somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংখ্যালঘুদের মাঝেও সংখ্যালঘুতরের কিচ্ছা!

০২ রা অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিগাল-মংলু-শুকরা-গেদু এইগুলো শুধু আমার কাছে নাম নয়। নামের থেকেও অনেক বড় কিছু।

বিগাল ওঁরাও। আমার শৈশবের গুরু। কারণ সে আমাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে। জানিয়েছে কার সাথে মিশতে হবে। কোথায় যাওয়া যাবে কোথায় যাওয়া যাবে না। মংলু ও শুকরা আমার কিশোর কালের মাস্টার। কারণ তারা আমাকে শিখিয়েছে কি খেলা যাবে কি খেলা যাবে না। কি করা যাবে কি করা যাবে না। গেদু ও অন্যান্যরা আমার তরুণ বয়সের চলার পথের সঙ্গী। আমি তাদের কাছ থেকে কিছু জীবন দর্শন শিখেছি। তাদেরকে পড়ালেখার প্রাথমিক পাঠ নিতে সাহায্য করেছি। এই লোকগুলোর সাথে আমি সবসময় একধরণের আত্নীক সম্পর্ক অনুভব করি।

কিছুদিন আগে ঈদে সাঁওতাল (ওঁরাও হলেও সাঁওতাল নামে পরিচিত) পাড়ার দিকে গেলে নেশাগ্রস্ত(তালের তারির নেশা করা ওদের ট্রেডিশন)বিগাল দা (দাদা) আমাকে চিনতে পারে (প্রায় তিন-চার বছর পর দেখা)। নাম ধরে ডেকে বলে ‘অ্যাব্বাবা,(উচ্ছ্বাস প্রকাশে সাধারণত এ ধরণের উচ্চারণ করা হয়)তুই কখোন আলু(এসেছিস)। ম্যালাদিন(অনেকদিন) পর তোর সাথে দ্যাখা হল নয়’। তার এই সহজ-সরল উক্তির আবেদন অসামান্য। প্রায় হাড় জিরজিরে খেটে খাওয়া মানুষটিকে চেনায় যায় না। যদিও এখন সে কিছুটা আর্থিকভাবে সচ্ছল। ছেলেটা মিশনে থেকে পড়াশুনা করছে। তারপরের কিছু খারাপ মানুষের কারণে সবসময় আতংকগ্রস্ত।

কিন্তু যখন শুনি এই লোকগুলো পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তখন ভীষণ কষ্ট অনুভূত হয়। জীবনের এই চলার কঠিন বাস্তবতায় হৃদয়ে একটু হলেও রক্ত ক্ষরণ হয়। ঐতিহাসিকদের মতে যদিও তারায় এই দেশের ভূমিপুত্র। অথচ তাদের এই করুণ কিংবা নিদারূণ পরিণতি সহজে মেনে নেওয়া ভীষণ শক্ত।

তারচেয়েও যা বেশি কষ্ট তা হচ্ছে এ দেশের সরকার-মিডিয়া-জনগণের তাদেরকে সংখ্যালঘুদের মাঝে সংখ্যালঘুতর বানানোর কসরত। এই কথার অর্থ একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার।

নাসিরনগর বনাম গোবিন্দগঞ্জ

নাসিরনগর ধর্মীয় জিগির তুলে (কিছুটা প্রশাসনের সহায়তায়) সেই জঘন্য (সংখ্যাগরিষ্ট কর্তৃক সংখ্যালঘিষ্টের(সংখ্যালঘিষ্টের মধ্যে আবার তারা সংখ্যাগরিষ্ট) উপর হামলা, লুটপাট। যদিও প্রথম থেকেই জানা যাচ্ছিল যে এই হামলা যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে রাজনীতি, ভূমিদখল, আধিপত্য বিস্তার ও দুপক্ষের বিবাদ জড়িত।

গোবিন্দগঞ্জে প্রশাসনের সহায়তায় সংখ্যাগরিষ্ট কর্তৃক (সংখ্যালঘিষ্টের মধ্যে আবার তারা সংখ্যালঘিষ্টতর) সংখ্যালঘিষ্টের প্রতি দমন-পীড়ণ, লুটপাট, ধ্বংস এবং হত্যা।

দুইটা হামলার একটি অভিন্ন দিক হচ্ছে আতঙ্কের মাধ্যমে সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব বিনাশ কিংবা বিতাড়ন। একটাতে ধর্মকে ঢাল করে আর একটাতে প্রশাসনকে ঢাল করে। প্রথমটার ক্ষেত্রে ক্ষতি মারাত্নক না হলেও দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে ক্ষতিটা ভয়ংকর। কারণ এক্ষেত্রে তিনটা খুন, কয়েকশ বাড়ী-ঘর উচ্ছেদ এবং ভিটাছাড়া করা, শত শত মামলা, জেল জরিমানা, আহতদের হাসপাতালে ধুঁকেধুকে মৃত্যুর প্রহর গণনা।
এগুলোর কোনটায় কিন্তু প্রথমটার ক্ষেত্রে ঘটে নি। তবুও মিডিয়া-সরকার(কিছুটা হলেও)-প্রতিবেশী দেশের উদ্বেগ ফেসবুক-ব্লগে হাওকাউ অনেক অনেক বেশি।

এটার কারণ কি তাহলে সংখ্যালঘুদের মাঝেও সংখ্যালঘুতর-সংখ্যাগুরুতর হেজিমনি বিদ্যমান। আমরা যেটা কিছু চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা(সংখ্যালঘুদের মাঝে সংখ্যাগরিষ্ট)ও অন্যান্য পাহাড়ী সম্প্রদায়ের বৈষম্যের কথা জানি। সমতল ভূমির ক্ষেত্রেও কি সেই একই ফর্মুলা ব্যবহার হচ্ছে?

তা না হলে এ ধরণের বিমাতাসুলভ আচরণ কেন হয়েছিল? কয়েকটা লাশ পড়ার পরেও কেন নাসিরনগরের মতো মিডিয়া কাভারেজ পায় নি?

গতকাল সাপাহারে এক আদিবাসী পরিবারের দুইশ আমগাছ এলাকার প্রভাবশালীরা কেটে দিয়ে ঐ পরিবারকে স্বর্বসান্ত করেছে। এর আগে ঐ পরিবারের একজনকে খুন করা হয়েছে। অথচ এগুলো আমাদের জাতীয় পত্রিকাতে ছোট করে খবর আছে। কোনো কোনো জাতির বিবেক পত্রিকা খবরটুকু ছাপানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। ভাবখানা এমন যে সমাজের এই অচ্ছুৎ লোকদের কথা বললেই কি আর না বললেই কি। কারণ তারা এখানে সংখ্যালঘুদের মাঝে সংখ্যালঘুতর। তাদের পাশে কোনো প্রতিবেশী দেশ নেই।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘পলিটক্যিাল ইকোনমি অব আনপিপলিং অব ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে তথ্যপ্রমাণ সহ উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ এই ৬৭ বছরে সাঁওতালদের ১,১৬,৪০০ একর জমি দখল করা হয়েছে, ২০১৪ সালে যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫,১৯০ কোটি টাকা। প্রতিবারই এই উচ্ছেদের নেতৃত্বে ছিলেন সরকারি ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা, নেপথ্যে ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। তাদের ‍ উচ্ছেদ করা হয়েছে শত্রু সম্পত্তি আইন প্রয়োগ করে, ভুয়া দলিল দেখিয়ে, গুজব ছড়িয়ে, হত্যার হুমকি দিয়ে, সরকারি বনায়ন ও খাস সম্পত্তি রক্ষার নামে, ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যানের নামে, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিস্ট সেন্টার ও ইকো পার্ক তৈরির নামে। কাগজে কলমে থাকলেও কখনো সবার জন্য এক নীতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পালিত হয়নি। অন্যসব নাগরিকের মতো তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়নি। অথচ সাঁওতালদের প্রধান পেশা ছিল পশুপালন ও কৃষি। বনজঙ্গল পরিষ্কার করে এ দেশের অধিকাংশ জমি চাষ উপযোগী করেছে তারা। এভাবে করে বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ৭৫ শতাংশ বর্তমানে ভূমিহীন এবং ৫১.৩ শতাংশ গৃহহীন। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ, ১৯৯১ সালের শুমারিতে ছিল ২,০২,১৬২ জন, ২০১১ সালের শুমারিতে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,৪৩,৪২৫-এ। অন্য উল্লেখযোগ্য বৈষম্যগুলো হলো: সরকারি সেবা পেতে সাধারণ মানুষের চেয়ে আদিবাসীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয়, সাহেবগঞ্জ গ্রামের ৪০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পেলেও একই গ্রামে বসবাসকারী সাঁওতাল আদিবাসীদের বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়নি। সরকার নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নিলেও আদিবাসী নারীদের জীবনযাত্রার মানের কোন উন্নয়ন হয়নি। মাত্র ১০ শতাংশ সাঁওতাল লিখতে ও পড়তে পারেন।

এভাবেই হয়ত আলফ্রেড সোরেনদের মতো বিগাল দা’রাও হারিয়ে যাবে এই মাটি থেকে। অথচ এই মাটিতেই তারাই প্রথম শিকড়টা গেড়েছিল, ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে বসবাস উপযোগী করেছিল, আমরা নই!!!

ছবি: প্রথমটা আমার তোলা, দ্বিতীয়টা পত্রিকা থেকে নেওয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:৩৫
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×