ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জলাশয় সংরক্ষণ আইনসহ প্রায় দুইশত আইন কোন না কোনভাবে জলাশয় দূষণ ও দখল প্রতিরোধ, সংরক্ষণ ও রক্ষা বা এ সম্পর্কিত বিষয় উল্লেখ করেছে। কিন্তু এসব আইন বাস্তবায়নও কোন একক সংস্থার কাছে না থাকায় আইনের বাস্তবায়ন শিথিলভাবে হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোন বাস্তবায়নই হচ্ছে না।
তাছাড়া দখল ও দূষণকারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শ আইন বাস্তবায়নে বাধার সম্মুখীন হয়। তাই ঢাকাসহ সারাদেশের পুকুর, লেক, খাল, নদী রক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার সর্বাগ্রে প্রয়োজন পাশাপাশি জলাশয় রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ আইন ও এর বাস্তবায়নে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করা দরকার।
ভারতের সেন্টার ফর সাইন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট এর যৌথ উদ্যোগে ধানমন্ডির বিলিয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী কর্মশালায় এ বক্তব্য উঠে এসেছে।
বক্তারা আরও বলেন, লেক, পুকুর, খাল, নদীসহ সব জলাশয় রক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পালন করলেও পূর্ণাঙ্গ কোন প্রতিষ্ঠান নাই। রাজউক, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কতৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ইত্যাদি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পালন করছে। এতগুলো প্রতিষ্ঠান থাকায় কোন প্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। যে কারণে এসব প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় কিংবা শুধু জলাশয় রক্ষায় স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি এখন সময়ের দাবি।
সকালে ঢাকার জলাশয় শিরোনামের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান। আলোচনা করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর উপদেষ্টা দেবরা ইফরমসন ও সিএসই’র সহ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সুস্মিতা সেনগুপ্তা।
সকালের অধিবেশনে রাজউক এর পক্ষে লেক ও জলাশয়কে ফোকাস করে ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বিষয়ক বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভিত্তি’র পরিচালক ইশতেহাক জহির তিতাস। বিদ্যমান জলাশয় ও লেকের ঝুঁকিসমূহ তুলে ধরে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইশারাত ইসলাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় জলাশয় রক্ষায় ইতিবাচক উদহারণ তুলে ধরে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডাব্লিবিবি ট্রাস্ট এর পরিচালক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম।
ড. ইশারাত তার প্রবন্ধে বলেন, লেকসহ সব জলাশয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নেয়া হয় না বলেই এসব দখল ও দূষণ হচ্ছে। অথচ মৎস চাষ, কৃষিকাজ, বিনোদন, ভূ-গর্ভের পানির স্তর স্বাভাবিক রাখা ইত্যাদি নানা প্রয়োজনে জলাশয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু তাৎক্ষনিকভাবে লাভবান হবার জন্যই এসব জলাশয়গুলো ভরাট করে দখল ও ভবন নির্মাণ চলছে। এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার।
এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তার প্রবন্ধে বলেন, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জলাশয় রক্ষায় আন্তরিকভাবে কাজ করলেও তাদের অভিজ্ঞতা না থাকায় সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে না। যে কারণে দেখা যায়, জলাশয় রক্ষা করতে গিয়ে তারাও জলাশয়ের ক্ষতি করে ফেলেন। তবু সাম্প্রতিক সময়ে সুনামগঞ্জ পৌরসভা, বরিশাল সিটি করপোরেশন স্থানীয় নদীর পাড়কে বিনোদনকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ঢাকার পাশ্ববর্তী নদী ও জলাশয়ের জন্য অনুকরণীয়।
ড. সারওয়ার জাহান বলেন, নগরে জলাশয় অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুকুর, খাল, নদী-এসব জলাশয় নগরের প্রাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জলাশয় না থাকলে নগরের তাপমাত্রা শুধু বৃদ্ধি পায় না, নগরে পানির স্তরও নীচে নেমে যায়। তাই জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান জরুরি।
ড. গোলাম রহমান বলেন, অতীতে ঢাকায় অনেক খাল ছিল। খালকে কেন্দ্র করে ঢাকার অভ্যন্তরে নৌপথ ছিল। কিন্তু উন্নয়নের নামে অনেক খাল ধ্বংস হয়েছে। উন্নয়ন মানে পরিবেশ ধ্বংস নয়, এ ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতে লেকসহ জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান আইন, নীতি ও আদালতের নির্দেশনা বিষয়ক দ্বিতীয় অধিবেশন বেলা আড়াইটায় শুরু হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন এর সভাপতিত্বে এ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদপ্তর এর ঢাকা মহানগর কার্যালয় এর পরিচালক মউদুদউর রশীদ সফদার। এ অধিবেশনে সিএসই’র সহ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সুস্মিতা সেনগুপ্তা ভারতের আইন ও নীতি তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন ও নীতি তুলে ধরেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর জেষ্ঠ্য আইনজীবি তাসলিমা ইসলাম।
তাসলিমা ইসলাম তার প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশে অসংখ্য আইন আছে, মহামান্য আদলতের নির্দেশনাও আছে। কিন্তু এসব যাদের বাস্তাবয়ন করার কথা, তারা নিরব। রাজউক আদালতে স্বীকার করেছে গুলশান-বারিধারা লেক সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু দায় স্বীকার করলেইতো চলবে না। এসব উদ্ধারে বিদ্যমান আইন ও আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে আরও সক্রিয় হতে হবে।
সুস্মিতা সেনগুপ্তা তার প্রবন্ধে বলেন, ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জলাশয়গুলোর চিত্র এক। তাই এসব জলাশয় রক্ষায় অভিন্ন নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। তিনি ভারতে জলাশয় রক্ষায় যেসব আইন রয়েছে সেসব আইনের চিত্রও তুলে ধরেন।
ডা. আব্দুল মতিন বলেন, জলাশয়ে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় একটা শ্রেণী দুর্বৃত্তায়নই দায়ী। কোন সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র মানুষ জলাশয় দখল করছে না বা করতে পারে না। যারা দখল ও দূষণকারী, এরা প্রভাবশালী। কিন্তু এখন মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সক্রিয় হচ্ছে, সোচ্চার হচ্ছে।
মউদুদউর রশীদ সফদার বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও আইন বাস্তবায়নে নিজস্ব ক্ষমতার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম-সবার সহযোগিতা করা দরকার।
দিনব্যাপী এ কর্মশালায় বুয়েট এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুর রহমান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর সহকারী সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেলদি সেটিংস কর্মসূচির সমন্বয়ক এ এফ এম খালিদ হাসান, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন এর সদস্য সচিব মিহির বিশ্বাস, বুয়েট এর পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আনিকা ইউনুস, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং এর কর্মকর্তা ড. আসিফ জামান, বাপা’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহিদুল হক খান, সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন এর আহবায়ক ইবনুল সাঈদ রানা ও সদস্য সচিব মশিউর রহমান রুবেল, রিভারাইন পিপল এর আহবায়ক শেখ রোকন প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
কর্মশালা পরিচালনা করেন আমিনুল ইসলাম সুজন।
এ সংক্রান্ত আমার আগের লেখা পড়তে ক্লিক করুন
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




