somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যরচনাঃ লিচু চিকিৎসা

০৭ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার দুলাভাইয়ের গলায় মাছের কাঁটা ফুটেছে। স্ত্রীর পরামর্শে আট দশ বার দলা পাকানো শুকনো ভাত খেয়ে তাঁর পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, কিন্তু গলার কাঁটা নামেনি। এখন তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে আর কথা বলছেন না। মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন।
এমন হয়না যে, কোন কোনদিন বাড়িতে মেহমানের পর মেহমান আসতেই থাকে। সেদিন আমার বোনের বাড়িতে সেই অবস্থা। বোনের ননদ তার ছেলে মেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। সাথে তার বাগান থেকে পেড়ে আনা শ’খানেক লিচু। ভাইকে সে পরামর্শ দিল খোসাসহ লিচু গিলে খেতে। লিচুর খোসার সাথে আটকে মাছের কাঁটা পাকস্থলীতে চলে যাবে। দেশি জাতের দুর্বল চেহারার ছোট ছোট লিচু। তার মধ্যেও বেছে বেছে সবচেয়ে ছোট লিচুগুলো আলাদা করা হলো। কিন্তু এরকম গোটা দশেক লিচু খোসাসহ গিলে খেয়েও কোন কাজ হলনা। লিচু চিকিৎসা বিফলে গেল। দুলাভাই তাঁর বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন।

দুলাভাইয়ের এক কলিগ স্ত্রী পুত্রসহ বিকেল বেলা বেড়াতে এসেছেন। সে সময় মানুষের জীবন তো এত ফাস্ট ছিলনা। অফিস ছুটির দিন কলিগরা একে অন্যের বাসায় বেড়াতে যেতেন। দুলাভাইয়ের এই অবস্থা দেখে কলিগ ভদ্রলোক প্রায় আলোকবর্ষ গতিতে ছুটে গিয়ে মোড়ের এক হোমিওপ্যাথি দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে এলেন। সেই ওষুধ দু’ফোঁটা দুলাভাইয়ের গলায় ঢেলে দিয়ে তিনি বিজ্ঞের মতো বললেন, ‘আধা ঘণ্টার মামলা। যত শক্ত কাঁটাই হোক, গলে নেমে যাবে।’
ফলাফল শূন্য। আধা ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টা পরেও অবস্থা আগের মতো। দুলাভাই তাঁর কলিগের ওপর মহাখাপ্পা। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছেন না। কলিগ ভদ্রলোক এই দুই ঘণ্টায় অন্ততঃ কুড়ি বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন, কাঁটা নেমেছে কি না! দুলাভাই প্রথম দিকে মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিলেও এখন ভুরু কুঁচকে চুপচাপ বসে আছেন। বোঝা যাচ্ছে, কাঁটা যথাস্থানেই আছে।

পাশের বাসার প্রতিবেশী ব্যাংক অফিসার আমজাদ সাহেব খবর পেয়ে রাত ন’টার দিকে মসজিদের হুজুরের দেওয়া পানি পড়া নিয়ে এলেন। সাথে বেহেস্তি জেওর। পাতা উল্টে বেহেস্তি জেওরের একটা দোয়া বের করে দুলাভাইকে তিন বার পড়িয়ে তিনি হুজুরের পানি পড়া খাইয়ে দিলেন। এবার কেল্লা ফতে। কাঁটা নামবে না? কাঁটার বাপ নামবে।
কিন্তু কিছুই হলনা। দুলাভাই সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেন। রাতে ভাত খাননি। সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে যন্ত্রণায় চোখ মুখ কুঁচকে খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। যেখানে ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে, সেখানে নাস্তা খাবেন কিভাবে?

খবর পেয়ে আমি দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি, তিনি আমার ভাগ্নের আনা কবরেজি ওষুধ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন। আমার বোন বলল, ‘কাঁটা নামবে কি করে বল্ ? মানুষের অসুখ বিসুখ হলে আরো বেশি করে নামাজ কালাম দোয়া দরুদ পড়ে। আর তোর দুলাভাই নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে আছে। হুজুরের পানি পড়া এই জন্যেই তো কাজে লাগেনি।’
গলায় যাতে আঘাত না লাগে সেজন্য দুলাভাই শুধু জিব আর ঠোঁটের সাহায্যে স্ত্রীকে ধমক দিতে গিয়ে কি বললেন ঠিক বোঝা গেল না। তবে মনে হল তিনি বললেন, ‘বাজে কথা বলো না।’
আমি দুলাভাইকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে একজন ই,এন,টি স্পেশালিষ্টের কাছে নিয়ে যেতে রাজি করালাম। তিনি মুখে কিছু না বলে কাগজে লিখে শর্ত দিলেন যে, এবারও যদি কাজ না হয় তো তোর বোনসহ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি।
আমি বললাম, ‘আমার ভাগ্নে ভাগ্নিদের কি হবে? তারাও কি আমাদের সাথে যাবে?’
দুলাভাই কাগজে লিখে জানালেন, আমার সাথে মশকরা করছিস? ঠিক আছে, তোর ব্যবস্থা হবে।
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে দুলাভাই এক নম্বর কাজ সারার জন্য টয়লেটে গিয়ে দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন। চরম কোষ্ঠকাঠিন্য। সম্ভবতঃ লিচু চিকিৎসার ফল। খোসা ও বিচিসহ কেউ লিচু খায়?

ডাক্তার সাহেব সব ঘটনা শুনে তাঁর চেম্বারে বসিয়ে নানা রকম যন্ত্রপাতি দিয়ে দুলাভাইয়ের মুখ বোয়াল মাছের মুখের মতো হাঁ করিয়ে রেখে টর্চের তীক্ষ্ণ আলোয় গলার ভেতরটা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন। তারপর যন্ত্রপাতি খুলে ফেলে হাসি মুখে বললেন, ‘কাঁটা তো নেই।’
আমি বললাম, ‘কাঁটা নেই? তাহলে গলার ভেতর খচ খচ করছে কেন? খেতে গেলে ব্যথা করছে কেন?’
ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘কাঁটা ফুটে জায়গাটায় একটা ক্ষত হয়েছে। তার ওপর শক্ত ভাত, লিচুর খোসা এসবে ঘষা খেয়ে ক্ষতটা আরও বেড়ে গেছে। এখন ঢোক গিললে বা কিছু খেতে গেলে ব্যথা তো করবেই। আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। তিন দিন খাবেন, ভালো হয়ে যাবে। আর এই তিন দিন শক্ত কিছু খাবেন না। তরল ও নরম খাবার খাবেন। ঠিক আছে?’
ডাক্তার সাহেব এ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। দুলাভাই তিন দিন পর সত্যি সত্যিই সুস্থ হয়ে গেলেন। আমি কয়েকদিন পর তাঁকে দেখতে গেলে তিনি বললেন, ‘তোর বোনের মাথায় গোবর থাকলেও তোর মাথায় দু’এক ফোঁটা ঘিলু আছে। যা, এবারের মতো তোকে ক্ষমা করা হলো।’
আমি বললাম, ‘একশোটা টাকা দিয়ে ক্ষমা করলে ভালো হতো না?’
দুলাভাই খাট থেকে নেমে আমাকে চড় মারার ভঙ্গি করে বললেন, ‘যা ভাগ শালা।’
************************************************************************************************************
[এই লেখাটি মাসিক উত্তর বার্তা পত্রিকার এপ্রিল/২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।]
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:১২
৪০টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×