খরা ও মরুময়তার হুমকিতে বাংলাদেশ
আমিনুল ইসলাম সুজন
জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী। দেখা দিচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছাস, বন্যা, সাইক্লোন, টর্ণেডো। বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে বাতাস হয়ে পড়ছে শুস্ক, কমছে ভূ-উপরিস্থ সাধু পানির আধার বা জলাশয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং বালাদেশে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি।
ইতোমধ্যে দেশে অনেক জলাশয় ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার কিংবা ড্রেজিং এর অভাবে নদীর নাব্যতা ক্রমশ কমে গিয়ে অনেক নদী বৃষ্টির পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে, কোথাও কোথাও নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। যে কারণে বর্ষায় প্রায়শই বন্যা দেখা যায়। আবার এই একই কারণে, অর্থাৎ নদী নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হওয়ায় খরার প্রকোপও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, রাজশাহী-নওগাঁসহ বরেন্দ্র অঞ্চল শুষ্ক মৌসুমে প্রায় প্রতিবছরই খরায় আক্রান্ত হচ্ছে।
অধিক তাপমাত্রার পাশাপাশি নাব্যতা হারিয়ে নদী শুকিয়ে বিলীন হয়েছে, কিংবা মরা খালে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে দূষণ ও দখলের শিকার হয়েও ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের কাছাকাছি নদীগুলো দখল-দূষণে জর্জরিত। শহরের জলাশয়গুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে। এ চিত্র ঢাকায় যেমন, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য শহরেও তেমনিপ্রায়।
আরেকটি কারণে বাংলাদেশের নদী-খালগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। পদ্মা, তিস্ত, যমুনা নদীসহ শতাধিক বৃহৎ নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সীমান্তের ওপারে ভারত নদীর উপর বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে দেয়। বাংলাদেশের প্রায় সব বড় নদী যেহেতু ভারত হয়ে এসেছে তাই শুস্ক মৌসুমে এগুলোর উপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকালে বাংলাদেশের কৃষির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পানি প্রবাহমান ও প্রাকৃতিক উৎস। সে পানির গতিকে অন্যায়ভাবে ভারত আটকে রাখে। দুর্বল প্রতিবেশী হিসাবেই ভারত এ অন্যায় বছরের পর বছর করে যাচ্ছে। কোন সরকারই এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারেনি। এখানে ভারত সরকারেরও দৈন্যতা লক্ষ্যনীয়। ভারতের বাণিজ্যই মুখ্য বলে অনেকে মনে করেন। কারণ বাংলাদেশের কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা ভারতের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হব। আর যত বেশি নির্ভরশীল হব তত বেশি সুবিধা ভারত আদায় করে নেবে।
পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে ভারত বাঁধ উন্মুক্ত করে দেয়ায় বৃষ্টির পানিও বাংলাদেশে চলে আসে। তখন আবার সেটা বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি এ সময় পানির সঙ্গে পলি এসে নদীর নাব্যতাও ক্রমান্বয়ে কমেছে। যে কারণে সুবিশাল পদ্মা একদিকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বর্ষায় ভারত থেকে পানি আসার গতি নতুন নতুন গতিপথ তৈরি করে ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন করছে। ভারত সরকার নদীর উপর অন্যায়ভাবে বাঁধ দিয়ে প্রকৃতি তথা নদীর স্বাভাবিক গতি রুখে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি সমুদ্র বিজয় করেছে। আনন্দের কথা। কিন্তু সমুদ্রের চাইতে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা জয় অতীব জরুরি। কিন্তু এ বিষয়ে যাদের অতিতৎপর থাকা উচিত, প্রায়শই তাদের নীরবত লক্ষ্য করা যায়।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার”। বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশ এর সম্পর্কে প্রবাদটি প্রযোজ্য। দুর্বল প্রতিবেশী হওয়ায় ভারত অনেক অন্যায়ভাবে নদীর পানি আটকে দিচ্ছে। তারউপর বৃহত্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের খরা বৃদ্ধির পর ভারত এখন সিলেট অঞ্চলেও খরা ও মরুময়তার হুমকিতে পড়েছে। যদি ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে তবে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে পানি সঙ্কট দেখা দিবে, যা প্রকারান্তরে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোকে মরুময়তার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে ভারতকে বিরত রাখতে কূটনীতিক ও আইনগত, সবভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। গবেষক, কৃষিবিদ, পরিবেশবিদসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল মানুষই এই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিপক্ষে। কিন্তু কতিপয় সুবিধাভোগী বলা শুরু করেছে, টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের নাকি কোন ক্ষতি হবে না। এসব সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে রাখা উচিত। কারণ, বাধা সত্বেও ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের দিকেই এগুচ্ছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, যদি টিপাইমুখ বাঁধ হয় তবে ঢাকার কাছাকাছি এলাকা পর্যন্ত নদীর পানি লবনাক্ত হয়ে পড়বে। যা নোয়াখালী, লক্ষীপুর, কুমিল্লাসহ অনেক জেলার কৃষি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই যে কোন মূল্যে টিপাইমুখ প্রতিহত করতে হবে।
১৭ জুন আন্তর্জাতিক খরা ও মরুময়তা দিবস। ১৯৯৪ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দিবসটি ঘোষিত হয় এবং ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়ে আসছে। মূলত, খরা ও মরুময়তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন এবং খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে দিবসটি উদযাপিত হয়। এ বছর মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার কথা বলা হয়েছে। প্রতিপাদ্য হিসাবে বলা হয়েছে; “মানুষের জীবনের জন্য মাটির স্বাস্থ্য: ভূমির প্রাকৃতিক নিশ্চিত করি”।
এতে আরও বলা হয়, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা বাড়ছে। আগামী ২০ বছরে খাদ্যচাহিদা ৫০ভাগ বাড়বে, জ্বালানি চাহিদা ৪০ভাগ এবং পানির চাহিদা ৩৫ভাগ বাড়বে। বর্তমান সম্পদ বিবেচনায় এসব অতিরিক্ত চাহিদার যোগান দেয়া কঠিন। তাই যে কোন ভাবেই কৃষি জমি ধ্বংস রোধ করাকে গুরুত্ব দেয়ার আহবান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘ এ দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালনের আহবান জানালেও বাংলাদেশে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন হচ্ছে না। অথচ অনেক গুরুত্বহীন দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশে দিবসটির তাৎপর্যময় উদযাপন প্রত্যাশা করি।
আন্তর্জাতিক খরা ও মরুময়তা দিবস বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করুক। খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধসহ কৃষিজমি রক্ষায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় হোকÑএ প্রত্যাশা থাকল।