দলে হলাম আমরা মোট ৮ জন-- আমি, তনিম,আখিঁ, নিশি, স্মৃতি,মুকুট,সোহান এবং আমাদের প্রধান অতিথি ফুপু। যাত্রা শুরু হলো দর্শনা পুরাতন বাজারস্থ আমাদের বাসভবন থেকে।আমাদের জিপটি যখন চীরদিনের চেনা অথচ অনেক দিনের না দেখা দর্শনা-মুজিব নগর সড়কে মেমনগর গ্রামটি ক্রস করছিল তখন আমার দেহমন এক বিমূর্ত নষ্ট্রালজিকতায় ভরে যাচ্ছিল। এই গ্রামের সাথে মিশে আছে আমার শৈশব কৈশরের বহু স্মৃতি।আমি লেখাপড়া করেছি এই গ্রামের হাইস্কুলে--মেমনগর বি,ডি(বহুমুখী) উচ্চ বিদ্যালয়ে। দীর্ঘ ৫ বৎসর এই পথে স্কুলে যাতায়াত করেছি।আজ আবার অনেকদিন পর সেই পথে যেতে যেতে বহু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনে পড়ে গেল বহু পুরানো চেনা মুখ যার মধ্য কোন কোন মুখের সাথে আর আমার কোনদিন-ও দেখা হবেনা অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন এক সাথে বসে রাস্তার পাশের এই দোকানটিতে টিফিন প্রিয়ডে একটা রুটি চায়ের সাথে ভিজিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়েছি।এরকম ভাবনার মধ্যদিয়ে কখন যে গলায়দড়ি ব্রিজের ঠিক কাছে চলে এসেছি ঠিক বলতে পারবোনা। সম্বিৎ ফিরে এল পাশে বসে থাকা তনিমের আকস্মিক প্রশ্নে:--"মামা এটা তো নদী ডান পাশের টা কি ????"
আমার ডানপাশে রাইসার বিল প্রবাহমান। এই জলাশয়টি অত্র অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় এবং এই বিলের মাছ খুবই সুস্বাদু। ব্রিজ পার হবার পর দুদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে কৃষকদের আগাম চাষের কল্যাণে সরিষা ক্ষেতে হলুদের সমারোহ । খেজুর গাছ গুলোতে কেবল ভাড় পাতা শুরু হয়েছে। জিপের জানালা দিয়ে তাকালে মনে হচ্ছে সবুজের এই সীমারেখা কোন এক সময় আকাশের সাদা মেঘের সাথে গিয়ে মিশেষে।বুনোহাসেরা শরীর বাকিঁয়ে পালকের পানি গুলো ঝরিয়ে নিচ্ছে। লম্বা আকাশমনি গাছের মাথায় বহুদির পর এক সাথে কয়েটি মাছরাঙা দেখলাম। বাতাসে ভেসে এল বুনো কাদা মাটির এক রকম সোদাঁ গণ্ধ। মনে পড়ে গেল এই রুপ দেখেই তো আজ থেকে প্রায় ৬ যুগ আগে কবি নজরুল এই অঞ্চলে এসে ঘর বেধেঁ ছিলেন। এই জনপদের রুপ মাধুরী দেখেই উনি রচনা করেছিলেন বিখ্যাত সেই গান---
" আমার কোন কুলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গায়
আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায় "
পরে বেশ কিছুদিন উনি এই অঞ্চলে বাস করেছিলেন। উনার বাস গৃহটি এখনো সংরক্ষিত আছে। জনশ্রুতি আছে কবি এই গায়ে এসে খ্রীষ্টান পল্লীতে এক রমণীর প্রেমে পড়েছিলেন এবং খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি যথেস্ট অনুরক্ত হয়েছিলেন । এখানে বসবাসকালীন সময়েই কবি বেশ কিছু কাল জয়ী কবিতা, গান , উপন্যাস রচনা করেছিলেন । নজরুল গবেষকদের মতে লিচু চোর কবিতা, বউ কথা কউ -বউ কথা কউ -কউ কথা অভিমানী গান এবং মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের অংশবিশেষ কবি এই অঞ্চলে বসেই রচনা করেছিলেন।প্রতি বছর ১১-ই জ্যোষ্ঠ কবির জন্মদিনে কার্পাসডাংগাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আযোজন করা হয় ।
কার্পাসডাংগা থেকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম জগন্নাথপুর আট কবরে।তার আগে একটি মন ভুলানো জায়গার কথা না বল্লেই নয় সেটা হলো তালসার। এই গ্রামটি কার্পাস ডাংগা থেকে আটকবর যেতে হাতের বামে পড়বে । মনে হবে কোন শিল্পীর আকাঁ ছবি। দুই ধারে যতদূর চোখ যায় তাল গাছ আর তাল গাছ মাঝখানে সুচিক্কন পিচের রাস্তা। যেন ছবির মত গ্রাম। আট কবরে নেমেই সবাই কে আমি আট কবরের ইতিহাস শুনালাম । এই ক্ষেত্রে আমি চুয়াডাংগার আঞ্চলিক গবেষক রাজিব ভায়ের নিকট চীর কৃত্জ্ঞ -- উনার কাছে শুনে এবং উনার লেখা বই পড়েই আমি আট কবরের ইতিহাস বর্ণনা করা শিখেছি।
সবাইকে আটকবর সম্পর্কে যা বল্লাম তার সারাংশ এরকম--
১৯৭১ সালের ৫-ই আগষ্ট চুয়াডাঙ্গার অদুরে বর্তমান মুজিব নগর থানাধীন ধান ক্ষেতে(ঠিক এই ষ্থানে) পাক বাহিনীর সাথে সাহসী সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করে স্থানীয় ০৮ জন বীর সন্তান শহীদ হন; আহত হন প্রায় ১১ জন। পৃথিবীতে যুগে যুগে সম্মুখ যুদ্ধের ইতিহাস অত্যান্ত সম্মানজনক এবং বিরল বীরত্বের বহি:প্রকাশ ।অথচ আজকের অবহেলিত জনপদ চুয়াডাংগার কতিপয় বীর সন্তান সেই বিরল কৃতিত্বের কাজটি জীবনের বিনিময়ে করে দেখিয়েছিল।সেই ৮ বীর সন্তান হলেন-চুয়াডাঙ্গার মোমিনপুর গ্রামের সিদ্দিক আহমেদের ছেলে রবিউল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা শহরের মাঝেরপাড়ার মৃত বজলুর রহমানের ছেলে আবুল কাশেম, চুয়াডাঙ্গা শহরের শেখপাড়ার মৃত মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে আলাউল ইসলাম খোকন, আলমডাঙ্গার রোয়াকুলি গ্রামের মৃত রহিম মণ্ডলের ছেলে কিয়ামুদ্দিন, আলমডাঙ্গার গোকুলখালী গ্রামের মৃত ইয়াকুব হোসেনের ছেলে হাসান জামান, আলমডাঙ্গার বটিয়াপাড়া গ্রামের মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে রওশন আলম, মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের রমজান আলীর ছেলে আফাজ উদ্দিন ও কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার কাষ্টদহ গ্রামের মৃত মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে খালেদ সাইফুদ্দিন আহমেদ তারিক। ৮ শহীদের মধ্যে একমাত্র তারিককে দেয়া হয় বীরবিক্রম খেতাব। এ ৮ শহীদের লাশ পাকহানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর মাঠে এনে দু’টি গর্তে মাটিচাপা দেয়।তারপর কালের অতলে অনেকটা চাপা--ই পড়ে গিয়েছিল আমাদের এই বীরত্বগাথাঁ। ।অবশেষে ৯০-এর দশকে চুয়াডাংগার কৃতি সন্তান , শক্তিমান সাহসী সাংবাদিক রাজিব আহমেদ "সম্মুখ সমরে" নামে একটি গ্রন্হ প্রকাশ করেন --যা ঐ যুদ্ধের একটি প্রামাণ্য দলিল হিসাবে কাজ করে ।বইটি প্রকাশের সাথে সাথে সর্ব মহলে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করে । যার প্রেক্ষিতে ওই গণকবরের ওপরই মেহেরপুর এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ১৯৯৮ সালে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে এক একর জমির ওপর নির্মিত হয় এই স্মৃতিসৌধ। বলাযায়, এখানে আমাদের এক প্রকার যাত্রাবিরতি হল। আমরা সবাই এখানে নেমে প্রথমে শহীদদের আত্বার মাগফেরাত কামনা করলাম। তারপর সংগ্রহে রাখার উদ্দেশ্যে কিছু ছবিও সংগ্রহ করলাম । সোহান ও মুকুট একটা গভীর নলকুপ পেয়ে সাথে সাথে খাবার পানি সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আমাদের ড্রাইভার শফিকুল ভাই অত্যান্ত চৌকস মানুষ বলা যায় উনি একজন দক্ষ টুরিষ্ট গাইড। তাই উনার কথামত আমরা এবার বল্লভ পুর মিশনারীতে যাবার সিদ্বান্ত নিলাম । প্রায় ৩৫ মিনিট যাত্রা বিরতির পর আমরা আবার চলতে শুরু করলাম
(টেকনিক্যাল জটিলতার কারণে অনেক ছবি আপলোড করতে পারলাম না , পরবর্তীতে অবশ্যই করবো )
------------ ----(চলবে---)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





