somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৯৭১ এ সৈয়দপুরের গণহত্যা---

১৬ ই মার্চ, ২০১১ রাত ৯:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ আমি সৈয়দপুরের বাসিন্দা। আমি এখানে এসেছি প্রায় চার মাস হল। সৈয়দপুরে আসবার পর আমি পেলাম আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে। এই ডিসেম্বর মাসে দেখেছি এখানকার জনগন এই মাসকে তারা কত আনন্দময় কত সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে। এ যে সত্যিই বিজয় মিছিল। সমবেত কন্ঠে চারিদিকে শুধু শুনি -- একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার --অথবা -- যারা মোর ঘর ভেঙ্গেছে স্মরন আছে----


এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার পরিস্থিতি কেমন ছিল? খোঁজ নিতে যেয়ে বেড়িয়ে এল এক ভয়াবহ মর্মান্তিক ইতিহাস। যেখানে গণহত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় ৭০০ জন বাঙ্গালী। শুধু মাত্র রেলকারখানায় হত্যা করা হয় ১৭০ জন অফিসার, শ্রমি্‌ কর্মচারীকে। আসলে পাক হানাদার বাহিনীর তান্ডব সারা বাংলাদেশ জুড়ে একই রকম ছিল। পার্থক্য শুধু স্থান ও পাত্রের।

আমি যতটুকু পেরেছি সংগ্রহ করেছি। তাই উপস্থাপন করছি।

সৈয়োদপুর অবাঙ্গালীর শহর। সৈয়দপুর বিহারীদের শহর। আসলে সৈয়দপুর বিভিন্ন জাতীর মিশ্রনে একটি মিশ্রিত শহর। যে শহরের শতকরা ৬০ভাগ মানুষ বিহারী। আর ৪০ ভাগের মধ্যে রয়েছে মাড়োয়ারী হিন্দু, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, মুর্শিদাবাদের বাঙ্গালী মুসলমান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাদেশী। আর আছে মাত্র ৫% স্থানীয় সৈয়দপুরবাসী বাংলাদেশী। এই ৫% বাংলাদেশী সহ এদেশের বঙ্গালী। তারা এখানকার মোট জণসংখার তুলনায় খুবই কম। এখানে এত জাতির মিশ্রন কেন হল তা জানতে হলে আমাদের সৈয়দপুরের কিছু আতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে।

১৯১৯ সালে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ তৈরী হবার পর উত্তরবঙ্গে কলকাতার সাথে সরাসরী রেল যোগাযোগ তৈরী হয়। ১৯২৬ সালে পার্বতিপুর-চিলাহাটি মিটার গেজ লাইন ব্রড গেজে রুপান্তর করা হয়। তখন সরাসরী সৈয়দপুরের সাথে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপীত হয় রেলওয়ের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠে সৈয়দপুর। হয়ে উঠে বৃটিশদের গড়া তিলত্তমা এক গার্ডেন নগরী। রেলওয়ে কারখানা স্থাপীত হয় ১৮৭০সালে এবং তার সাথেই রেলকারখানাকে ঘিরে গড়ে উঠে এই সৈয়দপুর। এই কারখানায় শ্রমিক হিসাবে আসে বিহারীসহ অন্যান্য অবাঙ্গালীরা। এই এলাকাকে একটি সুবিন্যাস্ত ছিমছাম নগরী তৈরী করে বৃটিশরা। এখানে গড়ে উঠে আফিসার্স কলনী যেখানে বৃটিশ অফিসাররা থাকত, সেই সাথে সাহেবপাড়া যেখানে বৃটিশ সুপারভাইজার ও ফোবম্যানরা থাকত, বাবুপাড়া এখানে কেরানীরা থাকত , মুন্সিপাড়া এখানে মুন্সিরা বসবাস করত, খালাশী মহল্লায় খালাশী ও ননসেটেলমেন্টে নট (নট এরা কি কাজ করতেন আমি জানিনা তবে শুনে মনে হয়েছে তারা লাঠিয়াল বাহিনী বা মাস্তান যাদের সাহেবরা বেআইনী কাজে ব্যাবহার করতো) নামে পরিচিত এক জনগোষ্ঠী বাস করত, আর ছিল সুইপার কলনী। বৃটিশ সাহেবদের সাথে এল পাদ্রী এবং তাদের জন্য গীর্জা নির্মিত হল। তৈরী হল আবাসস্থল, সিসটার কুঠী।

সৈয়দপুর হয়ে উঠে ব্যাবসায়ের কেন্দ্রবন্দু। এখনও সৈয়দপুর বাংলাদেশের একটি প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র। স্থানীয় বাঙ্গালীরা তাদের জমি জমা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। তাদের খাওয়া পড়ার চিন্তা নেই ফেল তাদের কারখানা নিয়ে ভাববারও নেই। এখানে কাজ করতে আসে অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল কিছু কিছু বাংলাদেশী। কিন্তু করখানায় কাজ করবার জন্যই আসে মূলত বিহারীরা ও মুর্শিদাবাদী বাঙ্গালীরা । মাড়োয়ারী হিন্দুরা বেশীর ভাগই ছিল ব্যাবসায়ী। বৃটিশরা চলে যাবার পর কারখানার ক্ষমতা চলে যায় পাকিস্থানীদের হাতে। স্বভাবতই সৈয়দপুর তখন হয়ে উঠে পাকিস্থানী অধ্যূষিত এলাকা।

১৯৪৭সালে দেশ বিভাগের পর বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী অবাঙ্গয়ালী মুহাজের কলকাতা কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে এই শহরে এসে ভিড় জমাতে থাকে। চলে যেতে থাকে হিন্দু সম্প্রদায় ভারত আভিমূখে আর বৃটিশরা ইংল্যান্ডে। শহরে উর্দূভাষীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে যায়। রেলমাঠ হয়ে গেল জিন্নাহ মাঠ, বি আর সিং ইন্সটিটিউট হয়ে গেল উর্দূ মাধ্যম--কায়দে আজম গার্লস স্কুল। একে একে শুরু হল শহরের বিভিন্ন স্কুলগুলিকে উর্দূ মাধ্যম করা। শহরের ভাষা হয়ে গেল উর্দূ। বাঙ্গালী অবাঙ্গালীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিল। তা দিনে দিনে বাড়তে লাগলো। উর্দূ ভাষাকে রুখবার জন্য বাঙ্গালী হয়ে উঠলো মরিয়া। আর অবাঙ্গালীরা ও উর্দূকে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধ পরিকর, কারন তাদের সাথে আছে সরকার। তখনকার ডিসি বাংলাভাষা সমূলে উৎপাটনের আপ্রান চেষ্টা চালায়। তখন এর নেতৃত্বে ছিলেন ডাঃ জিকরুল হক। এই সব অগ্রণী ভূমিকার কারনে ১৯৭১সালে অমানবিক নির্যাতনের পর তাকে রংপুরের উপকন্ঠে নিয়ে হত্যা করা হয়।

আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আবার ও সৈয়দপুরে ঝড় উঠেছিল। এক বিহারী গোপনে জনগনের মাঝে লিফলেট বিলি করা শুরু করে উর্দূকে যেন দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা করা হয়। সৈরদপুরের দামাল ছেলেমেয়েরা গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে খুঁজে বের করে কে এই নরাধম। সে ভারত থেকে লিফলেট ছাপিয়ে রাতের আঁধারে বিলি করতো। তার আছে বেশ কিছু সাঙ্গ পাঙ্গ। ঐ ক্ষমতাধর ব্যাক্তিকে হাতে নাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

১৯৭১এর ছাব্বিশ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও সৈয়দপুরে তা শুরু হয় তেইশ মার্চ। সারাদিন সৈয়দপুরের বাঙ্গালীরা অবরুদ্ধ থেকে রাতের আঁধারে ঘাতক দালালদের হাতে শহীদ হলেন রেলকর্মী মনিরুজ্জামান(ফোরম্যান), আব্দুস ছামাদ(কার্পেন্টার), নূর রহমান(খালাসী), ফয়েজউদ্দিন(মোল্ডার)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সৈয়দপুরের বাঙ্গালীরা বেশীরভাগ শহীদ হন বিহারীদের হাতে।

২৪ মার্চ অবরুদ্ধ বাঙ্গালীদের মুক্ত করতে সকাল ১১টায় প্রায় দুই হাজার মানুষ গ্রাম থেকে দা, কুড়াল, বল্লম এই সব দেশী অস্ত্র নিয়ে সাতনালা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে ছুটে আসেন। আগ্নেয়াস্ত্র বলতে দুইটি পয়েন্ট টু-টু ফোর রাইফেল, একটি বন্দুক ও একটি পিস্তল। স্থানীয় বিহারী ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয় একঘন্টা ব্যাপী। তারপর মাহতাব বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। মাহতাব বেগ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার ছেলে মির্জা সালাউদ্দিন বেগ আহত হন বুলেটের আঘাতে। শোনা যায় বিহারীরা শহীদ মাহতাবের শিরচ্ছেদ করে শহরে উল্লাস করে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১১ রাত ১০:০২
১৫টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×