নক্ষত্রের ঘূর্ণিপাক--(পর্ব-০১)-এর লিংক --
১ম পর্ব
-দ্বিতীয় পর্ব :-
সময় মানুষের বিশ্বাস ও দর্শন পাল্টে দিতে পারে । মাকসুদ সাহেবের এক সময় ধারণা ছিল , পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উম্মুক্ত আবহ ও পরিবেশ দেশে সদ্য গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টিকরা অসম্ভব।বিগত দু'সপ্তাহে তার ধারণা অনেকখানি পাল্টে গেছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে যদি সঠিক সংযোগ ঘটে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে যদি প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের পিপাসা কাজ করে তবে যে কোন প্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষা লাভ করা সম্ভব।
ইট পাথরের অট্রালিকা নির্ভর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে অধ্যাপক সাহেব তার বিগত জীবনের ফেলে আসা সময় গুলোকে বার বার অনুভব করতে লাগলেন। ক্লাশ শেষে অলস দুপুরে নিজের নতুন বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্টের চেয়ারে বসে তিনি ফিরে গেলেন জীবনের প্রথম কর্মস্থলে । দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অজপাড়াগায়ের এক জীর্ণ সরকারী কলেজ।রং চটা কলেজ বিল্ডিং। ভাংগা-চোরা চেয়ার টেবিল। কমনরুমে ব্রিটিশ আমলের শন্ডা মার্কা চব্বিশ ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশন।অনেক কষ্ট করে আর্টস ফ্যাকাল্টির পিওনটার নাম স্বরনে আনলেন। হেংলা, পাতলা পিওনটার নাম ছিল তোরাব আলী। সকাল ১০ টা বাজলেই হলুদ একটা ফ্রাস্কে করে চা খাওয়াতো।আর্টস বিল্ডিং এর দুই তলায় ছিল মাকসুদ সাহেবের রুম । সেখান থেকে পেছনে কুল কুল করে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ দেখা যেত । দ্বিপ্রহরের শুরুতে জেলে নৌকাগুলো পাল তুলে উজান দেশে রওনা দিত। পড়ন্ত দুপুরে প্রায়ই কানে ভেসে আসতো দরাজ কন্ঠের ভাওয়াইয়া গান। সব মিলিয়ে অপূর্ব এক গ্রামীণ জীবনের স্পর্শ ছিল সেখানে । সেই জীবনের উপর ভিত্তি করেই মাকসুদ সাহেব তার প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন---“জলজ উপাখ্যান”। জলজ উপাখ্যান এখন এপার বাংলার সমৃদ্ধ এবং শক্তিমান উপনাসের একটি। এই উপন্যাসের ভেতরে একটি কবিতাও ছিল। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন এরকম:---
ঠাকুরদা ছিলেন খেয়া ঘাটের মাঝি-
তাই আমার হাতে-ও তাল কাঠের বৈঠা;
মাঘ মাসের শেষে কপোতাক্ষ শীর্ণ হয়ে এলে
ঘাট পারানীর আট আনা উপার্জন-টা বন্ধ হবার পর
বাবার রেখে যাওয়া বুড়ো নৌকার পাটাতনে
আশঁটেমাখা দেহটা নুইয়ে শুধু উদাস চেয়ে থাকা।
কে যেন বলেছিলেন ঈশ্বর এখানে থাকেন না
আর থাকলেও বুঝি কৃপার ভান্ডার এখন শুন্য
তাই সারা রাত জাল ফেলেও পরের দিন উনুন জ্বলেনা
বাংলা লিংকের এ্যাডের মত বদলে যায় না দিন---
শুধু বদলে যায় দাম, হুহু করে বেড়ে যায় চৈতী আগুনের মত।
(-------------------------------------)
ঐ কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই একটি বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল।একবার ঝরে গাছটি একেবারে ঠিক গোড়া থেকে উপড়ে গেল। যে রাতে ঘটনা টা ঘটলো ঠিক সেই রাতেই কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন।সবাই বলাবলি করতে লাগলো কৃষ্ণচূড়া গাছটির সাথে উদ্ভিদ বিদ্যা সারের আত্বার যোগ ছিল। এ রকম অনেক ছোট-বড় স্মৃতি লতার মত আরো বিস্তৃত হতে পারতো কিন্তু তা আর হলোনা। আকিস্মক এক ছাত্রীর বিদ্যুত গতি সমৃদ্ধ আগমনে মাকসুদ সাহেবকেও সুপারসনিক স্পিডে বর্তমান সময়ে ফিরে আসতে হলো।
মেয়েটি শরীরে তার গতি বজায় রেখেই বল্লো –
: “স্যার , আমার নাম বর্ষা। আপনার ডিপার্টমেন্টের সেকেন্ড ব্যাচের ষ্টুডেন্ট। স্যার, আমি আপনার পড়ানোর কিছুই বুঝিনা। সার আমার মনে হয় আপনি ঠিকমত পড়াতে পারছেন না। আপনার ডেলিভারী সম্ভবত আমরা রিসিভ করতে পারছিনা। শুধু আমার নয় সার, ক্লাসের অনেকেরই সেইম প্লবলেম হচ্ছে কিন্তু এখনো কেউ আমার মত করে মুখ খুলেনি।“
এই গুরুতর অভিযোগকারিনীর নাম নূসরাত অফরোজ বর্ষা।লেখাপড়ায় যাকে মিডিয়াম না বলে নিম্ন স্তরের বলায় শ্রেয়। উচ্চমাধমিকের গন্ডি কোন রকম পেড়িয়ে ব্যাবসায়ী বাবার খায়েশ আর অঢেল টাকার বদৌলতে এখন এই ভার্সিটির ইংরেজী বিভাগে স্নাতক পড়ছেন। উপস্থিত বুদ্ধি না থাকলেও মেয়েটির কিছু বিশেষ বুদ্ধি স্রষ্টা দান করেছেন সেই সাথে উজাড় করে দিয়েছেন রূপ। বিশেষ বুদ্ধির মধ্য একটি হলো বড় বড় মানুষকে হঠাত কোন ভয়ংকর কথা বলে প্রথমত ভড়কে দেয়া, দৃষ্টি আকর্ষণ করা অত:পর নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করা । শুধু মাত্র এ দুটি গুণের কথা বলে থেমে গেলে বর্ষার চরিত্র অংকন একেবারেই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অপূর্ব বাচনভঙ্গী মেয়েটির, কিছুদিন ধরে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে অনিয়মিত ভাবে খবর-ও পড়ছেন। বিটিভিতে নজরুল সংগীতের তালিকাভুক্তি শিল্পীও হয়েছেন গত বছর । ইতিমধ্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বিজ্ঞাপনের মডেল হবার অফার-ও পেয়েছেন কিন্তু গ্রহন করেননি।সংবাদ উপস্থাপিকাদের মিডিয়াতে অনেক হিসেব করে পা ফেলতে হয়।
একেতো নতুন জায়গা, নতুন চাকুরী , নতুন সিলেবাস, নতুন মুখ তার উপর ভাবনাতে তিনি বর্তমান জগতে ছিলেননা তাই স্বভাবতই এ রকম আকস্মিক ও সংবেদনশীল প্রশ্নে অধ্যাপক মাকসুদ সাহেব একটু হতচকিয়েই গেলেন। মনে পড়ে গেল এখানে জয়েন্ট করার আগে আরেক বেসরকারী বিশ্ববিদালয়ের প্রভাষক বন্ধুবর সহিদুল করিমের উপদেশের কথা-“ ষ্টুডেন্ট ইজ অলেয়েজ রাইট”।নিজেকে কিচুটা সামলে নিয়ে খুব শান্ত অথচ আন্তরিকতা মেশানো কন্ঠে বল্লেন:--
--বর্ষা, বসো।তোমাদের আজকে যেন কি পড়ালাম ?
: স্যার, ডাব্লিউ বি ইয়েটস-এর কবিতার মূল থিম।
মুখে স্বভাবসুলভ হাসি ছড়িয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,
-- আচ্ছা তোমার কি বর্ষাকাল ভালো লাগে ?
: জ্বি না। একদম বাজে লাগে। বর্ষাকালে গায়ের ভেতর কেমন যেন ঘিন ঘিন করে।
--বৃষ্টি বা বৃষ্টি পড়ার শব্দ তোমার কাছে কেমন লাগে ?
: অসম্ভব ভালো লাগে স্যার!!!!!
-- ওয়েল। টোটাল ইংরেজী সাহিত্য টা যদি বর্ষাকাল হয়ে থাকে তবে ডাব্লিউ বি ইয়েটস এবং ডাব্লিউ বি ইয়েটস-এর কবিতা হলো রৃষ্টি বা বৃষ্টির শব্দ। অর্থাৎ ডাব্লিউ বি ইয়েটস সবার কাছে ভালো লাগবেই , এটা ভালো লাগার-ই বিষয়। তবে হ্যা, যেহেতু আজকে টপিক্স টি প্রথম পড়িয়েছি তাই কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হতেই পারে। আগামীকাল যখন ইয়েটস-এর "নো সেকেন্ড ট্রয়" পড়াবো দেখবে এটা কতটা রসালো। তখন সব কিছু সহজ হয়ে যাবে। সো , ডোন্ট ওরি।।
সমস্ত মুখায়বে লজ্জিত ও অনুশোচনার ভাব এনে খুব বিনয়ের সাথে বর্ষা জানালো ,
: সেটাই তো সমস্যা, স্যার। স্যার, আপনাকে বলা হয়নি তবে আপনি হয়তো জেনে থাকতে পারেন ।স্যার, আমি একটু-আধটু মিডিয়াতে কাজ করে থাকি। আগামীকাল একটা জরুরী ওয়ার্কশপের কারণে ক্লাশে থাকতে পারবোনা , স্যার। স্যার, আমার কি হবে ???
এরকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অভ্যাস্ত মাকসুদ সাহেব । কিন্তু এখানে তো আগের মত কঠোর হলে চলবেনা, এটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। মাথার ভেতরে বন্ধুবর সহিদুল করিমের কথাটা স্বরনে রেখে মুখে হাসি হাসি ভাব করে অধ্যাপক তার ছাত্রীকে প্রত্যুত্তর দিলেন :
-- দ্যাটজ গ্রেটজ! ইউ আর জিনিয়াস!! কিন্তু বর্ষা, ক্লাশটা চেন্জ করি কিভাবে ?
ক্লাশ সিডিউলে চোখ বুলিয়ে অধ্যাপক সাহেব এবার ইউরেকা ষ্টাইলে বলা শুরু করলেন
--- আগামী পরশু তোমাদের ফাষ্ট ক্লাশটা অফ আছে । তাহলে ঐ দিন-ই তোমাদের ক্লাশটা নেয়া যায় ইন লিউ অফ ইয়েষ্টার ডে। তুমি একটু কষ্ট করে মেসেজ টা সবাই কে দিয়ে দাও। তাহলে কি প্লবলেম সলভ হলো ?
বর্ষার সমস্ত দেহ-মনে উদ্দশ্য হাসিলের গোপন আনন্দ খেলে গেল।
: মেনি মেনি থ্যান্কস , স্যার। তাহলে আমি মেসেজটা সবাই কে দিয়ে দেই ।
সালাম দিয়েই দ্রত গতিতে বের হয়ে গেল বর্ষা।
আসলে বর্ষা এখানে এসেছিল তার আগামী কালের অনুপস্থিতিতা যায়েজ করতে। পড়া বোঝা না বোঝা কোন কারণ নয়। এ সবই তার বহুদিনের পুরানো কৌশল। স্কুল জীবন থেকেই সে এসব কৌশল প্রয়োগ করতে করতে পাকা হয়ে গেছে। আজও তাই ভাল ভাবেই সফল হলো।।
বর্ষা চলে যাবার পর মাকসুদ সাহেব একা একা পাবলিক আর প্রাইভেট ভার্সিটির তুলনা মুলক চিত্র তৈরী করে ভাবতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন কর্মজীবনের চলমান অভিযোজনের যুদ্ধটা খুব বেশী সহজ হবেনা ।।
নগরীতে সন্ধ্যা নেমেছে। শহরের অভিজাত এলাকার আলীশান ভবনে বর্ষা তার গলা সাধার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হারমোনিয়াম হাতে নিয়েই অনেক্ষণ ধরে বর্ষা একটি মিষ্টি রাগ ভেজে নিল। এটা আশাবরী রাগের গগনপুরী ঘরানার একটি সুর। যারা নজরুল গায় তাদের জন্য এই রাগটি অনেক উপকারী। আরো কতক্ষণ সুর ভাজার পর এবার মনের অজান্তেই সে একটি গান ধরে ফেল্লো :
"মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর
নম: নম: নম: নম: নম: নম:
শ্রাবন-ও মেঘে নাচে নটবর
রমোঝমো রমোঝমো রমোঝোমো"
তার নিজের কাছেই আজ কণ্ঠটা কেমন জানি দরাজ মনে হতো লাগলো। অনুরাধা পাডোয়ালের কন্ঠের মত একটা ষ্ট্রংনেস ফ্লেভার খুজে পেল। দ্বিতীয় অন্তরায় যাওয়ার আগে হুট করে মনের ভেতর একটা প্রশ্ন খেলে গেল। মনোহর শব্দের সহজ বাংলা কি ? যে মন হরণ করেছে? প্রশ্নটা কাকে জিজ্ঞাসা করা যায় ? মাকসুদ স্যার কে করলে কেমন হয় ? কিন্তু উনার সেল নম্বর তো জানা নেই । ভাবতে ভাবতে হারমোনিয়ামের স্কেলটা এক ধাপ উপরে নিয়ে আবার গাইতে শুরু করলো বর্ষা ।
ব্যস্ততম নগরীর লাল-নীল, সুখ-দু:খের মায়াবী সন্ধ্যার সব প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে অনাদী কালের সেই মোহময়ী সুর ভেসে ভেসে বেড়াতে লাগলো ।।।।
(অসমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




