পর্ব---০১
*******************
রাত দুপুরে হুট করে সিগারেটের নেশা পেয়ে বসলো মাকসুদ সাহেবের। ওয়ারড্রবের ভেতরে গোল্ডলিফের পুরো প্যাকেটও আছে, কিন্তু সমস্যা সেটা না । সমস্যা হলো দেয়াশলাই আছে নীরার রুমে; কে জানে মেয়েটা হয়তো মাথার নীচেই দেয়াশলাই রেখে ঘুমিয়েছে।রাতে ঘুমাবার সময় সময় মাকসুদ সাহেব নীরাকে মশার কয়েল ধরাতে দেখেছেন। এত রাতে নীরার দরজা ধাক্কানো কি ঠিক হবে ?অতি সঙ্গোপনে মাকসুদ সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠলেন, সিগারেটের প্যাকেট টা হাতে নিলেন।পুরো ২২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্লাট।টানা লম্বা বারান্দা।নীরার দরজার সামনে দিয়েই বারান্দায় যেতে হয়।ধীর লয়ে যেতে যেতে মাকসুদ সাহেব নিশ্চিত হলেন নীরার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।বাধ্য হয়ে বারান্দায় বসে গ্রীলের ফাক দিয়ে রাতের আকাশ দেখতে লাগলেন দেশের এই সময়ের জনপ্রিয় লেখক । এক সময় তিনি বারান্দায় পায়চারী শুরু করলেন। সবে মাত্র কয়েক পাক ঘুরেছেন এমন সময় নীরা ম্যাচ হাতে হাজির হলো । "বাবা, এই নাও তোমার ম্যাচ। তুমি দেশের একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক,লেখক। সামান্য একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে জয়েন্ট করবা তাই নিয়ে সারা রাত টেনশন করছো ? এটা তোমাকে মানায় না। সিগারেট শেষ করে ঘুমাতে যাও, ঠান্ডা লেগে যাবে।গুড নাইট।"
মেয়ের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞ মাখানো ভাষায় কোন রকম উত্তর দিলেন --"গুড নাইট।"
অধ্যাপক সাহেব সিগারেট ধরিয়েই খুব লম্বা একটা টান দিলেন।নিমিষেই মস্তিষ্কের সমস্ত নার্ভ গুলো নিকোটিনের সংস্পর্শ পেয়ে নেচে নেচে উঠলো।সিগারেটের দ্বিতীয় টানটাও যথাসম্ভব দীর্ঘ করে দিয়ে তিনি ভাবলেন--- আগামী কাল নতুন ভার্সিটিতে জয়েন্ট করতে যাচ্ছেন, মনের ভেতর বিচিত্রতর অনুভুতি হচ্ছে। আচ্ছা, এটা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখে ফেল্রে কেমন হয় ? কিন্তু এক রাতের সামান্য কিছু অনুভব নিয়ে পুরো একটা উপন্যাস লেখা কি সম্ভব? অবশ্য এর আগেও তিনি এরকম একটি রাতের উপর উপন্যাস লিখে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। অত্যান্ত হাল্কা ঢং-এ লেখা সে উপন্যাসে পরবর্তীতে সবাই নাকি পুরো বাংলাদেশের চিত্র খুজে পেয়েছিলেন। ইদানিং মাকসুদ সাহেবের কাছে মনে হচ্ছে তিনি এতদিন জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে পাঠকদের ঠকিয়েছেন।একচেটিয়া ভাবে হালকা মানের উপন্যাস লিখে যাওয়া কোন ভাল সাহিত্যিকের কাজ নয়। একেকটা উপন্যাসের পেছনে অনেক পরিশ্রম থাকতে হয় হবে তবেই সেটা গুরু গম্ভীর কূলীন ঘরানার উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। শরঃচন্দ্র, বন্কিম, তারাশংকর, নিমাই ভট্রাচার্য প্রভুত কালজয়ী লেখকেরা তো এভাবেই লিখে গেছেন। আজ হঠাৎ করে অধ্যাপক সাহেবের কাছে মনে হচ্ছে তিনি তার প্রতিভার বেশীরভাগ-ই অপব্যয় করেছেন স্বস্তা জনপ্রিয়তা ও টাকা পয়সা রোজগারের মত অহেতুক জিনিসের পেছনে । ইচ্ছে করলেই তিনি অনেক গভীর সাহিত্য রচনা করতে পারতেন কিন্তু করা হয়নি। তবে আর সময় ক্ষেপন নয় , এখন থেকে তিনি লেখা শুরু করবেন। কূলীন লেখকেরা শুধু একপেশে লেখা লিখে ক্ষান্ত থাকেন না , সকল বিভাগেই লেখেন। মাকসুদ সাহেব তার বর্ণাঢ্য লেখা লেখির জীবনে কখনো ঘটা করে কবিতা লেখেননি , গদ্যই লিখেছেন সবসময়।আজ কেন জানি হৃদয়ের ভেতর থেকে কবিতা লেখার তাগিদ অনুভব করছেন।লেখার টেবিলে বসেই দু'লাইন লিখেও ফেল্লেন :--
রাত্রির গর্ভে রাত্রি ঘুমায় অসম্ভব মৌনতায়
নির্জনতার হিমাগারে আশ্রয় খোজে ধরণী
কিন্তু তৃতীয় লাইনের জন্য স্থবীর হয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। গদ্য লেখার সময় আটকে গেলে যে রকম পায়চারী করেন কবিতা লেখার সময় ঠিক সেরকম পায়চারী করলেন না । এক সময় অধ্যাপক সাহেবের ভেতর থেকে তৃতীয় লাইন চলে এল। তিনি লিখলেন ---
"রাত্রির গর্ভে রাত্রি ঘুমায় অসম্ভব মৌনতায়
নির্জনতার হিমাগারে আশ্রয় খোজে ধরণী
জেগে আছি আমি একা , কে তুমি তন্দ্রাহরণী ????"
লেখার পর কয়েকবার কবিতাটি পড়লেন।শেষের লাইন টা কেন লিখলেন তিনি নিজেই কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না । এই বয়সে তন্দ্রাহরণী আবার কোথার থেকে আসলো ? বিছানায় ২৪ বছরের সংসার করা বউ এই মাত্র রেখে এসেছেন। মাকসুদ সাহেব ধারণা করলেন কোন অজ্ঞাত কারণে তার উপর রোমান্টিজম এসে ভর করেছে।তারাশংকরের কবি উপন্যাসে নিতাইয়ের উপর হঠাৎ হঠাৎ করে যেমনটি ভর করতো ঠিক তেমন কোন ব্যাপার হবে। কিন্তু নিতাইয়ের তো বসন্ত ছিল তার তো এরকম কোন মেয়ের সাথে আদৌ পরিচয় হয়নি সখ্যতা তো দুরের কথা। কে জানে ? হয়তো অচেতন মনে সে রকম কারো কথা ভাবনায় এসেছে হয়তো। মাকসুদ সাহেব লেখার ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলেন। সমস্ত চরাচরে হঠাৎ নিকষ অন্ধকার নেমে এল। চারিদিকে সুনসান নীরবতা আর গহীর অন্ধকার ; এরকম একটি মুহুর্ত তিনি প্রাণভরে অনুভব করতে লাগলেন। হয়তো এরকম অন্ধকার দেখেই কোন এক গীতিকার লিখেছিলেন ----
"অন্ধকারের অন্তরে আজ অশ্রু বাদল ঝরে "
মাকসুদ সাহেবের মস্তিষ্কে কবিতার শব্দরা খেলা করতে লাগলো । তিনি মনে মনে শব্দ বুনন করে যেতে লাগলেন । আগের কবিতার আরো দু'টি লাইন তিনি বুনে ফেল্লেন -----
"রাত্রির গর্ভে রাত্রি ঘুমায় অসম্ভব মৌনতায়
নির্জনতার হিমাগারে আশ্রয় খোজে ধরণী
জেগে আছি আমি একা , কে তুমি তন্দ্রাহরণী ?
দূর নক্ষত্রের সাথে যদি তোমার মিতালী হবে
তবে চীরকাল কি তুমি ঐ দূর আকাশেই রবে ?
(চলবে ......)

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





