১
প্রমত্ত পদ্মার ঢেউয়ে কাদামাটির জীবন উথালপাথাল করে। গহন উর্বরা জল। ছোট ছোট ঢেউ, ছোট ছোট ধাক্কা। গলুইয়ের মরিচা না-পড়া টিনের পাত ঝলকায়, চমকায়, পড়ন্ত বিকালের রোদ কেঁপে উঠে। বামে তাকালে পাড় দেখা যায় ওই। দেখা যায় গাছ, নদীর ভাঙন, ঘরবাড়ি, মানুষ।
লৌহজং থানা...আরেকটু সামনে...অই বামে...
ঢেউ আসে পাশ থেকে। নৌকা দুলে। নৌকা ঘুরে। মাঝবয়েসী মাঝি। কাঁচাপাকা চাপদাড়ি। প্রাণবন্ত পদ্মার প্রতিচ্ছায়া।
- আপনে কইত্থন?
- ওইপার...জাজিরা...
- অইখানে থাকেন?
- না
- ও...বেড়াইতে আইছেন?
- হু
সন্ধ্যার আকাশ ঢিমেতালে রঙ ছড়াচ্ছে। সূর্য ডোবা শুরু হলে রূপ বদলায় প্রকৃতি, কালো হওয়ার আগে নিজের সৌন্দর্য তুলে ধরে, লালচে আভা ছড়ায় দিগন্তে। একটু উপরে চারপাশে নীল আকাশ, তাতে ভাসছে সাদা মেঘ, একটু রঙ লেগেছে, তাতে উড়ে যাওয়া কালো কালো দূরের পাখি। ছোট নৌকার গলুইয়ের সমান্তরালে জীবন চলে। মরা গাঙে জোয়ার আসে বৎসরের এই সময়।
- সন্ধ্যা হয়া যাইতেছে...আপনে কি আবার ওইপার যাইবেন?
- জানি না...আপনি কি দাঁড়াবেন?
- খাড়াইবার পারি...আইছেন তো একলাই...যাইবেনও একলা...সমস্যা কি
দাঁড় টানে মাঝি। দুলে দুলে। তাইচি’র মতন ধীরলয়ে, শক্তিমত্তায়, মন্থর গতিময়তায়। বুক ভরে টেনে নেয় বাতাস। ঢেউয়ের ধাক্কা আর দুলে উঠা নৌকায় অদ্ভুত ভারসাম্যতা তার। অস্থিতিশীল পারিপার্শ্বিকতায় অটল অনড় সে, মুখে মৃদু হাসি, ঠোঁটে গুনগুন গান।
ওরে হেএএ...আসবার কালে আসলাম একা,
থাকবার কালে থাকলাম একা,
যাইবার কালেএএ গেলাম একা রেএএ...
সন্ধ্যালগ্নে সূর্যটাও অস্ত গিয়েছে এই ফাঁকে, একা। মাটির গন্ধ খুব কাছে এখন। পাড়ের গুঞ্জন কোলাহল শোনা যাচ্ছে। অন্ধকারে ছোট ছোট জোনাকপোকার মতন আলো জ্বলে কিছু ঘরে। আরেকটু কাছে আসলে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সংসার, মুড়ির টিন, বাক্স-পেটরা, আচারের বয়াম। বাড়ির উঠানে শুকাতে দেওয়া কালো কালো শাড়ি।
ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ। বৈঠার আওয়াজ। নদী-গন্ধ মনে।
- লৌহজঙ্গে কার বাড়িত...
- ইসমাইল প্রধান...
- চিনবার পারলাম না...
- প্রাইমারী স্কুলে পড়ান...
- পেরাইমারি ইসকুল?...লম্বা কইরা, কালো?
- না। খাটো।
- নাহ্ চিনি না...আফনের কে লাগে...
কাঠের নৌকা ঠেকলো শক্ত মাটিতে।
- ...কেউ না।
২
সন্ধ্যা হলেই নদীপাড়ের এই নিবিড় চুপচাপ পিছিয়ে পড়া জায়গায় দুটি-পাতা একটি কুড়ি আর তামাকের আশ্রয়ে একত্র হয় জবুথুবু মানুষ। সভ্যতায় দিনের পর রাত্রি ঘনায়, রাত্রি হলেই অন্ধকার আসে, লিয়ন-ফুকোর পেন্ডুলাম এগুলো বুঝেছিলো ঠিকই, শুধু বোঝেনি অন্ধকার হলে আলোর দরকার হয়, আর অসভ্য মানুষের জীবনে পুরোপুরি আলো আসে না। সূর্য নামের মাঝারি নক্ষত্রের অনুপস্থিতিতে ওদের নীরব দোলনকাল কেউ দেখে না। নদীর উদার বাতাস তাই এখানেই আসে তার মুক্তসত্তা নিয়ে, কুপির আলো কাঁপে, আর হারিকেনের স্বচ্ছ আচ্ছাদনের তলায় নির্লিপ্ত অগ্নিশিখা দেখে স্বজাতির উন্মাতাল কম্পন।
- কান্ট?
- জ্বী, ইমানুয়েল কান্ট। অই চা দেরে পরান।
পরান চা ঢালে। গাঢ় লিকার।
- আমি কিন্তু খুব অবাক হইছি আপনে আমার সাথে দেখা করতে আসছেন ঢাকা থেইকা...
- অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনি জ্ঞানীগুনী মানুষ। আপনার কথা শুনেছি।
- আমার কথা? কী ভয়ংকর ব্যাপার! কোথায় শুনলেন! কী ভয়ংকর কথা!
- চা নেন।
- আপনি ঢাকায় কি করেন...
- শুভ, আমার নাম শুভ।
- ...আপনি ঢাকায় কি করেন শুভ?
- আলোর তীব্রতা মাপি...
- এ্যাঁ...
- কিছুনা...আপনি বলতেছিলেন কিছু...
- ও হ্যাঁ, হ্যাঁ...কি যেন বলতেছিলাম...
- বলতেছিলেন, ক্রিটিক অফ পিওর রিজন। ইমানুয়েল কান্ট।
- ও হ্যাঁ, কান্ট। জ্ঞানী মানুষ বুঝলেন দাদা। সত্যিকার জ্ঞানী...
- বলেন। শুনতেছি।
- শোনেন তাইলে। জার্মানীর মানুষ...তাদের বুদ্ধি একটু বেশীই। এই মানুষটা যেই জায়গায় জন্মাইছে তার একশত মাইলের বেশী দূরে কখনও যায় নাই...এক্কেরে ঘরকুনা। তো কান্ট...আইচ্ছা, তো উনি এইটাই বলতে চান যে এই দুনিয়ায় আমরা যাই দেখি, যাই জ্ঞানার্জন করি, সবকিছুই মতামতের ভিত্তিতে প্রকাশিত বা বর্ণিত। যেমন, আমি বাঁইচা আছি, কিংবা আমি পরানরে টাকা দিলে সে আমারে চা দিবে, উনি এইটারে বলতেছেন জাজমেন্ট। এই জাজমেন্ট আবার এ্যানালিটিকাল আর সিনথেটিক। এ্যানালিটিকাল বা বিশ্লেষণধর্মী কথাটার মানে হইতেছে আমি একটা গাছরে বুঝতে চাইলে এর সব মূল, কাণ্ড, পাতাসহ উল্লেখযোগ্য উপাদানসমূহরে বুঝলেই চলবে। কিন্তু উনি এইটার ব্যাপারে তৃপ্ত ছিলেন না। উনি বললেন যে এই বিশ্লেষণধর্মী জাজমেন্ট আমাদের মূল জ্ঞানে কিছুই যোগ করে না, কারণ এইটা অই মূল সংজ্ঞার শুধু একটা উপাদানের উপরই জোর দেয়। বুঝলেন কিছু?
- হু, আপনাকে বুঝতে চাইলে আপনার দেহ, মন ও অন্য উপাদানসমূহের ধারণাই প্রকৃত জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটায় না।
- জ্বী, কারণ এতে একটা কনসেপ্ট থেকে আরেকটা কনসেপ্টে পৌঁছানো যায় শুধু, শুধু একটা ধারণা থেকে আরেকটা ধারণায় পৌঁছানো। সত্যিকার জ্ঞান না।
- হুম।
- তারপর উনি বললেন সিন্থেটিক জাজমেন্টের কথা। সংশ্লেষণধর্মী। এইগুলা জগত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়ায়। উনি বললেন, সিন্থেটিক জাজমেন্ট সেইগুলাই যাদের কোন এ-প্রায়োরি নাই। এগুলা পোষ্ট-প্রায়োরি।
- এ-প্রায়োরি?
- উমম...এইটার মানে হইলো অভিজ্ঞতা হইতে মুক্ত। ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফ এ্যানি এক্সপেরিয়েন্স। তার মানে দাঁড়াইলো, সিন্থেটিক জাজমেন্ট অভিজ্ঞতার উপ্ড়ে খাড়ায় থাকে। পানি টগবগ কইরা ফুটে একশত ডিগ্রী তাপমাত্রায়, এইটা আমাদের জ্ঞান বাড়ায়। জগত বুঝতে এই অভিজ্ঞতা লাগে। কিন্তু সমস্যা আছে যে এই পোষ্ট-প্রায়োরি সবসময় ঠিক নাও হইতে পারে। পানি সবসময় একশত ডিগ্রী তাপমাত্রায় নাও ফুটতে পারে। কান্ট জ্ঞানী মানুষ। উনি শুদ্ধতা খুঁজেন। উনি বাস্তবতা ধরতে চান। তাই উনি বুঝতে চাইলেন যে এমন কোন সিন্থেটিক জাজমেন্ট থাকতে পারে কি যেইটা এ-প্রায়োরি? জ্ঞান বাড়াবে কিন্তু পাশাপাশি অভিজ্ঞতা হইতে মুক্ত। যদি এইটা থেকে থাকে, তবে এইটাই সেই জ্ঞান যা কিনা পরম আর সব মানবতার জন্য প্রযোজ্য। তাই সকল কান্টিয়ান দর্শন এই প্রশ্নটার উপরই দাঁড়ায় আছে যে, এ-প্রায়োরি সিন্থেটিক জাজমেন্ট কিভাবে সম্ভব? বুঝলেন কথা...পরান আরো দুই কাপ দে...চিনি কমায় দিস আমারটায়।
- সিন্থেটিক এ-প্রায়োরি জাজমেন্ট। সায়েন্স তো এটাই ফরমুলেট করে।
- আরে আপনে তো জানেন দিখি এইসব...
- কিছু কিছু।
- মাইনষে কয়, আরে দর্শন পইড়া কি হইবো। আসল কথা হইলো যে দর্শন জানবো কি জানবো না সেই বিষয় না, ব্যাপার হইলো আমাদের দর্শন জানতেই হপে, কোন উপায় নাই। আমাদের চেতনা আমাদের প্রশ্ন জিগায় তো আমরা চুপ থাকবো কেমনে? আমাদের জানতেই হ...
- আপনি কোথায় থাকেন?
- এইতো এইখান থেইকা আধাঘন্টার পথ, আমি তো কইলাম লন যাই...
- না থাক, এখানেই ভালো। নদী দেখি।
- আর নদী। এখন একটু পোয়াতি হইছে। মানুষ ধ্বংস করে সব।
- ধ্বংস করে...
- জ্বী। আমি যখন ছোট আছিলাম, আহা...কী দিনগুলাই না ছিলো। বর্ষায় পানি আসতো। বন্যা হইতো। কাদামাটি। মানুষ কষ্ট পাইতো ঠিকই, কিন্তু ওইগুলার মইধ্যেই কেমন আনন্দ ছিলো...একটু সময় গেলে বানের পানি পরিষ্কার হইতো, কাদার তলানি পড়তো...মাটি হইতো উর্বরা, আর তারপরেই জীবন...আহা ছোট ছোট বোয়াল মাছের পোনা বাইরাইতো কোত্থেইকা...আমরা শুধু দেখতাম, ডিঙ্গি নৌকা নিয়া পিছু পিছু যাইতাম...মনের সুখে কচিকচি পোনারা কেমন আনন্দে ছটফট করতো...আর এখন মানুষের হাত থেইকা এগুলোর রেহাই নাই...আহারে কচি পোনা, কচি জীবন...এগুলা এখন খালি কষ্টে ছটফট করে...
- আপনি বলতেছিলেন...
- ও হ্যাঁ, হ্যাঁ...কি যেন বলতেছিলাম...
- বলতেছিলেন কান্ট। সিন্থেটিক এ-প্রায়োরি।
- মানুষটার কাজ এতই বড় যে ওইটা কইতে থাকলে পদ্মার পানি শুকায় যাইবো। কোন দর্শনই সারাজীবন টিকা থাকে না, মানুষের মতন, হেহে। তবে হ্যাঁ, উনার বড় ব্যাপার হইলো উনি মানুষরে চিন্তা আর যুক্তির সীমাবদ্ধতা শিখাইছেন। জ্ঞানী মানুষ।
- সীমাবদ্ধতা?
- জ্বী, জানার সীমাবদ্ধতা, চিন্তার সীমাবদ্ধতা, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা...পরান আগুনটা ইদিক দে...বিড়িটা ধরাই...আপনে?
- আমি বিড়ি খাই না।
তারপর কি বলতে গেলো লোকটা, যার নাম আমি জানি ইসমাইল প্রধান, কিন্তু আমি শুনতে পেলাম না। মাথাটা হালকা হঠাৎ। খালি খালি লাগছে। বাতাসটা থেমে এসেছে। ফুঁ শব্দ হতেই মুখ তুলে তাকাতে আমার সামনের কাঠের বেঞ্চির উপর বসা পিচ্চি চায়ের দোকানের সামনে বিড়ির ধোঁয়ার আড়ালে হারিকেনের আলোয় যে মুখটা ভেসে উঠলো, সেটা কিঞ্চিত পোড়খাওয়া, মধ্যবয়সী, কাঁচাপাকা দাড়ির একজন। চোখের নিচে হালকা কালচে দাগ, বাম চোখের তলে একটু বেশী। বেটে খাটো, গোলগাল, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। সাদা শার্ট পড়া, হাতার কোনায় ইস্তিরি হয়নি ঠিকমতন।
খুকখুক কাশলেন ইসমাইল প্রধান।
- আপনি কি ক্লান্ত, শুভ?
- না তো। আমি শুনতেছি আপনার কথা। আপনি তো এখানেই আছেন কিছুদিন হোলো।
- জ্বী, তাতো বছরখানেক হবেই...ইসকুলে পড়াই...সবাই চেনে আরকি...হেহে
- নদীর মাঝি আপনাকে চেনে না।
- কি! ও...আমি নদী পাড় হইনা খুব একটা আরকি...
- আমি জিজ্ঞেস করলাম আশরাফ মাষ্টারের বাড়ি যাবো, সে চিনতে পারলো না...
- ও
- পাড়ে এসেও ঐ ওষুধের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, তারাও...
- আরে, এইটা তো হওয়ার কথা না...ঠিক নাম বলছিলেন তো?
- জ্বী, ঠিক নাম বলেছিলাম। ঠিক নাম।
- এইটা তো হওয়ার কথা না...মা ফার্মেসী?
- জ্বী, মা ফার্মেসী।
- এইটা তো হওয়ার কথা না...
- থাক হয়তো ভুল নাম বলেছিলাম
- ভুল নাম...
- আপনি বলছিলেন কান্ট। সিন্থেটিক এ-প্রায়োরি।
- হুমম। আপনি বলেছিলেন আপনি ঢাকা থেকে আসছেন...
- সিন্থেটিক এ-প্রায়োরি...কান্ট...
- জ্বী আচ্ছা...খুব আগ্রহ তো আপনার...ঠিক আছে...আইচ্ছা, বলতেছিলাম যে...হুম আইচ্ছা...বলতেছিলাম উনি মানুষরে চিন্তা আর যুক্তির সীমাবদ্ধতা শিখাইছেন।
- বলুন। সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলুন।
- এই জগতের কোন কিছুই যদি আমাদের জন্য বাস্তব হইতে হয়, তবে সেইগুলার স্থান এবং কাল থাকতেই হবে। কান্ট বলতেছেন এই স্থান বা স্পেস আমাদের বাইরে, মানে, অবজেক্টিভ জগতে অস্তিত্বহীন, কিন্তু এই স্পেস আবার আমাদের চেতনারও একটা অংশ। স্পেস কোন অভিজ্ঞতা থেকে আসে না, কিন্তু এইটা সকল অভিজ্ঞতার শর্ত। স্পেস ইন্দ্রিয়গোচর বা পদার্থ বা বস্তু না, স্পেস যুক্তির মাধ্যমে পৌঁছানো কোন ধারনাও না, স্পেস হইতেছে এক্কেবারে খাঁটি ইন্টিউসন, যারে বলে অন্তর্জ্ঞান বা সহজজ্ঞান। এই অন্তর্জ্ঞান হইলো সরাসরি জ্ঞান, ডিরেক্ট নলেজ, কোন প্রকার যুক্তিবিন্যাস বা যুক্তিপাত ছাড়াই।
- কোন যুক্তি ছাড়াই।
- জ্বী, ফলের খোসা ফালায় দিয়া এক্কেবারে ভিতরের শাষটা খাইতে যেমন লাগে, তেমন।
- হুম।
- স্পেস বা স্থান সম্পর্কিত অন্তর্জ্ঞান একটা এ-প্রায়োরি সিন্থেটিক জাজমেন্টের শর্ত। সময়ের ক্ষেত্রেও অই একই ব্যাপার। সময় কোন বস্তু না, সবকিছু সময়ের মধ্যেই আছে। চেতনাও তাই, চেতনার ছোট ছোট অংশ হইতে পারে না, কারণ চেতনা অক্ষত, অটুট। বিজ্ঞান আমাদের বস্তজগতের সংযোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে, কিন্তু বস্তুর সত্যিকারের গুণাবলী সম্পর্কে কোন অন্তর্জ্ঞান দিতে পারে না। এইগুলা সীমাবদ্ধতা। বস্তুরে জানার সীমাবদ্ধতা, বোঝার সীমাবদ্ধতা। বস্তুর সত্যিকারের গুণাবলী মাইনষে কোনদিনও জানতে পারবো না। বস্তুজগতে ঢুকলেই সেইটা ফেনোমেনন হয়ে যায়, পিওর রিজন বা শুদ্ধ-যুক্তি দিয়ে তারে যাইবোনা ধরা...আপনেরে খুব সহজ ছোট কইরা বললাম...রাত হইতেছে...আপনে কি ফিরবেন?
- আপনি স্থির হোন।
- ইস্থিরই তো আছি...
- আপনার হাত কাঁপছে, পানি খান।
জায়গাটা চুপচাপ হয়ে পড়েছে এখন। পরান শুধু ধীরে ধীরে রং-চা বানিয়েই যাচ্ছে। কেউ তাকাচ্ছে না। মানুষজন কিছুই শোনেনা আজকাল।
চাঁদটা শুধু মায়াবী লাগছে...
- ভালোবাসা কি একটা সিন্থেটিক এ-প্রায়োরি, জনাব আশরাফ?
- কিহ্!
- আশরাফ মাষ্টার, বলুন, ভালোবাসা কি জ্ঞান বাড়ায় কিন্তু পূর্ব-অভিজ্ঞতা মুক্ত?
- বুঝলাম না শুভ...
- ভালোবাসা কি বস্তুর ভেতরের পরম জ্ঞান? অন্তর্জ্ঞান দিয়ে বুঝতে হয়? ফলের খোসা ছাড়ানো শেষ হলে টুপ করে গিলে ফেলা? এটা কি বস্তু জনাব আশরাফ? এটা কোন স্পেসে থাকে জানেন কি?
- কিয়ের মধ্যে কী!
- ভালোবাসার অস্তিত্ব কোথায়, জনাব ইসমাইল প্রধান? এটা কোন চেতনার অংশ?
- আপনে...আপনে...
- নদীর ঐপারে আপনি ইসমাইল প্রধান, এপারে আপনি আশরাফ মাষ্টার, আপনি হয়তো আরও অনেকেই...অসংখ্য স্পেসে আপনার বিচরণ, আপনার এসেন্স আপনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, আপনার কোন চেতনায় আপনি আছেন এটা কি আপনি জানেন?
- নদীর ওইপারে...ওইপারে...
- জাজিয়া, তেওটিয়া তারপর আমি এইখানে...লৌহজং...আর আপনি প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টার। আশরাফ মাষ্টার। আপনি সাদা খরগোস সবুজ রঙ করে ঘাসের মধ্যে শুইয়ে রাখেন। ওদের দ্যাখেন। আপনার বাসায় বিড়ালের খাঁচা থাকে। একটা ছেলে বিড়াল, একটা মেয়ে বিড়াল। ওদের জোর করে ধরে আটকে রাখেন খাঁচায়। ওরা মানতে চায়না। সময় যায়। আপনি ওদের দ্যাখেন। এই স্পেসে ওদের অবজার্ভ করেন। আপনি আশায় বুক বাঁধেন। কিছুদিন পর ওরা কাছাকাছি আসে, মুখ ঘসে। ঢুলুঢুলু চোখ ওদের। এই স্পেস ফুড়ে ওদের মাঝ হতে হঠাৎ অন্যকিছুর উৎপত্তি ঘটে। ওরা আলিঙ্গন করে। আর তারপর আপনি ওদের আলাদা করে ফেলেন, দুটো আলাদা খাঁচায় রাখেন, ওরা ছটফট করে জনাব ইসমাইল...আপনি কি ওদের কান্না শুনতে পাননা?
- কেমনে...কেমনে আপনি এতসব...
- গোঁসাইরহাট। শরীয়তপুর।
কেঁপে উঠে বেটে লোকটা। উঠে দাঁড়ায়।
শুভ নামের ছেলেটা কথা বলতে থাকে, আর রাতের আঁধারের ভেতর মাটির পথটা ধরে ছুটে যায় বেটে খাটো এক দার্শনিক।
গোঁসাইরহাট...শরীয়তপুর - বলতে থাকে ছেলেটা, নির্লিপ্ত নির্বিকার চিত্তে - চোদ্দ বছরের এক কিশোরী। চপল, উচ্ছল, প্রাণবন্ত। জায়গাটা কোদালপুর। মেঘনার কাছেই। নদীর মতন বেড়ে উঠছিলো। বিয়ে হয় আপনার সাথে। আমার চাচাই বিয়ে দেয়। চাচাতো বোন আমার। নাহ্ শুধু বোনই। শহুরে মানুষ আমি, গ্রামে গেলে দেখা হোতো শুধু। বিয়ের আগে কবে দেখেছি মনে নেই, শুধু মনে আছে ছোটবেলায় ওর গম্ভীর কালো চোখের কথা, মুখ টিপে হাসি। আমায় আম পেড়ে দিতো। আপনার সাথেই ওর বিয়ে হয়। চৌদ্দ বছরের মেয়ে। আপনি ইসমাইল প্রধান। চাউলের আড়তদার। আপনিই সেই ইসমাইল প্রধান যে ছোটবেলায় বোয়াল মাছের পোনার পেছনে ছুটতেন, সাথে থাকতো আপনার ছোট ডিঙি নৌকা। আপনার খুব কষ্ট মানুষ ধ্বংস করে ফেলছে কোমলতা, পেলবতা। আর আপনি ইসমাইল প্রধান যে ঘুরে বেড়ান ছদ্মনামে, আর বিয়ে করেন গ্রামের ছোট ছোট বালিকা। স্বপ্নের জীবনের আশ্বাস দেন ওদের আর তারপর কী ভীষণ কষ্ট দেন ওদের। আপনি বলাৎকারকারী। আপনি ধর্ষণকারী। আপনার চেতনার কোন স্পেসে আপনি বোয়াল মাছের কচি পোনার পেছন ছুটতেন, আর কোন স্পেসেই বা ওদের পিষে ফেলতেন?
শুভ নামের ছেলেটার হাতে ধরা একমাত্র চায়ের পেয়ালায় এখন এক জার্মান দার্শনিক, বোয়ালমাছের পোনা, ধর্ষকামী প্রেতাত্মা, কালো কিশোরীর চোখ, আর কিছু বেড়ালের কান্নার ঘূর্ণিজল।
পেয়ালায় চুমুক দেয় ছেলেটা।
৩
আধঘন্টা পর...
পোয়াতি পদ্মার শব্দ এই জায়গায় আসে না। পথে আসার সময় কিছু জোনাকপোকা সঙ্গ দেয়ায় একাকী মনে হয়নি ছেলেটির। ধীরপায়ে লৌহজঙের প্রাইমারী স্কুল-শিক্ষক আশরাফ মাষ্টারের বাড়ির উঠোনে এসে পৌঁছুতেই পশ্চিমদিকের বাংলাঘরের ভেতর থেকে ছেলেটা শুনতে পায় কিছু ফ্যাসফ্যাসে কথা...
...ভালোবাসা বাঁচাই আমি...ওই পিশাচগুলা ভালোবাসা ধ্বংস করে ফেলার আগেই আমি বাঁচাই ভালোবাসা, চেতনায় মিলায়ে যায় সেই ভালোবাসা, এই জগতের স্পেস পরিপূর্ণ করে দিতে চাই আমি, ভালোবাসায়...
মূল্যহীন কথাগুলোর মাঝে শুধু বিড়ালের কান্নার প্রতিধ্বনি।
ছেলেটার হাতে ঠাণ্ডা শীতল মেটালিক অনুভূতি।
এই জগতটার শুধু কোন অনুভূতি নেই।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:৫৯