কিছুদিন আগে নিজ দেশ ঘাটাইল যাচ্ছিলাম। আগেরদিন রাতে মাথা ব্যাথায় ভুগতে থাকতে থাকতেও সকালে রওনা দেয়ার জন্য এলার্মের আশ্রয় নিতে হলো। গাড়ীতে আরাম করে ঘুমানোর একটা ইচ্ছা নিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। এখানে উল্লেখ্য আমি সমাজের সেই শ্রেণীর অংশ যারা নিয়মিত পাবলিক বাসে যাতায়ত করে। সিটে বসতে পারলে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী মনে করে। নিজে গাড়ীতে উঠে গেলে অন্যের হুড়োহুড়ি করে উঠাকে রীতিমতো অমার্জনীয় অপরাধ বিবেচনা করে। যদিও প্রায়শই তাদের নিজেদেরও প্রয়োজনের তাগিদে একই ঘটানা ঘটাতে হয়।
যাইহোক, আমার ঘাটাইল যাত্রায় ফিরে আসি। যথারীতি প্রায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি বাসে উঠতে পারলাম। বাইরে কখনও প্রকৃতি শান্ত আবার কখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। এমন চমৎকার আবেগী প্রকৃতির সাথে নিজেকে কিছুটা একাত্ম করার উদ্দেশ্যেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক একটু পেছনের দিকে গিয়ে জানালার ধারের সিট নিলাম। ভেঁজা রাস্তার চলমান গাড়ী সদ্যস্নাত রমনীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজি দেখতে দেখতে ভালোই কাটছিল কিন্তু বিপত্তি বাঁধল যখন আমার সামনের সিটে বসা পঞ্চাশোর্ধ মহিলা তামাক পাতা সহ পান খাওয়া শুরু করলো। তীব্র এক গন্ধ চলন্ত গাড়ীড় বাতাসের ঝাপটায় একেবারে আমার মস্তিষ্কের শেষ বিন্দুতে আঘাত করতে লাগলো। পাবলিক বাসে চলতে চলতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে বসে চলা এই আমার সর্বংসহা নাসিকাগ্রন্থি কোন এক বিচিত্র কারণে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। কিন্তু উঠে গিয়ে আরেক সিটে বসার মত অবস্থা তখন আর নেই। সিট সব ভরে গেছে। সহ্য করতে থাকলাম। সহ্য করায় বঙ্গ সমাজ অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী। নইলে আবর্জনা আর নোংরা পানির গন্ধের ভেতর থাকা ঢাকা শহরের মানুষ সেই কবেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতো। কিছুক্ষণ পর উনার খাওয়া শেষ করার কারণেই হোক অথবা আমার সহ্য ক্ষমতা তার যোগ্যতা প্রদর্শনের কারণেই হোক সেই তামাক পাতার গন্ধ কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসলো। এই সুযোগে একটা টিপস দিয়ে দেই, যদি আপনারা কেউ ইন্ডিয়ান লোকাল ট্রেনে, সাধারণ এক্সপ্রেস ট্রেনে বা পাবলিক বাসে যাত্রার আয়োজন করেন তাহলে তার দুই দিন আগে থেকে তামাক পাতা শুঁকার অভ্যাস করতে পারেন। ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে ধুমপান নিষেধের কারণেই হোক বা মানুষে অভ্যাস বশেই হোক মাঝ বয়সী প্রায় সব লোকই তামাকে সাথে চুন মিশিয়ে মুখে পুরে রাখে। কিছুটা আমাদের এখানকার গুল লাগানোর মত। আগে থেকে গন্ধে অভ্যাস না করলে শুরুতে সহযাত্রীদের কল্যাণে কিছুটা গন্ধ বিপত্তি ঘটতেই পারে!
আসল কথায় ফিরে আসি। তামাকের গন্ধটা সহ্য হয়ে গেছে এমনটা ভেবে যখন একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলব ভাবছি ঠিক তখনই হঠাৎ একটি উৎকট সুগন্ধ আমার বদ্ধ চোখে চিন্তার ধারাকে এলোমেলো করে দিল। চোখ খুলে দেখলাম আমার পাশের যাত্রীর ঘুমিয়ে আমার দিকে হেলে পড়া তার মাথাই সে গন্ধের উৎস। কোন এক সুগন্ধি নারিকেল তেল দিয়ে উনি উনার মাথা পরিপাটি করেছেন। ঘুমিয়ে আমার দিকে হেলে আসায় যে গন্ধ তীব্রবেগে সরাসরি আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে। গন্ধ সমাচার এখানে শেষ হলেও বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু গন্ধ আজ পণ করেছে যে ষোল কলা পুর্ণ করে আগের রাতের মাথাব্যাথাটা পুনঃজাগ্রত না করে আমাকে ছাড়বেনা। চন্দ্রা নামক একটি সাময়িক স্টপেজে গাড়ি আসা মাত্র নানা শ্রেণীর হকারের কলরব। এনার্জি ড্রিংক থেকে শুরু করে সিটি গোল্ডের গলার চেইন কি নেই তাদের কাছে! এসবের কলরবের মাঝেই এক হকার পারফিউম বিক্রি করতে বাসে উঠলো। তার পারফিউম কতটা সুগন্ধ ছড়ায় সেটা না জানালে যাত্রীরা কিনবে কেন! তাই সে বাসে উঠেই পারফিউমটি স্প্রে করে বাতাসে ছড়িয়ে তার সুগন্ধ বুঝিয়ে দিচ্ছিল। গন্ধ এবার বোধহয় আমার উপর তার মিশন শেষ করলো। মাথা আবার ধরে গেল। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতই আমার ঠিক পেছনের দুজন যাত্রীই পারফিউম কিনেই ক্ষান্ত হলোনা সেগুলো রীতিমতো ব্যবহার করা শুরু করে দিল।
সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুটা ভাবনার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিলে হয়তো যাত্রাকালীন এই সংকটা থেকে উত্তোরণ পাওয়া যাবে। কারো উপর রাগ বা গন্ধের উপর বিরক্তিই বা দেখাই কি করে! আমার সেই এক্স বডিস্প্রে, মাথায় দেয়া সেই সানসিল্ক শ্যাম্পু বা গায়ে সিগারেটের গন্ধ (সিগারেটের গন্ধ না চেনা আমার বোন যেটাকে বলে ভাইয়া ভাইয়া গন্ধ) এর সবই যে কখনও কারো বিরক্তির উদ্রেগ করেনি তাই বা কিভাবে বলি! হয়তো ভদ্রতার খাতিরে সবাই চেপে গেছে। যে চেপে যাওয়াটা এখন আমার কর্তব্য।
মনেপড়ে গেল আমার সেই নাইজেরিয়ান বন্ধুর কথা যে এক কোরিয়ান মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। অসম্ভব ভালো মিশুক জনপ্রিয় পরোপকারী সেই বন্ধুটি তার ভালোবাসা হারিয়েছিল শুধুমাত্র গন্ধের কারণে। কোন কিছুর ঘাটতি ছিলোনা কিন্তু আমার সেই বন্ধুর শরীরের গন্ধে নাকি মেয়েটার অস্বস্থি হয়। যার কারণে সে গাড়ীতেও সে বন্ধুটির পাশে বসেনা। মেয়েটিও আমার ব্যাক্তিগত পরিচিত এবং এও জানি যে সে আমার বন্ধুটিকে যথেষ্ট ভালোবাসে কিন্তু শুধুমাত্র তার গন্ধের ভয়ে রিলেশন করতে সাহস পায়না। হয়তো কোনভাবে আমার সেই বন্ধু ব্যাপারটি বুঝে গিয়েছিল। হঠাৎ করে বডি শপে নিয়মিত যাতায়াত নানা ধরনের পারফিউম আর ঘর সুগন্ধি কেনার হিড়িক দেখে তেমনটা সন্দেহ হয়।
শরীর বা আশেপাশের গন্ধ দূর করতেই নাকি গন্ধে ভিন্নতা আনার উদ্দেশ্যে পারফিউমের প্রচলন হয়েছিল সেটা অজানা থাকলেও। বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান গাছ ফুল ফলের নির্যাস থেকে সুগন্ধির ইতিহাস সেই প্রচীন মিশন ব্যাবলনীয় সভ্যতাতেই পাওয়া যায়। হয়তো এ ইতিহাস আরো পুরানো। হয়তো কোন একজন তার প্রিয় মানুষটিকে বুকে পেতে নেয়ার সময় সুগন্ধি দেয়ার আশায় গায়ে সুগন্ধি ফুল লতা মেখে নিয়েছিল। অথবা অভিজ্ঞতায় দেখেছিল যে শরীরে কিছু প্রাকৃতিক সুগন্ধি নিয়ে থাকলে সেটা যেমন অন্যকে প্রভাবিত করে তেমনি পারিপার্শিক কোন কটু গন্ধ থেকেও রক্ষা করে। আর কালে কালে সেই সুগন্ধি প্রয়োগের ধারাবাহিকতায় হয়েছে এবং হচ্ছে বিস্তর গবেষণা। যার ফলশ্রুতিতেই আমরা লোকাল বাসের বিশ টাকা দামের সুগন্ধি থেকে শুরু করে লক্ষ টাকা দামের সুগন্ধি দেখতে পাই। এদিকে আবার পুরণেও দেখতে পাই যে ধীবর কন্যা সত্যাবতী তার গায়ের গন্ধকে দূর করার আশ্বাস পেয়ে মুনি পরাশরের কাছে নিজের সতীত্ব বিলিয়ে দিতে।
সুকুমার রায়ের গন্ধ বিচার কবিতা দিয়ে শেষ করছি।
সিংহাসনে বস্ল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা,
ছটফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা।
বললে রাজা, "মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?"
মন্ত্রী বলে, "এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!"
রাজা বলেন, "মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,"
বদ্যি বলে, "আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।"
রাজা হাঁকেন , "বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।"
পাত্র বলে, "নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?"
রাজা বলেন, "কোটাল তবে এগিয়ে এস শুক্বে।"
কোটাল বলে, "পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর,
গন্ধে তারি মুন্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।"
রাজা বলেন, "আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,"
ভমি বলে, "আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্
রাত্রে আমার বোখার হল, বলছি হুজুর ঠিক বাৎ"-
ব'লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত।
রাজার শালা চন্দ্রেকেতু তারেই ধ'রে শেষটা
বল্ল রাজা, "তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা।"
চন্দ্র বলেন, "মারতে চাও ত ডাকাও নাকো জল্লাদ,
গন্ধ শুকে মর্তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?"
ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই,
ভাব্ল মনে, "ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-"
সাহস করে বল্লে বুড়ো, "মিথ্যে সবাই বকছিস,
শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্শিস।"
রাজা বলেন, "হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,"
তাই না শুনে উৎসাহতে উঠ্ল বুড়ো মদ্দ।
জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুক্ল কত গন্ধ,
রইল অটল, দেখ্ল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ।
রাজ্য হল জয় জয়কার বাজ্ল কাঁসর ঢক্কা,
বাপ্রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা!
পোষ্টটি উৎসর্গ করলাম তাসনুভা সাখাওয়াত বিথি কে। সেই রাতে মাথা ব্যাথার জন্য বিথিকে নক দিয়ে বলেছিলাম, ডাক্তার ওষুধ দেন। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এদিকে সকালে উঠতে হবে। পরদিন সকালে উঠেই চলে যাই ঘাটাইল, যেখানে টেলিটকের থ্রিজি নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে দুই দিন অনলাইনে আসতে পারিনি। দুইদিন পর অনলাইনে এসে দেখি বিথির উৎকণ্ঠা মাখা মেসেজ তাও বেশ কয়েকটি। "কি ব্যাপার, আপনার শরীক কি বেশী খারাপ করেছে? কেমন আছেন? মেসেজ পাওয়া মাত্রই রিপ্লাই দিয়েন।"
হ্যাঁ বিথি, আমার সাথে নেই আপনার রক্তের বন্ধন, নেই কোন আত্নীয়তা বন্ধন। শুধুমাত্র একজন সহব্লগারের জন্য আপনি সেদিন যে আন্তরিকতা ও উৎকণ্ঠা দেখিয়েছেন সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তির অন্যতম। আপনার থেকে এ প্রাপ্তি আমি সারা জীবন মাথায় তুলে রাখবো। আপনার জন্য সামান্য একটু রাত জেগে থাকা সেটা তো আপনারই দেয়া। আর আপনার মতো করেই বলি, প্রতিটি সহব্লগারের মধ্যে এমন আন্তরিকতাপুর্ণ হৃদ্যতার বন্ধন গড়ে উঠুক। আদর্শিক বিভেদের দূরত্ব ভুলে দিন শেষে আমাদের সকলেরই এক পরিচয় "আমরা ব্লগার"

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




