আমি একজন ছাপোষা জুনিয়র সাংবাদিক। এখনও অনেক জায়গায় বিশেষতঃ যে সকল স্থানে ষ্টাফ রিপোর্টার বা তার চেয়েও সিনিয়র সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকেন, সেখানে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ হয়। সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার, ষ্টাফ রিপোর্টার বা কলামিষ্টদের জ্ঞানগর্ভ লেখা পড়লে নিজেকে খুবই ছোট মনে হয়, অসহায় ভাবী। সকালে ঘুম থেকে উঠার পরই মোবাইলে বার্তা সম্পাদকের ফোন পেলাম। কোথায় আছ ? জানতো, আজ ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস, সকাল সকাল বেরিয়ে যাও, এখন তোমাদের শিখার সময়। আর চেষ্টা করবে ভয়াবহ এ দিনটিতে বড় বড় বুলি আওড়ানো বড় বড় রাজনৈতিক দলণ্ডলোর কর্মসূচী বা ভূমিকা কি ইত্যাদি। আমি বললাম ঠিক আছে স্যার, বাসায় থেকেও বললাম আমি অলরেডি বেরিয়ে পড়েছি, প্রেসক্লাবের দিকেই যাচ্ছি।
সময় সকাল ১০ টা। আড্ডা দিচ্ছিলাম চারজন সহকর্মীর সাথে প্রেসক্লাবের সম্মুখে ফুটপাতে মিজানের চায়ের দোকানে। আমাদের এক সিনিয়র সাংবাদিক একদিন বলেছিলেন তোমরা মিয়া সোনার চামুচ মুখে দিয়ে সাংবাদিকতা করছ। তোমাদের বয়সকালে আমাদের সময় মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ বা এরকম কিছুই ছিল না। এখনতো একটা মোবাইল ফোন থাকলেই সারা দুনিয়ার সাংবাদিকতা করা যায়। আসলেই তাই। চায়ের দোকানে চা খেতে খেতেই মোবাইলে শুধু রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নয়, অনেক বিষয়ে সারা দুনিয়ার খবরই পেয়ে যাচ্ছিলাম। বার্তা সম্পাদকের নির্দেশ মত রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির স্মরণে বা এ বিষয়ে বড় বড় রাজনৈতিক দলণ্ডলোর খবর সংগ্রহ করছিলাম। বড় দল বলতে আমি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকেই বুঝে থাকি। জাতীয় পার্টি বা জামায়াতকে সেভাবে মূল্যায়ন করি না। আমার মতে জাতীয় পার্টি হচ্ছে কাগুজে বাঘ, আর জামায়াত হচ্ছে নেকড়ে শেয়াল। বলতে পারেন ছোট মানুষের বড় কথা। তবুও আমার বলার কিছু নেই। যাক, খোঁজ নিয়ে জানা গেল এ বিষয়ে গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। আজও আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীগণ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বিভিন্ন কর্মসূচীতে জড়িত রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল বা অন্য অঙ্গ সংগঠনসমূহের কোন কর্মসূচীর তথ্য পেলাম না।
বারবার জানার চেষ্টা করায় সহকর্মী এক সাংবাদিক আমাকে ধমকের সুরে বললেন সাংবাদিক হয়েছ ভাল কথা এতো জানার চেষ্টা কর কেন ? পরক্ষণেই বলল ঠিক আছে, জানার চেষ্টা থাকা ভাল। তবে তুমি অনেক কিছুই জান না। আমি যা বলি তা শোন। গত বৎসর এই দিনে যখন সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে রানা প্লাজার ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটছিল সেদিন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের দেশব্যাপী ৩৬ ঘন্টার লাগাতার হরতাল চলছিল। এ সময়ে বিএনপির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করেন এবং উক্ত ট্র্যাজেডির কারণে হরতাল প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ জানাতে থাকেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীগণ প্রথমত বিষয়টি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুকে অবহিত করেন। এরপর দুদু বিষয়টি বিএনপি চেয়ারপার্সনের অপর উপদেষ্টা শিমুল বিশ¡াসকে জানালে তিনি বিষয়টি কর্ণপাত করেননি। তৎপরবর্তীতে বিষয়টি চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল সোহেলকে জানানো হলে তার পক্ষ হতেও কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। বরং এ ব্যাপারে তিনি অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। পরবর্তীতে বিএনপির দুই একজন বিক্ষুদ্ধ ও হতাশ নেতা-কর্মীগণ বিষয়টি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে জানান। তরিকুল ইসলাম বলেন, চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এখন ঘুমাচ্ছেন। এ সময়ে নেত্রীকে ঘুম থেকে জাগাতে তরিকুল ইসলাম অপারগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতা-কর্মীগণ বিষয়টি ১৮ দলীয় জোটের শরীক এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অবঃ) অলি আহম্মেদকে জানান। অলি আহম্মেদ এর কার্যকর ভূমিকার ফলে প্রথম অবস্থায় বেলা ১১ দিকে শুধুমাত্র সাভার এলাকায় হরতাল শিথিল করা হয়। পরবর্তীতে ২য় ধাপে হতাহতের ব্যাপকতা এবং মৃতদেহ সরানো ও আহতদের চিকিৎসার সুবিধার্থে ঢাকা মহানগরী ও আশে-পাশের এলাকায় ১২৩০ ঘটিকার দিকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়। সর্বশেষ আনুমানিক বেলা ২টার দিকে তৃতীয় ধাপে দেশব্যাপী হরতাল প্রত্যাহার করা হয়। আমি অবাক দৃষ্টি ও বিস্ময়ে সহকর্মীর কথা শুনছিলাম। কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে আরো বললেন, আমার কথাণ্ডলো বিশ¡াস না হলে তুমি খুবই গোপনে সতর্কতার সাথে খোঁজ নিয়ে এর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করতে পার। এবারতো বুঝতে পেরেছ ? শুধু বাংলাদেশে নয়, তাবৎ বিশে¡র ইতিহাসে ভয়াবহ ভবন ধ¡সের ঘটনা ঘটার পর যখন শতশত মানুষের লাশ বের করা হচ্ছিল, শতশত মানুষ আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছিল, হাজার হাজার আত্মীয়-স্বজন যথন ঢাকায় আসার জন্য আহাজারি করছিল, তখন ছিল এদেশের রাজনৈতিক দল কর্তৃক আহুত দেশব্যাপী ৩৬ ঘন্টার লাগাতার হরতাল। এ হরতাল দুর্ঘটনা ঘটা মাত্রই প্রত্যাহার করা যেত। কিন্তু নেত্রীর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাতে তা প্রত্যাহার করা হয় ঘটনা ঘটার দীর্ঘ পাঁচ ঘন্ট পর। এরূপ দল এবং নেতৃত্বের কাছ থেকে রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির স্মরণে তুমি কিভাবে কর্মসূচী আশা করতে পার। চিন্তা করে দেখ, কি ভয়াবহ আর ভয়ঙ্কর দানবরূপী রাজনীতির নিকট এদেশের মানুষ জিম্মী হয়ে আছে। এ ভয়ঙ্কর রাজনীতির বেড়াজাল থেকে কবে আমরা রেহাই পাব ? আমি কিছু বলতে পারছিলাম না, আমার কোন উত্তর ছিল না।