আমি ঝড়ের কাছে~~~
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সকালে আফিসে যেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে কারখানা ভিজিট করা। নিত্যদিনের মত সেদিনও গিয়েছি কারখানায়। সেখানে যেয়ে শুনলাম হুইল প্রেস মেশিন কিছুতেই কাজ করছে না। কোন ভাবেই তাকে চালু করা যাচ্ছেনা। চিরটাকালই ফপর দালালী করা আমার স্বভাব। সেই স্বভাব আর যাবে কোথায়? আমিও ওয়র্কারদের সাথে লেগে গেলাম। শ্রমিকেরা একেকজন দক্ষতর ব্যাক্তি। আর আমরা নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর জোড়ে ওদের উপর ছড়ি ঘুরাই। বিপদে পরলে ওরাই ভরসা। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সহকর্মীরা আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে কখন মেশিন ঠিক হবে, ঠিক হলেই উপরওয়ালার কাছে খবর দিতে হবে স্যার মেশিন ঠিক হয়ে গেছে কোন চিন্তা নেই। ভাবখানা এমন যেন নিজে জান দিয়ে মেশিন ঠিক করলাম । আসলে মেশিন ঠিক করলো শ্রমিকেরা আর আফিসাররা দুই/তিন কাপ চা শেষ করলেন।
যাই হোক মেশিন নষ্ট শুনে একটু উঁকি দিলাম, সেখানে আমার ব্যাসমেটদের সবাইকে পেয়ে গেলাম। বসে গেলাম আড্ডায়। এর মাঝে মিস্ত্রী খালসীরাও আমাদের সাথে টুকটাক গল্প করছে আর কাজ করছে। যেহেতু সেখানে বসবার কোন জায়গা নেই তাই এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে গল্প চলছে। আমিও মজা করে হুইল প্রেস মেশিনের গায়ে হেলান দিয়ে গল্প করে চলছি।
গত রাত থেকে মুশুল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিতে চা হলে কেমন হয়? মন্দ নয়। যেমন কথা তেমনি কাজ। কারখানার শেডের নিচেই এক কোনায় শ্রমিকেরা হিটার জ্বালিয়ে চা এর ব্যাবস্থা রেখেছে। কারন ক্যান্টিনে কেউ চা খেতে গেলে তার কাজে ফিরতে প্রায় এক ঘন্টা লাগে। তাই সময় বাঁচাবার জন্য এই ব্যাবস্থা। চা বানাতে লেগে গেল একজন খালাসী । যে সব সময় চা বানায়। তাকে চাএর দাম দিতে হয়। আমাদের এক সহ কর্মী চা এর রাধুনীকে ক্যান্টিনে পাঠালো পিঁয়াজু আনতে। বৃষ্টিতে চা পিঁয়াজু খুব জমবে।
চা এর পানি ফুটে হিটারে পরছে দেখে নারী সুলভ স্বাভাবিকতায় হাঁড়ির ঢাকনাটা সরাতে গেলাম। যেহেতু পানি হিটারে পরছে তাই হাঁড়িটিও ইলেক্ট্রিফাইড হয়েছে আমি খেয়াল করিনি।
হাড়িতে হাত দেবার সাথে সাথে প্রচন্ড ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে ছিটকে উড়ে গেলাম এবং পর মুহুর্তেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন খালাসীর কোলে। সে দুইহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে চিৎকার করছে আর বলছে স্যার কোথায় লাগছে?
আমার সহকর্মীরা সব আমাকে ঘিরে ধরলো। সবার বিভিন্ন কথা কানে আসছে । কোথায় লেগেছে? ভয় পেয়েছ নাকি? খুব জোড়ে আঘাত পেয়েছ কি? এই মাথায় পানি ঢালো। দেখ যেন সেন্স না হারায়। এই সময় দুধ খেতে হয় সবাই শুধু নানান কথা চিৎকার করে বলে যাচ্ছে। আমার কান দিয়ে কিছু ঢুকছে কিছু ঢুকছে না। আমি সবার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কারো কারো মনে হলো-স্যারের বোধ হয় মাথাই নষ্ট হয়ে গেল?
আমার সহকর্মী এবং স্কুল ফ্রেন্ড মিজান এসেই রাগে কাঁপতে লাগলো। এমনিতে অফিসে ও আমাকে তুমি বলে আর বাইরে তুই তোকারী করে। সে এই কারখানায় সবার সামনেই আমার সাথে তুই তোকারী শুরু করে দিল। তোকে এখানে কে আসতে বলেছে? তোর কাজ কি এখানে? সব সময় বাড়াবাড়ি। আসহ্য। মরলেই পারতি বেঁচে আছিস কেন?--
বলেই নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়তে শুরু করলো। মিজানকে কিভাবে বলি তুই চুল ছিঁড়িস না। এই টাকের জন্যই তোর বিয়ে দেরি করে হয়েছে। যে কয়টা চুল আছে তা তুলে ফেললে তোর বউ কিন্তু চলে যাবে। কিছুই বলতে পারলাম না ।
মনের ভিতরে ঝড় বইছে। প্রচন্ড ঝড়। এ ঝড় আমি কিভাবে থামাবো। এই ঝড় থামাবার শক্তি কি আমার আছে? এই ঝড়কে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা বা এই ঝড় বইবার ক্ষমতা। কোনটাই আমার নেই। আমি ঝড়ের কাছে নতজানু হয়ে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য।
আমাদের চীফ কন্ট্রোলার স্যার এসে আমাকে আমার রুমে যেয়ে রেস্ট নিতে বললেন। আর ডাক্তারকে বললেন, আমাকে দেখতে।
মিজান আমার কাঁধ ধরে আমাকে বললো-- চল তোকে রুমে নিয়ে যাই চল, হাঁটতে পারবি। আমি সম্মতি জানালাম। মিজানের সাথে হেঁটে হেঁটে কারখানার সিঁড়ি পর্যন্ত এসে আস্তে করে মিজানকে জিজ্ঞাস করলাম --এখন আমি কি করবো???
এই বার মিজান ফুঁপিয়ে উঠলো। বললো --এত চিন্তা করছিস কেন ? আমি ভাইয়া কে ডাকছি তুই ভাইয়ার সাথে হাসপাতালে চলে যা । আমি বিকালে হাসপাতালে যাব তোর কাছে। অর্থাৎ মিজান আমাকে বলে দিল এই ঝাড় বইবার ক্ষমতা আমাদের কারো নেই। আমি হেরে গেলাম। এখন কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি আমাকে হতে হবে।
অফিসের দরজা ঠেলে মঞ্জুর ভিতরে আসলো । সংগে আমার বস ও মিজান। আমার জন্য অ্যাম্বুলেন্স রেডি। বুঝে গেলাম অফিসের মোটামুটি সবাই জেনে গেছে যে আজ একটি মৃত্যু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। যে খালাসী আমি ছিটকে পরার সময় আমাকে ধরেছিলেন তিনি বললেন -স্যার চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এম্বুল্যেন্সে চড়ে রওনা হলাম।
হাসপাতালে বসে আছি। আমার হাতে আল্ট্রাসনগ্রামের রিপোর্ট। যেখানে লেখা আছে ভ্রুনের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়েছে ১২ই মে সকাল ১০টা ১১মিঃ ।
সেদিন সকাল থেকে ছিল প্রচন্ড বৃষ্টি আর ঝোড়ো বাতাস। রাস্তা দিয়ে আসবার সময় দেখেছি দু’পাশের বড় বড় বেশ কিছু গাছ ভেঙ্গে পরেছে। আমি আমার সমস্ত ফাইল পত্র হাতে নিয়ে বসে আছি অপেক্ষায় কখন আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। এক সময় ডাক এলো। আমি হেঁটে হেঁটে মঞ্জুরের হাত ধরে ওটির দিকে যাচ্ছি। বাইরে কী ঝড়?
আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম তোমার ঠিকানা
আমি কাঁদলাম হো হো হাসলাম
এই জীবন জোয়ারে ভাসলাম
আমি মৃত্যুর কাছে ঝঞ্ঝার কাছে আঁকলাম নিশানা।
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর
বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন