স্থানঃ আই এস আই হেড কোয়ার্টার,আবপাড়া,সাহরা ই সোরোয়ার্দি,ইসলামাবাদ।
রেকর্ড উইং শাখা।
সময়ঃ২৯ নভেম্বর ২০১১,সন্ধ্যা ৬.০০
নিজের সামনের কাচের টেবিলে ধুলায় ধুসর পুরানো কিছু ফাইল দেখছেন আই এস আইর রেকর্ড উইং এর কর্নেল আশফাক দুররানি.. আই এস আই এর ২৫ বা তদোউর্ধ বছরের পুরানো সদ্য ডি-ক্ল্যাসিফাইড করা ফাইলগুলি ধংস করার আগে একবার চোখ দেখার ইচ্ছা এবং অনুমতি দুই আছে তার...তবে ফাইলের চাইতে অফিসের এক কোনে রাখা সনির এল সিডি টিভি মনিটরের দিকে তার নজর বেশি পড়ছে...কর্নেল একজন ক্রিকেট পাগল মানুষ...শত কাজের ব্যাস্ততা সত্যেও পাকিস্তানের খেলা থাকলে মিস করেন না...খেলা হচ্ছে পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশ..টি ২০ ম্যাচ, ঢাকাতে...পাকিস্তান খুব ভালো অবস্থানে আছে..পাকিস্তানের ১৩৫ চেজ করতে নেমে ৬৮ রানে বাংলাদেশের ৮ জন ব্যাটসম্যান নাই..স্টেডিয়ামে উৎসবমুখর পরিবেশ..!.. দর্শকদের মধ্যে বেশকিছু পাকিস্তানের পতাকা গালে একে দলকে সমর্থন দিচ্ছে..কেউ উদ্দাম উল্লাসে পতাকা উড়াচ্ছে...ক্রিকেট মাঠের একটা স্বাভাবিক দৃশ্য..
কিন্তু তার অনুসন্ধানি চোখে যে জিনিসটা ঠিক খাপ খাচ্ছে না তা হলো স্টেডিয়ামে এতো পাকিস্তানী সমর্থক!!! কোথা থেকে আসলো..এরা!! গোয়েন্দা অফিসার হিসাবে তার জানা আছে যে ঢাকায় এতো সংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিক নাই..এবং যারাও বা আছে তাদের বেশিরভাগ নিজের ব্যবসা আর পেশ নিয়ে এতো কন্সার্ন যে স্টেডিয়ামে গিয়ে বাংলাদেশের সাথে টি ২০ ম্যাচ উপভোগ করার সময় তাদের নাই..তিনি আবারো কিছুটা বিস্ময়ের সাথে বিড়বিড় করে নিজ মনেই বললেন এতো পাকিস্তানী সাপোর্টার ...তাও হোম টিমের সাথে?
ভাবতে ভাবতে তিনি সামনে রাখা একটা ফাইল টেনে নিলেন..ফাইলে উপরে ইংরেজিতে লাল কালি দিয়ে লেখা "ক্ল্যাসিফায়েড সিরিয়াল নং-১৯৭১১২১৬"।..ফাইল খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি...
পহেলা পৌষের সকাল,সময়কাল ১৯৭১সাল
স্থানঃ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট,টাইগার্স ডেন,মাশরেকি পাকিস্তান
পরিস্থিতঃ মিরপুর ব্রিজের মুখে মিত্র বাহিনী...আকাশে চক্কর দিচ্ছে ভারতীয় বিমানসেনার মিগ২১...মিগগুলির দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলার ভঙ্গিতে কটকট আওয়াজ তুলে গুলি ছুড়ছে বিমান বিধংসী অ্যাক অ্যাক কামান...।
জেনারেল নিয়াজির অফিসের বাইরে ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে আব্দুল কাদের মোল্লা...সাথে আপদমস্তক বোরকায় ঢাকা স্ত্রী দুই কন্যা পুত্রবধু...দীর্ঘ সময়ের চেস্টা তদবির আর লাইনে থাকার পড়ে আজ শেষ মুহুর্তে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে...আজ ডাক এসেছে ইমতেহানের...ওয়াতানের সামনে অনুগত্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষার..সারাটা জীবন তিনি পাকিস্তানের জন্য কি না করেছেন..বিশেষ করে এই গোলমালের আট মাস...নিজের অর্থ মেধা নৃশংসতা কুটবুদ্ধির সবটাই শেষ বিন্দু পর্যন্ত দিয়েছেন এমনকি তার ছেলের প্রান পর্যন্ত... হিন্দুস্তানী দুস্কৃতীকারিদের সাথে জঙ্গের ময়দানে শহীদ হয়েছে তার সন্তান। তবে আজ যা দিতে এসেছেন তার সাথে কোন কিছুর তুলনা চলে না...ইতিহাসে কোন পিতা কি এতো বড় কোরবানী দিয়েছে?
আসলে এখনইতো ইমতেহানের সময়..ইমানের জোর পরীক্ষার ওয়াক্ত...তাই আজ তার মনে একই সাথে সুতীব্র প্রত্যাশা ও একধরনের শংকামিশ্রিত গর্ব...ঢাকা পতনের আগেই তার পরিবারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবেতো?
যদিও সাথের ছোট মেয়েটাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসার সময় দরজার একটা পাল্লা শক্ত করে আক্রে ধরে যখন কাঁদছিলো তখন তার মত সাচ্চা পাকিস্তানীর মনেও কিছুক্ষনের জন্য একটু দ্বিধাদন্দের এসেছিল...দুরাগত বিস্ফোরনের আওয়াজে এক লহমায় তার ভ্রান্তি দূর হয়ে গেলো ... পাকিস্তানের হেফাজত করতে হবে...পাক সার জামিন এইখানেই শেষ হয়ে যেতে পারে না... আমরা হতে দিবো না..পাকিস্তান জিন্দা থাকবে আমাদের বংশধরদের মধ্যে...যতদিন লাগুক আবার চাঁনতারা কায়েম হবে এই ভুমিতে.. তাদের মত নিবেদিত প্রানদের এই কোরবানী বৃথা যেতে পারে না।
ভারী দরজা খোলার শব্দে তিনি কিছুটা চমকালেন..বোরকার ভিতর থেকে কে যেন মৃদু স্বরে ফুঁপিয়ে উঠলো...হয়তো ছেলের বউটা...
জেনারেলের এডিসি ভিতরে আসতে ইশারা করলেন... দরকায় দাঁড়ানো সেন্ট্রি শুধু তাকে থামিয়ে দিয়ে বাকিদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল..এডিসি উর্ধুতে বলল আজ আপনার এখানেই তাশ্রিব রাখতে হবে জানাব...খোদা পাকিস্তানের জন্য আপনার এই কোরবানি কবুল করবেন...এদের গর্ভ আবার একদিন সোনার বাংলায় পুর্ব পাকিস্তান অবশ্যই ফিরিয়ে আনবে.. ভিতর থেকে আবারো ফোপানোর আওয়াজ ভেসে আসলো..কাদের মোল্লা অস্ফুট স্বরে বললেন পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ!
চোখে সুরমা দিতে দিতে টাইগার নিয়াজি নিজেকে আয়নায় দেখছেন...বয়স বাড়লেও এখনো তিনি নিজেকে আকর্ষনিয় যুবা মনে করেন ..দুইদিনের এয়ার রেইড এর দুশ্চিন্তায় তার চোখের নীচে কালি জমা ছাড়া আর তেমন কোন সমস্যা নেই...তিনি মুক্তিদের নিয়ে চিন্তিত না ...আর ভারতীয় বাহিনীর জন্য এই আগমন তো শিক্ষা সফরের মত..পদে পদে তারা শিক্ষা নিতে নিতে আসছে.. সবচেয়ে বড় কথা এখনো পর্যন্ত ঢাকা ধরে রাখা গেছে..ঢাকাই আসল..আর মাত্র কয়েকদিন ধরে রাখতে পারলে গোটা পাকিস্তানের এর যুদ্ধ তিনি ইস্ট পাকিস্তানে বসে লড়বেন..হিন্দুস্তানী ফৌজ ঢাকায় প্রবেশের আগেই সপ্তম নৌ বহর বঙ্গোপসাগরে পৌছবে...জেনারেল গুল হাসানের সাথে তার সরাসরি কথা হয়েছে...
মধ্য জুনে নেয়া জেনারেল রাও ফরমানের একটা পরিকল্পনার কথা ভেবে টাইগার নিয়াজির বেশ হাসি পেলো..রাও ফরমানের মত কাটখোট্টা শুস্ক লোকের মাথা থেকে এমন রসালো পরিকল্পনা বের হতে পারে তা তার আন্দাজে ছিলো না..অবশ্য এর কাছাকাছি এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট নাতসীরা করার চেস্টা করেছিলো ১৯৪৫ এর দিকে...দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ে...। অ্যাডলফ হিটলারের স্পার্ম ঠান্ডা ভ্যাকুয়াম কন্টেনারে ভরে সংরক্ষন করে ফোর্থ রাইখের জন্য জমা রাখা...থার্ড রাইখের বেঁচে যাওয়া নারীদের মধ্য দিয়ে তিনি আবার ফিরে আসবেন পৃথিবীতে..। তবে রাও ফরমানের পরিকল্পনায় পাকিস্তানী অফিসারদের জন্য অনেক ভালো ব্যবস্থা রাখা আছে...কন্টেনারের বদলে সাচ্চা পাকিস্তানীদের সেচ্ছা অনুদান করা আওরত... সত্যি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিবেদিত প্রান ইস্ট পাকিস্তানের কিছু বিশ্বস্ত বাঙ্গালীরা দারুন সাহায্য করেছেন..কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের আত্মত্যাগ ..আনুগত্য তুলনাহীন... হিটলারের এস এস দের চাইতে কোন অংশে কম নয়..
শুধু যুদ্ধের ময়দানে গুলি খেয়ে উলটে পড়লেই আত্মত্যাগ হয় না..একটা মহান আদর্শ সংরক্ষনে আত্মত্যাগ অনেক ভাবেই করতে হয়..আর কে না জানে সারজামিনে পাকিস্তান শুধু একটা ভুখন্ড নয় এ এক আদর্শের নাম..।
এরপড় (মধ্যে কয়েকটা পাতা ছেড়া..আর কোন পাতা নেই)
সব শেষে একটা টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাঠানো এক লাইনের একটা কোডেড ম্যাসেজ ...১৬-১২-১৯৭১ লাল থামো নীল জয়ী হয়েছে...
ফাইল বন্ধ করে কর্নেল আশফাক চোখ তুললেন.. তার মুখে মৃদু হাসি দেখা গেল কি গেলো না..টিভিতে তখন স্কোর কার্ডে.. বাংলাদেশ ৮৫/৯-৫০ ওভার...রমিজ রাজা কমেন্ট্রি করছেন পাকিস্তান ৫০ রানে জয়ী...
স্টেডিয়ামে অনেকগুলি গোমড়ামুখের মধ্যেও পাকিস্তানের পতাকা হাতে বেশকিছু হাস্যোজ্জল গৌরবোজ্জল মুখ ...পাকিস্তানের জয় উজ্জাপন করছে...
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৫৭