somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গপ -রুমাল

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি একজন লজিং মাস্টার। আমি যে বাড়িতে লজিং থাকি সে বাড়িটা একটা টিলা'র উপর অবস্থিত। বাড়িতে ঢুকতে হলে ১৯/২০ টা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়! বাড়িটা পুরা গ্রাম থেকে আলাদা, বাড়ির চারদিক বিভিন্ন রকম গাছগাছালিতে ভর্তি। দুর থেকে দেখলে মনে হয় বাড়িটা জঙলের ভিতর। সে বাড়িতে যারা থাকে তারা একটা যৌথ পরিবার। বাড়িতে অনেক মানুষ, অনেক বাচ্চাকাচ্চা। সকাল ও রাতে দুইবেলা বাড়ির বাচ্চাকাচ্চারা দলবেঁধে আমার ঘরে পড়তে আসে। আমি তাদের খুব মনযোগ দিয়ে পড়া দেখিয়ে দেই। বাচ্চাগুলার কিচির-মিচির মাঝেমাঝে ভালো লাগে, মাঝেমাঝে বিরক্ত লাগে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই, সব ধরনের বিরক্তি নিয়ে আমাকে সে বাড়িতে লজিং থাকতে হয়। বাড়ীর বড় কর্তা বিদেশে থাকেন, প্রায়ই দেশে আসেন। উনি দেশে আসলে আমার দিন ভালো যায়, কারণ উনি আলাদা করে আমার খেয়াল করেন। আসার সাথে-সাথে তিনি কিছু টাকা আমার হাতে গুজে দেন, ঠিক তদ্রুপ যাওয়ার সময় কিছু টাকা আমার হাতে গুজে দিয়ে বলেন - মাস্টার সাহেব বাড়ীর ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।

আমার লজিং বাড়ি থেকে ৫/৬ মিনিট দুরে একটা ছোট রেল ষ্টেশন আছে। সেখানে লোকাল ট্রেনগুলা থামে, মাঝেমাঝে এক্সপ্রেস ট্রেনও থামে। স্টেশনে একজন স্টেশন মাস্টার ও একজন পিয়ন আছেন। দুইজনের সাথেই আমার ভাল পরিচয়। কারণ আমি প্রায়ই স্টেশনে যাই। স্টেশন-ই হল অবসর সময় কাটানোর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। সেখানে যাত্রীদের চেয়ারে বসে আমি ট্রেনের আসা যাওয়া দেখি, ট্রেনের কুজিকজিক মিউজিক শুনি, ট্রেনের ভিতরের এবং বাহিরের মানুষ দেখি, প্রিয়জনদের বিদায় দেয়ার পর মানুষের মলিন মুখ দেখি, বিদায়ী কান্না দেখি। এসব দেখতে আমার ভালোই লাগে। আবার মাঝেমাঝে খারাপও লাগে। মাঝেমাঝে স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে লোকাল পত্রিকা চেয়ে নিয়ে এসে আরাম করে পড়ি। মাঝেমাঝে মোশারোফের সাথে দাবা খেলি। মোশারফ হল আমার মত আরেকজন লজিং মাস্টার, সে গ্রামের মেম্বারের বাড়িতে লজিং থাকে। সে খুব দাবা পাগল ছেলে, আমারে জোরে সেই দাবা খেলাটা শিখিয়েছে। মজার ব্যাপার হল এখন মাঝেমাঝে সে আমার কাছে হেরে যায়।

স্টেশনে রেগুলার যাওয়ার কারণে স্টেশন মাস্টার, পিয়ন ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে ভাল পরিচয় হয়ে গেছে। এর মধ্যে সোবহান সাহেব একজন, যার স্টেশনের পাশে একটা চায়ের স্টল আছে। যার স্টলে প্রায়ই মোশরফের সাথে দাবা খেলায় বাজিতে জিতে চা খাইতে যাই।উনি আমাদের প্রায় একটা বিস্কুট বেশি দেন। তারপর সামসু মিয়া, যে চানাচুর আর বাদাম বিক্রি করে। যার কাছে থেকে প্রতিদিন বাদাম কিনে খাই। মাঝেমাঝে তাকে বলি এমন ঝাল দিয়ে চানাচুর বানিয়ে দাও যাতে চোখ দিয়া অনর্গল পানি পড়ে! সে খুব যতন করে সে আমাদের স্পেসিয়াল ঝাল চানাচুর বানিয়ে দেয়। আমরা খুব আয়েশ করে সেই চানাচুর খাই, আমাদের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ে। আর আরেকজন হল সফির, যাকে সবাই সফি নামে ডাকে ।আমাদের চোখের পানি দেখে প্রায়ই সফির আমাদের প্রশ্ন করে – ছ্যার আপনারা কান্তাছেন কেন? তাকে একটু ধমকের সুরে বলি – দেখছ’না আমরা সামসু মিয়ার স্পেশেয়াল ঝাল চানাচুর খাচ্ছি।

সফির হল ১০/১১ বছরের একটা ছেলে যে এই স্টেশনেই থাকে। সোবহান সাবের চায়ের স্টলে সোবহান সাবকে সাহায্য করে। সেই সাহায্য করার কারণে সোবহান সাহেব তাকে দুপুরের খাবারটা খাবার খাওয়ান। মাঝেমাঝে স্টেশন মাস্টারের ফুট-ফরমাস শুনে। যাত্রীদের ব্যাগ ট্রেনে তুলে দেয়,যাত্রীরা তাকে ২/৩ টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়ে সে রাতের খাবার খায়। রাতের বেলা স্টেশনে ঘুমায়। তার গলায় একটা কালো রুমাল বাঁধা থাকে সবসময়। আমি একটা জিনিস খেয়াল করছি আমরা যখন দাবা খেলি সে খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের দাবা খেলা দেখে আর কিছুক্ষণ পরপর তার গলায় বাঁধায় রুমালের ঘ্রান নেয়। ট্রেন আসার সময় হলে স্টেশনের এই মাথা থেকে ঐ মাথায় দৌড়াদৌড়ি করে আর তার গলায় বাঁধা রুমালের ঘ্রাণ নেয়। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। আমি প্রায়ই ঠিক করি তাকে জিজ্ঞেস করব সে কেন কিছুক্ষণ পরে রুমালের ঘ্রাণ নেয় আর ট্রেন আসার সময় হলে এরকম দৌড়াদৌড়ি করে! কিন্তু কোনদিন সেরকম কিছু তাকে জিজ্ঞেস করা হয়না।

এক শুক্রবার নির্জন বিকেলে আমি স্টেশনে যাত্রীদের চেয়ারে বসে আছি। স্টেশন এমনিতেই শুনশান, তার উপর শুক্রবার হওয়ার কারণে আরও বেশি শুনশান। আমি পত্রিকা পড়ছিলাম। এমন সময় সফি আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমাকে জিজ্ঞেস করলো – ছ্যার চা খাইবেন, আনিয়া দিমু।আমি তাকে না বলে আমার পাশে বসতে বললাম। সে তার গলায় বাঁধায় রুমালের ঘ্রাণ শুকে-শুকে আমার পাশে বসলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম – তোমার গলায় সারাক্ষণ এই রুমাল বাঁধা থাকে কেন? সে বলে – এমনিই ছ্যার। বুঝলাম এমনিই তুমি রুমালটা তোমার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছ। কিন্তু তুমি কেন কিছুক্ষণ পরপর এই রুমালের ঘ্রাণ নেও আর ট্রেন আসার সময় হলে এরকম দৌড়াদৌড়ি করো? এর উত্তরে সে একটা ছোট গল্প বলল। গল্পটা এরকম-

আমি এতিম ছ্যার , জানিনা মা-বাবা কে, তারা কই আছে। কোনদিন আমি আমার মা-বাবারে দেখি নাই। তাই তারা দেখতে কেমন সেইটাও জানিনা। আমি একটা এতিম খানায় বড় হইছি। এতিমখানায় যখন থাকতাম তখন একদিন বিকালবেলা এতিমখানার পাহারাদার সিদ্দিক চাচা আমারে কয়েকটা লাড্ডু আইন্যা দেয়। সেই লাড্ডুগুলা এই রুমালে বান্ধা আছিলো। লাড্ডু দেওয়ার পর যখন তাকে জিকাইছিলাম এইগুলা তারে কে দিছে। সিদ্দিক চাচা কইছিলো – এইগুলা তর মা’য় দিয়া গেছে। মায়ের কথা শুইন্যাই আমি এক দৌড় দেই। সিদ্দিক চাচা আমার দৌড় থামাইয়া জিগায়ছিল-কই যাস। আমি তারে কই – আমার মায়েরে দেখতে যাই। চাচা বলে তর মা তো চইল্য গেছে। আমি বলছিলাম তরে দেইখ্যা যাওনের লাগি। সে কইলও-তর সাথে দেখা করলে নাকি তার ট্রেইন মিস হইয়া যাইব। এর কিছুদিন পর একদিন আমি এতিমখানায় থেকে পালাইয়া চলে আসি। পালাইয়া স্টেশনে আইসা ট্রেইনে উইঠা পড়ি, টিকেট মাস্টর টিকেট না থাকার জইন্য এই স্টেশনে নামাইয়া দেয়। এরপর থাইকা এই স্টেশনেই আছি ছ্যার।

সব শুনে একটা জোরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম সবই শুনলাম এবং বুঝলাম। এবং এটাও বোঝালাম যে রুমাল টা তোমার মা তোমাকে দিয়েছে বলে সেটা তুমি তোমার ঝুলিয়ে রেখেছ। কিন্তু এটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট না তুমি কেন কিছুক্ষণ পরপর এই রুমালের ঘ্রাণ নাও আর ট্রেন আসার সময় হলে এরকম দৌড়াদৌড়ি করো? ছ্যার- আমি এই রুমালের মইধ্যে আমি আমার মা’র ঘেরাণ পাই, এরলাইগ্যা একটু পর পর ঘেরাণ নেই। এইটা রুমালের ঘেরাণ না ছ্যার, এইটা আমি আমার মায়ের ঘেরাণ নেই। আর ট্রেইন আসার সময় হইলেই মনে হয় এই বুঝি আমার মা এই ট্রেইন থাইক্য আইসা নামবো। তাই ট্রেইন আহনের সময় অইলেই আমার ভিতরে এক ধরনের জ্বালাতন শুরু হইয়া যায়। সেই জ্বালাতনে আমি স্টেশনের এই মাথা থেকে ঐ মাথায় দৌড় শুরু করি ছ্যার। যেইদিন সিদ্দিক চাচায় আমারে কইছিল আমার মা আমার সাথে দেখা না কইরা চইলা গেছে কারণ তার ট্রেইন মিস হইয়া যাইব, সেইদিন থাইকাই আমার মনে হইছে আমার মা’রে আমি ট্রেইন ষ্টেশনে খুইজা পাইমু। তাই ঠিক করছি ছ্যার ট্রেইন স্টেশনে-স্টেশনে ঘুইরা ঘুইরাই সারা জীবন কাটাইয়া দিমু - আর মায়েরে খুজুম।

সফি’র মুখে এসব শুনে কখন যে চোখে পানি চলে আসছে সেটা খেয়াল করিনি। খেয়াল হয় তখন যখন সফি আমাকে জিজ্ঞেস করে – ছ্যার আপনে কান্তাছেন কেন, এখন তো আপনে আর সামসু মিয়ার ঝাল ইসপিসাল চানাচুর খাইতাছেন না?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:১৫
৪০টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×