somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডোগনঃ উপাসনার আড়ালে মহাজাগতিক প্রজ্ঞা!!

২৪ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




সভ্যতার বিবর্তন যুগে যুগে মানুষের বিশ্বাস ও সামাজিক ধর্মীয় আচরণেও পরিবর্তন এনেছে। শুভ অশুভ উপাসনা থেকে প্রকৃতির উপাসনা, বহু দেবতার উপাসনা থেকে একেশ্বরবাদ। কিন্তু এখনও এমন কিছু সমাজ সভ্যতা রয়েছে যারা ধরে রেখেছে বা ধরে রাখতে চাইছে তাদের হাজার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। এমনই একটি জাতি হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির বান্দিয়াগারা উপত্যকার ডোগন । প্রায় আট লক্ষ জনগোষ্ঠীর এই জাতি এখনও উপাসনা করে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে তাদের গোত্রের মুখে মুখে চলা এক ধর্মের। যেখানে উপাসনা হয় আকাশের নিদ্রিষ্ট একটি তারাকে কেন্দ্র করে। আকাশে যার অবস্থান ক্যানিস মেজর নক্ষত্রমন্ডলে।


লুব্ধক তারা

তাদের ধর্ম বা সামাজিক আচরণের যে মুখোশ বা নাচের মুদ্রা এর প্রতিটির রয়েছে বিশেষ কিছু মানে। আর যার সবকিছুই চলে ক্যানিস মেজরে অবস্থিত আকাশের সেই উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধককে উদ্দেশ্য করে। বাৎসরিক উৎসব বাদেও ৬০ বছর পরপর তাদের প্রধান উৎসব সিগুই পালিত হয় সেই লুব্ধক নক্ষত্রের এক সঙ্গী তারা জোতির্বিজ্ঞানে যার নাম সিরিয়াস বি এর বর্ষপুর্তি উপলক্ষে। আধুনিক জোতির্বিজ্ঞানে অবশ্য সিরিয়াস বি ৫০ বছরে সিরিয়াসকে একবার প্রদক্ষিণ করে।


সিরিয়াস বি এর কক্ষপথ

অন্যান্য আফ্রিকান উপজাতিদের মতো ডোগনরাও সকলের কাছে ছিলো আরেকটি সাধারণ উপজাতিদের মতোই যতক্ষণনা পর্যন্ত জোতির্বিদরা সিরিয়াস বি নক্ষত্রটি আবিষ্কার করে। ডোগনরা সিরিয়াস বা লুব্ধক নক্ষত্রকে বলে সিগি টোলো। আর সিরিয়াস বি কে বলে পো টোলো।


পো টোলো এবং আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান

ডোগন লোককথা এবং ধর্মীয় ভিত্তিঃ
আমা যিনি থাকেন পো টোলো নামে এক সাদা এবং অত্যন্ত ভারী এক নক্ষত্রে। ২০ টি জিনিষ দিয়ে গড়া সেই নক্ষত্রের প্রতিটি জিনিষ এত ভারী যে তার সামান্যাংশ আমাদের পক্ষে তুলে আনা সম্ভব না। গড আমা তৈরী করেন নোমোকে এবং রাখেন এমা ইয়া টোলো নামের নক্ষত্রের নিয়ান টোলো গ্রহে। সেখান থেকে নোমো আসে পৃথিবীতে এবং মানুষকে শিক্ষা দেয় সভ্যতার কৃষি কাজ ও আগুনের ব্যবহারের। আর এভাবেই ডোগন ধর্মে নোমো হয়ে উঠে মানুষের শিক্ষা ও জলের দেবতা।


নোমো; মহান শিক্ষক ও পানির দেবতা

আধুনিক জোতির্বিজ্ঞানঃ
১৮৪৪ সালে জার্মান জোতির্বিদ ফ্রেডরিখ বাসিল লুব্ধকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সর্ব প্রথম এই সিদ্ধান্তে আসেন যে লুব্ধক বা সিরিয়াস নক্ষত্র আসলে বাইনারী বা ডাবল স্টার সিস্টেম । তার মানে সিরিয়াসকে ঘিরে আর কোন অবজেক্ট ঘুরছে। এখানে উল্লেখ্য আমাদের সুর্যের মতো গুটি কতক নক্ষত্র বাদে মহাকাশের অধিকাংশ তারাই এমন বাইনারী সিস্টেম। যদিও বর্তমানে অনেক বিজ্ঞানী মনে করে আমাদের সুর্যেরও কোন সঙ্গী থাকতে পারে এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝের গ্রহাণুগুলো ধরে অনেকে মনে করেন সুর্যের সঙ্গী আছে বা ছিলো। যা আবার ব্যাবিলনীয়দের দশম গ্রহের গল্পকে বাস্তবতার পথ দেখায়। প্লুটোর বিচ্ছিন্ন গতিপথও বলে প্লুটো হয়তো অন্য কোন কিছু দ্বারা আকর্ষিত হচ্ছে বেশ জোরের সাথেই। যার কারণে প্লুটোর গতি সোলার সিস্টেমের সাথে ঠিক খাপ খাচ্ছেনা। আর প্লুটোর এই দুর্ভাগ্যই প্লুটোকে সৌর জগতের গ্রহগুলো থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডোগনদের লোককথাও বলে আমাদের সুর্য আসলে পো টোলোর মতো দুটি বিশেষ নক্ষত্রের মিলিত রূপ। যাইহোক, আমরা সিরিয়াস বি তে ফিরে যাই। ১৮৬২তে আমেরিকান জোতির্বিদ আলভিন গ্রাহাম ক্লার্ক টেলিস্কোপের মাধ্যমে সর্ব প্রথম লুব্ধকের সঙ্গী নক্ষত্রকে প্রত্যক্ষণ করেন। এবং পরবর্তীতে ১৮৯৪ সালে সিরিয়াস বি জোতির্বিজ্ঞানে স্বীকৃতি পায়। এবং খুব সম্ভব (আমি নিশ্চিত নই) ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম প্রমাণিত হয় যে সিরিয়াস বি আসলে একটি শ্বেত বামুন নক্ষত্র যার আয়তন পৃথিবীর আয়তনের সমান প্রায় এবং ভর সুর্যের ভরের সমান। ডোগন ধর্ম বা ঐতিহ্যে অধুনা আবিষ্কৃত সিরিয়াস বি হচ্ছে তাদের উপাসনার নক্ষত্র পো টোলো।


পো টোলোর বিভিন্ন বস্তুর প্রতীক আঁকছেন ডোগন পুরোহিত বা হোগন


অঙ্কিত চিত্র

বিচিত্র এবং সম্পুর্ণ ব্যতিক্রমী মুখোশ তৈরীর জন্য বিখ্যাত ডোগন সম্প্রদায়ের কাছে গিয়েছেন অনেক পশ্চিমা নৃতাত্ত্বিক, ব্যবসায়ী, পর্যটক অনেকে। একই ধারাবাহিকতায় ১৯৩১ সালে সেখানে যান প্রখ্যাত ফরাসী নৃতাত্ত্বিক মার্শেল গ্রাউল ডোগনদের উপর গবেষণা করেন দীর্ঘ ১৬ বছর। এবং হোগনদের (ডোগন পুরোহিত) মুখে শোনা এবং আঁকা বিভিন্ন উপাখ্যান বিশ্লেষণ করে করে দেখেন এ ধর্মের উপাসনার মুখোশ এর পেছনে রয়েছে এর রহস্যময় মহাজাগতিক প্রজ্ঞা। মাত্র ৮০/৯০ বছর আগে আবিষ্কৃত সিরিয়াস বি নক্ষত্রই আসলে তাদের পো টোলো

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অল্প কিছুদিন আগে আবিষ্কার হওয়া এক নক্ষত্র যা খালি চোখে দেখা অসম্ভব সে নক্ষত্রের কথা ডোগনদের হাজার বছরের পুরোনো ধর্মে আসে কি করে? রহস্য আরো ঘনীভূত যখন জানা যায় সিরিয়াস বি আসলেই একটি শ্বেত বামুন। যার আয়তন পৃথিবীর প্রায় সমান হলেও তার ভর প্রায় সুর্যের ভরের সমান যা ডোগনদের সেই সাদা এবং অত্যন্ত ভারী নক্ষত্রের কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। কিন্তু কিভাবে? আদিম মানুষ প্রযুক্তিতে উন্নত ছিলো? আসলেই ভীনগ্রহ থেকে কেউ এসেছিলো যাদের থেকে জেনেছে? জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং জোতির্বিদ কার্ল স্যাগান অবশ্য ব্যাপারটির রহস্যময়তা অস্বীকার করেছেন। কার্ল স্যাগানের মতে হয়তো ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের মুখে গল্প শুনে শুনে তাদের ধর্মের পট পরিবর্তন করেছে। কেননা তাদের জানার ব্যাপারটি অনেকটাই খাপছাড়া। তারা বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের কথা জানে, শনি গ্রহের বলয়ের কথা জানে কিন্তু অন্য কিছু জানেনা। সিরিয়াস বি জানে অন্য তারাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা খুবই কম। যে বিচ্ছিন্ন জ্ঞান ইউরোপীয় পরিব্রাজক দ্বারা শোনানো নতুন জোতির্বিদ্যার গল্পই হতে পারে।

কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থাকে। সিরিয়াস বি আবিষ্কৃত হয়েছে খুব বেশীদিন হয়নি। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় জনগোষ্ঠীর ধর্ম আচার ধর্মের পট কিছু ইউরোপিয়ান পরিব্রাজকদের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন ঘটবে, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সেটা কি আদৌ গ্রহন যোগ্যতা পায়! তাহলে কোথায় এই মহাজাগতিক প্রজ্ঞার উৎস? এই সেই নক্ষত্র প্রাচীন মিশরে যে তারা সভ্যতার গোড়া পত্তন করেছিলো যা তাদের দেবতা অসিরিস দেবী আইসিস ও শেয়াল দেবতা আনুবিসকে উপস্থাপন করে। এই সেই তারা ভারতীয় পুরাণে যে তারা প্রধান দেবতা শিবের অবতার রুদ্রাক্ষীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই সেই তারা যে তারা আকাশের সবচাইতে উজ্জ্বল তারা। যা আবার সুর্যের নিকট প্রতিবেশীও, সুর্য থেকে যার দুরত্ব মাত্র ৮ দশমিক ৬ আলোকবর্ষ। এই সেই দেবতা নোমো যার অর্ধেক অংশ মানুষের বাকী অর্ধেক অংশ মাছের। মিশর, ব্যাবিলন, গ্রীক থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত পুরাণে যে মৎস্য কন্যা এক বহুল পরিচিত নাম। অবশ্য ডোগনদের বলা তৃতীয় নক্ষত্র এমা ইয়া টোলো বা তার গ্রহ নিয়ান টোলোর সন্ধান আধুনিক বিজ্ঞান এখনও পায়নি।


সিরিয়াস কি আসলে তিন তারার সমন্বয়ে গঠিত?

ডোগনদের মহাজাগতিক প্রজ্ঞার মাঝে তাহলে কি সেই সত্য? জোতির্বিজ্ঞানে অনেক উন্নত আদিম সভ্যতার নিদর্শন? মহাকাশযানে চড়ে আসা ভিন গ্রহের প্রাণী বা এলিয়েন? নাকি রথে চড়ে বা ডানায় ভর করে আসা দেবতারা? নাকি নেহাতই এ এক কাকতালীয় ব্যাপার!

And that it is He who is the Lord of Sirius
(Al Quran, Surat an-najm:49)



সব শেষে ডোগনদের বিখ্যাত মুখোশ এবং কাঠশিল্পের ছবি।






আকাশে লুব্ধক বা সিরিয়াস নক্ষত্রে অবস্থান এবং প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তনে লুব্ধক নক্ষত্রের ভূমিকা জানতে-
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তনের ইতিহাস এবং একটি ধর্মের সম্ভাব্য বিবর্তন


----------


ছবিসুত্রঃ ইন্টারনেট
সকল লিংকঃ উইকিপিডিয়া

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১২:১৫
৪৮টি মন্তব্য ৪৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×