somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘তখন নিয়াজির চোখে পানি ঝরছিল’

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১১ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিকে ভারতের ফোর্বস ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনের অনলাইনে জেনারেল জ্যাকবের ছোট একটি সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, পুরো সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হবে ১৫ জুলাইয়ের মুদ্রিত সংস্করণে। সে সময় মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বাংলাদেশে। সম্মাননাবিষয়ক জাতীয় কমিটিও বিদেশি বন্ধুদের নাম ও অবদান যাচাই-বাছাই করছিল এবং ওই কমিটির সম্মাননাপ্রাপ্যদের তালিকায় নাম ছিল জেনারেল জ্যাকবের। সাক্ষাৎকারটি বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশের জন্য কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে ফোর্বস ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এর সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত অনুমতি দেন।

২০১১ সালের ১০ জুলাই কালের কণ্ঠ’র প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটির উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের অভিযানে আপনার ভূমিকা এত বছরেও মূল্যায়ন হলো না। কেন এমন হলো?

উত্তর : আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমাকে একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, আমি তাই করেছি। কৃতিত্ব অন্যরা কেড়ে নিয়েছে। তবে অনেকেই আমাকে অবিরাম চাপ দিয়ে যাচ্ছে, যেন প্রকৃত ঘটনাটি আমি লিখে ফেলি। তাই আমি আমার প্রথম গ্রন্থ ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ (ঢাকায় আত্মসমর্পণ) প্রকাশের আগে ৩৫ বছর অপেক্ষা করেছি। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ (১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাপ্রধান) ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরা (ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান) যখন জীবিত ও সুস্থ ছিলেন তখন আমি তাঁদের আমার গ্রন্থের কপি দিয়েছিলাম। তাঁদের কেউই আমার লেখার কোনো প্রতিবাদ পাঠাননি।

প্রশ্ন : স্যাম মানেকশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

উত্তর : মানেকশর প্রতি আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা আছে। তিনি সেনাবাহিনীর মানসম্মান রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে অভিযানের বিষয়ে তাঁর আর আমার চিন্তার মধ্যে ভিন্নতা ছিল। সরকার (ভারত) এপ্রিল মাস থেকে তাঁকে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। আর তিনি তাগিদ দিচ্ছিলেন আমাকে। আমি এ ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম এবং তাঁর কাছে কিছু যৌক্তিক কারণ তুলে ধরেছিলাম। তিনি আমার কাছে সেগুলোর একটি সারসংক্ষেপ চেয়েছিলেন এবং পরে আমার দেওয়া সারসংক্ষেপটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পড়ে শোনানো হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, প্রথমে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া উচিত। কিন্তু মানেকশ বললেন, ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বাংলাদেশে প্রবেশের বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আমি এর প্রবল বিরোধিতা করি। ঢাকা হলো ক্ষমতার কেন্দ্র, আর যুদ্ধে সবাই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। মানেকশ আমাদের একটি আদেশ পাঠিয়েছিলেন, যাতে উল্লেখ ছিল—‘এই, এই সময়ের মধ্যে তোমরা ওইগুলো (তালিকায় উল্লিখিত শহরগুলো) দখল করবে।’ ওই তালিকায় ঢাকা ছাড়া প্রতিটি শহরের নাম ছিল! আমরা যাতে আদেশটি উপেক্ষা করতে না পারি সে জন্য তিনি (মানেকশ) তিনটি কোরকে ওই আদেশের কপি পাঠান। তাদের (তিনটি কোর) সঙ্গে আমার কথা বলতে হয়েছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, আদেশটি অগ্রাহ্য করতে। আমাকে আদেশগুলো অগ্রাহ্য করতে হয়েছিল।

প্রশ্ন : পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ করাতে আপনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।

উত্তর : মানেকশ আমাকে ফোন করলেন এবং বললেন, ‘জ্যাক, যাও এবং ওদের (পাকিস্তানি বাহিনী) আত্মসমর্পণ করাও।’ আমি বললাম, ‘তিন দিন আগে আত্মসমর্পণবিষয়ক একটি দলিলের খসড়া আমি আপনার কাছে পাঠিয়েছি। আমি কি ওদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে পারি?’ মানেকশ আমাকে শুধু বললেন, ‘কী করতে হবে তা তুমি জানো।’ আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়া নিয়ে আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের তৎকালীন প্রধান) সঙ্গে বৈঠক করতে যাই। বৈঠকে নিয়াজি বলেন, আত্মসমর্পণ নয়, কেবল অস্ত্রবিরতির বিষয়ে আলোচনা করতেই তিনি এসেছেন। আমি তাঁকে এক পাশে নিয়ে যাই এবং বলি, তাঁরা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে আমি তাঁদের পরিবারগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারি। আমি তাঁকে ৩০ মিনিট সময় দিয়ে বলেছিলাম, আমরা যদি এ সময়ের মধ্যে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারি তাহলে আবার যুদ্ধ ও বোমাবর্ষণ শুরু হবে। এর পরপরই মনে মনে ভাবছিলাম, আমি এটা কী করেছি? তারা যদি আত্মসমর্পণে রাজি না হয় তাহলে আমি কি-ই বা করতে পারি? আমার হাতে কিছুই নেই। নিয়াজির ২৬ হাজার ৪০০ সৈন্য ছিল। আমাদের ছিল মাত্র তিন হাজার। ওটাই সম্বল।

প্রশ্ন : নিয়াজির নমনীয় হয়ে পড়ার কারণ কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : আমি জানি না। আমি পাকিস্তানের একটি প্রতিবেদন থেকে কেবল উদ্ধৃতি দিতে পারি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমি যখন নিয়াজির উত্তরের অপেক্ষায়, তখন তিনি শান্তভাবে পাইপ টানছিলেন। আমি শান্তভাবে ধূমপান করতে পারছিলাম না! কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অরোরার আসার কথা। সন্ধ্যায় অস্ত্রবিরতির সময়সীমাও শেষ হবে। তাই আমি সাহসী মুখ নিয়ে নিয়াজির কাছে ফিরে গেলাম। আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়াটি নিয়ে আমি তাঁকে বললাম, ‘আত্মসমর্পণে রাজি আছেন বলে আমি ধরে নিচ্ছি।’ নিয়াজি কোনো উত্তর দিলেন না, সামান্যতম আপত্তিও জানালেন না। তিনি চোখ বড় করে তাকালেন। তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। নিয়াজি অবশ্য পরে বলেছেন, ‘আমি জ্যাকবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। জ্যাকব আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন।’ নিয়াজির উত্তরের অপেক্ষা করার সময় আমি কী ভাবছিলাম সে সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণাই নেই। ধরুন, আমি যদি ব্যর্থ হতাম? মনে মনে ভাবছিলাম, আমি ব্যর্থ হলে ওই জেনারেলরা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হবেন। আমি একা। আমি ব্যর্থ হইনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চূড়ান্ত করেননি এমন একটি খসড়ার ভিত্তিতেই আমি পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে রাজি করাতে পেরেছি।

প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনার ভূমিকাকে সরকার স্বীকৃতি না দেওয়ায় আপনি কি কষ্ট পান?

উত্তর : আমার ওপর কোনো ধরনের অবিচার হয়েছে বলে আমি মনে করি না। এমন কোনো পুরস্কার চাই না, যা পাওয়ার জন্য আমাকে যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়নি। স্বীকৃতি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। আমি পদক-শিকারি (মেডেল-হান্টার) নই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৫০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×