মাইনাস টু তত্ত্ব নিয়ে আবারো সরব হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে যখন সংলাপের সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না, তখন এ তত্ত্ব নিয়ে সক্রিয় প্রেসার গ্রুপ। প্রকাশ্যেই তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বলছেন, গ্রামের মানুষ দুই নেত্রীর কাউকেই চায় না। নাগরিক সংগঠনের ব্যানারে কথা বলছেন তারা। দেশের প্রধান দুই দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র বাইরে নতুন ধারার রাজনীতি সৃষ্টির সময় এসেছে বলেও জোর আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন তারা। প্রেসার গ্রুপ হিসেবে প্রথমে গঠন করা হয় নাগরিক আন্দোলন। এরই আরেক রূপ হচ্ছে নাগরিক ঐক্য। ‘আমরা ভীষণ রাজনৈতিক সঙ্কটে আছি। এ সঙ্কট সমাধানে দুই ভদ্রমহিলার (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) সংলাপ দরকার। গ্রামের মানুষ দুই নেত্রীর কাউকেই চায় না।’ গত ১ জুন রাজধানীতে নাগরিক ঐক্যের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক উপরিউক্ত মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, অধ্যাপক পিয়াস করিম, বামপন্থী রাজনীতিক আবদুল্লাহ সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গঠিত ‘নাগরিক আন্দোলন’-এর সঙ্গে এরা সবাই যুক্ত। সমাবেশে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘নাগরিক আন্দোলন’ বুদ্ধিভিত্তিক ও ‘নাগরিক ঐক্য’ ময়দানে লড়াই-সংগ্রাম করবে।
শুধু সংলাপের জন্য চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যেই কি তৃতীয় কোনো শক্তির উত্থান ঘটাতে চাইছেন তারা? এ প্রশ্ন উঠেছে। কেননা অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের চিন্তা-চেতনায় ‘মাইনাস টু তত্ত্ব’ রয়েছে।
চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট কাটাতে না পারলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। এমন কথা নাগরিক সমাজের মুখপাত্ররাই বলছেন তা নয়, বলছেন অনেক রাজনীতিকও। ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে থাকা না থাকা নিয়ে যেমন একটি মহল কথা তুলেছিল সেই আদলে তারা আবারও সক্রিয়। তখন প্রকাশ্যে তারা বলেছে, ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে।’ সুর একটু ভিন্ন হলেও একই প্রসঙ্গ নতুন করে আসছে। এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, মাইনাস টু ফর্মুলার ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যায়নি। তবে আরেক নেত্রী বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এ বিষয়ে এখনও সেভাবে কিছু বলেননি। অনেকটাই নীরব তিনি এ ব্যাপারে। তবে খোদ তার দলেরই নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা একটু ঘুরিয়ে কার্যত দুই নেত্রীকে মাইনাসের কথাই বলেছেন। এমনকি ৫ জুনের মধ্যে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের আহ্বান না জানানোর কারণে দল থেকে নাজমুল হুদা পদত্যাগ করেছেন। সম্প্রতি নাজমুল হুদার কথায় তার নেত্রীর ওপর এক ধরনের প্রেসার প্রদানের পাশাপাশি তিনি দুই নেত্রীকে সরে যাওয়ার কথাও প্রকাশ্যে বলেছেন। শুধু বিরোধী দলই নয়, নানা মহলই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সমালোচনা করছে। সরকার ব্যর্থ হয়েছে দাবি তুলছে বিরোধী দল। সরকারের ভেতরে থাকা মহাজোটের কোনো কোনো শরিকও বিরোধী দলের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে। কিন্তু ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা যায় কীভাবে, সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার পথ কেউ দেখাতে পারছেন না।
সরকার এবং বিরোধী দলও সংলাপের কথা বলছে। তবে বিরোধী দল শর্ত দিয়ে সংলাপে বসতে চায়। সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করেন সংলাপে কোনো সমাধান হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারা বলেছেন, বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।এই যখন পরিস্থিতি তখন তৃতীয় পক্ষ নড়েচড়ে বসছে। নাগরিক সমাজের দাবি দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দুই নেত্রী সংলাপে না বসলে সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু নাগরিক সমাজের কেউ এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন না। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন হাইপ্রোফাইল দুই বিশ্বনেতা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আর ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী। তারা প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে বৈঠক করে সংলাপের তাগিদ দেন। একই তাগিদ দেন ঢাকায় ইউরোপিয়ান কূটনীতিকরা। রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের ধারনা, সেই ইঙ্গিতেই দুই নেত্রীর সংলাপের কথা জোর দিয়ে বলছেন নাগরিক সমাজ। ১ জুনের নাগরিক ঐক্যের সমাবেশে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, মানুষ চায় সৎ লোক; যার গায়ে কোনো গন্ধ নেই। এ সময়ে এমন লোককে নির্বাচন করতে পারলে দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। না হয় পরিস্থিতি আরও নিচের দিকে নামবে।
সরকারের সমালোচনা, দুই নেত্রীকে মাইনাস ষড়যন্ত্র আর তৃতীয় শক্তির উত্থান সম্ভাবনার জবাব দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২ জুন গণভবনে কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, কিছু লোকজনের ভাগে কম পড়ছে বলে তারা সরকারের সমালোচনা করছেন। তিনি আরো বলেন, যারা দেশের ভালো চান না, তাদেরই এত হা-হুতাশ। অনেকে আছেন যাদের জনগণ ভালো থাকলে ভালো লাগে না, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের পছন্দ নয়, তারা সব সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে অভ্যস্ত। এ সময় প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমের টক-শো এবং সংবাদপত্রে প্রতিদিন সরকারের বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন।
২৭ মে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা অধিবেশনে যোগ দেয়নি। রাজপথে পুলিশ নির্মমভাবে সাংবাদিক পিটিয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিক নাজেহাল হয়েছে পুলিশের হাতে। বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের কোনো ইস্যুতে ন্যূনতম ঐক্য গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু দিনে দিনে দূরত্ব বাড়ছে। এ পরিস্থিতিকে মোটেও গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক মনে করেন না সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যখন বিপন্ন, তখন ধরে নিতে হবে গণতন্ত্রও বিপন্ন। তিনি সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে রাজনৈতিক উদ্যোগ আশা করেন। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতে, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে, সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে এ দেশের বিরোধী দল ব্যর্থ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্বল। তিনি বলেন, যে কোনো ইস্যুতেই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ হতে পারে। তবে তা পূর্বশর্ত দিয়ে নয়। আর সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনে করেন, এখনও সংলাপের সময় হয়নি। আর সংলাপ করে কোনো সমাধান অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে কোনো সুফল আসবে না।
মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ মনে করেন, সরকার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এ সরকারের বিকল্প কোনো অনির্বাচিত সরকার হতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার ঘোর বিরোধী এইচ এম এরশাদ। সরকারের আরেক শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মনে করেন, গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। একই দাবি জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর। তিনি বলেন, যে মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে তখন তা বানচাল করতে, গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র তো হতেই পারে। দুই নেতা মনে করেন গণতান্ত্রিক শক্তি ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থাই কেবল পারে এসব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। সরকারের বাইরে থাকা বাম গণতান্ত্রিক শক্তি সিপিবি মনে করে, সাংবাদিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ঘটনা দেশকে গভীর সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রতিহত করতে জামায়াত দেশি-বিদেশি চক্রের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করছে। আর পুলিশের সাংবাদিক পেটানো ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ স¤পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তবে সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে বেকায়দায় ফেলে অজনপ্রিয় করতে চাইছে সরকারকে;এটা গণতন্ত্রের জন্য মোটেই শুভ নয়।
সূত্র:

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




