো। বেশ কয়েকটি জাহাজ দেখা গেলো সেখানে। মূল বন্দর এবং বন্দরের আশেপাশে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। জাহাজগুলো ধ্বংস করার জন্য নদীর কোন স্থান বরাবর পানিতে নামতে হবে এবং অপারেশন শেষে কোন স্থান দিয়ে পাড়ে উঠতে হবে, ভালো করে সব চিহ্নিত করে রাখা হলো।

বন্দরের বারো নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা আছে এমভি আল-আব্বাস নামের একটি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ। হাজারটনের ওপর সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে জাহাজটি বন্দরে ভিড়েছে ৯ আগস্ট। কিন্তু তার মালামাল এখনো খালাস করা হয়নি। বন্দরের সবচেয়ে বড় জহাজ এমভি হরমুজ। পাকিস্তানের এই জাহাজটিতেও রয়েছে প্রায় হাজার টন যুদ্ধাস্ত্র। এমভি হরমুজ বন্দরে ভিড়েছে মাত্র একদিন আগে, ১৪ আগস্ট। এই জাহাজের মালামালও খালাস হয়নি। জাহাজটি নোঙ্গর করেছে তেরো নম্বর জেটিতে।

বড় আকারের জাহাজ দুটির কাছাকাছি জলসীমায় আরো কয়েকটি বার্জ ও গানবোর্ড নোঙ্গর করা আছে। এর একটিতে রয়েছে প্রায় তিনশোটনের মতো সমরাস্ত্র। কয়েকটি গানবোটও আছে এখানে ওখানে ছড়িয়ে। জাহাজগুলোর সঠিক অবস্থান এবং অন্যান্য রেকিপর্ব শেষ করে আবার চরলক্ষ্যার ঘাঁটিতে ফিরে যায় কমান্ডোরা। দলনায়ক মোটামটি মুখস্ত করে নিলেন পুরা চিত্রটি।
সন্ধ্যার পর এপার থেকে বন্দর এলাকা আবরো রেকি করা হয়। জাহাজগুলো সব আগের অবস্থানেই ঠিকঠাক আছে। ওই রাতেই আকাশবাণীতে শেষ সাংকেতিক গানটি বেজে ওঠেণ্ডআমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান। অধিনায়ক ওয়াহিদ চৌধুরীর বুকের মধ্যে এই গান কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো তা তিনিই জানেন। তবে বুকের মধ্যকার সেই তোলপাড় আড়াল করে তিনি রাত এগারোটার দিকে চরলক্ষ্যার ওই ঘাঁটিতে অপারেশনে যেতে ইচ্ছুক সকল কমান্ডোকে একস্থানে জড়ো করলেন। রাত একটায় কমান্ডোরা সবাই এসে পৌঁছল নদীর তীরে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমনকি একটি রাতজাগা পাখির ডাকও না। ওপারে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ঘুমে অচেতন।
ঠিক এই সময় কর্ণফুলীর ওপারে দলনেতা নৌকমান্ডোদের পায়ে ফিনস্‌ এবং পেটের সাথে গামছায় মাইন বেধেঁ দিয়ে ছোট ছোট দলে পৃথক করে নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়েছেন পানিতে। নদীতে তখন জোয়ারের শেষপালা। একটু বাদেই ভাটার হালকা টান শুরু হবে। কমান্ডোরা এই জোয়ার-ভাটার সন্ধিক্ষণে দুপায়ে ফিনস্‌ের হালকা টানে পানির ওপর নাক জাগিয়ে হাঁসের মতো এগিয়ে যায় জাহাজের দিকে। কে কোন জাহজে মাইন লাগাতে হবে তা আগে থেকেই ঠিক করে দেয়া আছে।

কমান্ডোদের একটি দল নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে ডুব দিলো। ভেসে উঠলো আল-আব্বাসের শরীর ঘেঁষে। এখানটায় বন্দরের আলো কিংবা সার্চলাইটের ফোকাস পড়েনি। প্রায় একই সময় অন্য একটি দল ভেসে ওঠে এমভি হরমুজের গা ছুঁয়ে। বাদবাকি কমান্ডোরা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে অন্যন্য গানবোটের কাছে। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে আল-আব্বাসের ইস্পাতের শরীর ছুঁয়ে আবার ডুব দিল কমান্ডোরা। তিনজন কমান্ডো জাহাজের তিন জায়গায় বিশেষ করে ইঞ্জিনরুম এবং বয়লার সোজা চার থেকে পাঁচ ফুট পানির নিচে তিনটি মাইন সেঁটে দেয়ার প্রস্তুতি নিলো।
কোমরের ছুরি দিয়ে নির্দিষ্ট ওই স্থানের শ্যাওলা সরিয়ে পরের ডুবে অনায়েসেই মাইন লাগিয়ে দেয় তাঁরা। একইভাবে হরমুজ এবং অন্য জলযানগুলোতেও মাইন লাগিয়ে দেয়া হলো। এদিকে নদীতে তখন ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে। কমান্ডোরা এবার জাহাজের আড়াল ত্যাগ করে লম্বা এক ডুব দিয়ে যতোদূর সম্ভব সরে গিয়ে ভেসে ওঠে। তারপর আগের মতোই নাক জাগিয়ে হাঁসের মতো পা দুলিয়ে নিঃশব্দে সাঁতরে ফিরে যায় পারের দিকে।
বন্দরে প্রহরীদের ডিউটি শেষ হবার আগেই রাত ঠিক পৌনে দুইটর দিকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ফেটে যাবার শব্দে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে আল-আব্বাসের তলায়। পরপর তিনটি বিস্ফোরণ ঘটলো সেখানে। হরমুজের বিশাল ইস্পাতের শরীর কাঁফিয়ে দিয়ে বিস্ফোরিত হয় আরও একটি লিমপেট। এবার আর বিরাম নেই। বিকট শব্দে বিরতিহীন মাইনের বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায় একটির পর একটি।
প্রথম বিস্ফোরণেই আল-আব্বাসের পেছনের দিকটা দেবে গেল পানির মধ্যে। এরপর মাথা ক্রমশ উঁচু করে কর্ণফুলীর তলে আমূল ডুবে যায় জাহাজটি। হরমুজেরও একই দশা। দিগ্বিদিক আতংকগ্রস্ত পাকিস্তানিদের চোখের সামনেই একে একে ডুবতে থাকে নৌযানগুলো। অপারেশন প্র্রায় একশভাগই সফল। বন্দরের সব জাহাজেই মাইনের বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণের সময় কোনো কোনো জাহাজে আগুন ধরে যায়।
প্রথম বিস্ফোরণের শব্দেই বন্দরের প্রহরীদের চোখের ঘুম নিরুদ্দিষ্ট হলো। এরপর পর্যায়ক্রমিক বিস্ফোরণে বেদম ছোটাছুটি এবং হই-চই শুরু হয়ে যায় সমস্ত বন্দর এলাকায়। বিস্ফোরণের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত প্রহরী এবং নাবিকরা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বন্দরের জেটিতে ভীত-সন্ত্রস্ত পাকিস্তানিরা কী ঘটেছে না বুঝেই বেদম গুলিবর্ষণ শুরু করে নদীর দিকে। হামলাটি নদীর দিক থেকেই এসেছে, এইটুকু অন্তত তারা অনুমান করে বুঝতে পারে। সার্চলাইটের উজ্জ্বল আলো খুব দ্রুতলয়ে ঘুরছে নদীর বুক জুড়ে। কিন্তু সেই আলোতে একটি মাথাও গোচরীভূত হলো না, যাকে গুলি করে চিরতরে ডুবিয়ে দেয়া যায়। এই শিকারী আলোর সীমানা আগেই ছাড়িয়ে গেছে কমান্ডোরা।
চট্টগ্রামের প্রথম এই অপারেশনে একজন কমান্ডোও মারা যায়নি। পরদিন ১৬ আগস্ট সফল অভিযানের এখবর বিবিসি’সহ সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলো ছড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক বলয়ে। এতোদিন পর এই প্রথম খুব বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেদিয়ে পাকিস্তানিদের অপরাজয়ের অহংকার ভেঙে গুড়িয়ে যায়। নিজেদের মধ্যেতো বটেই, বহির্বিশ্বেও। এতোদিন মুক্তিযোদ্ধারা কেবল স্থলযুদ্ধেই শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। জলপথে পাকিস্তানিদের ছিল অবাধ দৌরাত্ম্য। এই দৌরাত্ম্য এবার বহুলাংশেই নির্জীব হয়ে গেল নৌকমান্ডোদের একটি রাতের অভিযানের সাফল্যে।
কমান্ডো অভিযানের এই ঘটনা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন মূল্যায়নের পথ প্রশস্ত করে দেয় অনেকখানি। সাথে বৃহত্তর পরিসরে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলও বেড়ে যায় বহুগুণ।
পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘটনার জন্য তাঁর ভাষণে প্রথমত দায়ী করলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। তাঁর মতে ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘ফ্রগম্যানরাই’ এ কাজ করেছে।
এটা মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ নয়। আসলে প্রথমদিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নীতি-নির্ধারকরা এটা ভাবতেই পারিনি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যথেকে নৌকমান্ডো নামের একটি ক্ষুদ্র দল এতোবড় সব প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে। বিষয়টির বাস্তবতা উপলব্দি করতে তাদের সময় লেগে যায় অনেক।
পাকিস্তান রেডিও থেকে সম্প্রচারিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের জবাব দেয়া হয় স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী প্রকৃত ঘটনার বাস্তবতা তুলে ধরে পাকিস্তান এবং তার দোসরদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন, তারা যেনো ভবিষ্যতে আর কোনো জাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা না করে। বলাই বাহুল্য, তাঁর এই হুঁশিয়ারি যথেষ্ট কাজ দিয়েছিল।
এরপর থেকে আর কোন জাহাজ বঙ্গোপসাগরের জলসীমা পার হয়ে কর্ণফুলীতে ঢোকেনি।

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৮
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×