somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবেগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও অপরাধ হ্রাস

১০ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আবেগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও অপরাধ হ্রাস

ব্যক্তির উত্তেজিত, আলোড়িত ও বিক্ষুব্ধ অবস্থাই হলো আবেগ। যদিও মনে করা হয়, মানুষ যুক্তি দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মানুষের জীবনে যুক্তির চেয়ে আবেগের ভূমিকাই প্রধান। পৃথিবীর ভাল-মন্দ সব কাজের পিছনে একমাত্র নিয়ন্ত্রক হলো আবেগ। এই আবেগের কারণেই শাহজাহান তাজমহল বানিয়েছিলেন, অষ্টম এডওয়ার্ড ও গৌতম বুদ্ধ সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। মায়ের ভালবাসার কারণে মানুষ বেঁচে থাকে, বীরেরা দেশপ্রেমের কারণে জীবন দেয়। মাদার তেরেসা, বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরিশ্রম করেন মানুষের প্রতি ভালবাসার কারণে। এই আবেগের (স্নেহ, মমতা, সহমর্মিতা, দয়া, ভালবাসা ইত্যাদি) কারণে আমরা মিলেমিশে বাস করি। আবেগের বৈচিত্র্যের (আনন্দ, দুঃখ, ভয়, উত্তেজনা ইত্যাদি) কারণে আমাদের জীবন উপভোগ্য হয়। আবার এই আবেগের কারণেই (রাগ, হিংসা, ঘৃণা, প্রতিশোধস্পৃহা, লোভ ইত্যাদি) যুদ্ধ, খুন, হানাহানি, ধ্বংস, রেপসহ নানা অপরাধ, পারিবারিক কলহ, নানা বিশৃংখলা হয়।

তীব্র আবেগের কারণে ব্যাক্তি তার বিচার-বিবেচনা,বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পারেনা, নিজের উপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ হারায়। ফলে অন্ধ মাতৃস্নেহ সন্তানের দোষ দেখেনা, ভালবাসায় অন্ধ ব্যক্তি প্রেমিক বা প্রেমিকার প্রতারণার সম্ভাবনাকে আমলে নেয়না বলে প্রতারিত হয়ে কষ্ট পায়, রাগে অন্ধ ব্যক্তি অপরাধ করে বা নিজের চেয়ে বেশী সবল প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে বিপদে পড়ে।

তীব্র আবেগে রক্তচাপ, নাড়ীর স্পন্দন, হৃদস্পন্দন বাড়ে, পাকস্থালীর কাজ বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। আবেগের ফলে মানসিক অস্থিরতা থেকে দ্বন্দ্ব, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, হতাশা ইত্যাদির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, মনোসংযোগ ব্যাহত হয়।

একই আবেগ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কখনও খারাপ, কখনও ভাল ভূমিকা রাখে। যেমন - ভয় মানুষের কাজের উদ্যমকে হ্রাস করে। ফলে মানুষ অনেককিছু করা থেকে বিরত থাকে, অনেক ক্ষতি হয়। এটি খারাপ। আবার ভয় পেয়ে সাধ্যের অতিরিক্ত কোন কাজের ঝুঁকি না নেওয়া ভাল। এতে অনেক বিপদ থেকে বাঁচা যায়। আবার সমাজের ভয়, মানসম্মানের ভয়, আল্লাহর ভয়, মৃত্যুর ভয় ইত্যাদি ব্যক্তিকে অন্যায় ও অসামাজিক কাজ থেকে রক্ষা করে।

তাই আবেগের ভাল ও মন্দ - দুটো দিকই আছে। মিলেমিশে বাঁচতে হলে মানুষের ভাল আবেগকে উৎসাহিত করা দরকার। তেমনি মন্দ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পৃথিবীর বহু সমস্যার সমাধান করা ও অপরাধ হ্রাস করা সম্ভব। কিভাবে? আসুন জানি।

আবেগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু আবেগের প্রকাশ শিক্ষালব্ধ। মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায়না। সে তার আবেগের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা বলেই অপরাধ করে। পৃথিবীর সব বড় বড় মনীষী, রাষ্ট্রনায়ক, মহাপুরুষদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁদের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মূলে রয়েছে আত্মশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ তাঁদের প্রত্যেকের আবেগের প্রকাশ ছিল সুচিন্তিত ও মার্জিত।

আবেগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও আবেগের প্রকাশ যেহেতু শিক্ষালব্ধ, তাই আবেগের প্রকাশ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। কেউ সামান্যতে রেগে হুলুস্থুল বাধায়, কেউ রাগের পর্যাপ্ত কারণ থাকার পরেও থাকে নির্বিকার, শান্ত, স্বাভাবিক। কেউ সামান্য জ্বরে ভীত হয়, কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও উপন্যাস লেখে। কেউ তেলাপোকা দেখে ভয়ে আধমরা হয়, কেউ বিষধর সাপ ধরে। এই পার্থ্যক্যের কারণ আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলের ভিন্নতা।

আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে নিজের আবেগকে কি করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, কিভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ ও উপভোগ করতে হয়, সে বিষয়ে বড়রা নির্দেশনা দেননা বা আবেগের যথাযথ প্রকাশের তেমন সুযোগ করে দেননা। ফলে অধিকাংশ সময় আমাদের আবেগের প্রকাশ হয় স্বেচ্ছাচারী, অমার্জিত ও হানিকর। তাই ছোটবেলা থেকে মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের কিছু করণীয় আছে।

আবেগ নিয়ন্ত্রণের নানা কৌশলসমূহ হলোঃ

১। শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক। তার মনে যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রভাব বেশী থাকে। তাই তার যা ভাল লাগে, তাই পেতে চায়, তাই করতে চায়। ফলে শিশুকে তার কাজে বাধা দিলে, বকা দিলে, খেলনা কেড়ে নিলে, বা শিশু যা করতে বা পেতে চায় তা না দিলে সে আবেগের মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ ঘটায় (চিৎকার করে কাঁদা, গড়াগড়ি দেয়া, হাতপা ছোঁড়া, আঘাত করা ইত্যাদি)।

মনোবিজ্ঞানীররা বলেন, চার বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। শিশুর আবেগের প্রকাশ হতে দিতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে শিশুকে তার আবেগের প্রকাশ ও নিয়ন্ত্রণ শেখাতে হবে। ৭/৮ বছর বয়স থেকে শিশু তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হলে তার আবেগিক বিকাশ যাতে স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে, সেদিকে পিতামাতা ও শিক্ষকের লক্ষ্য রাখা দরকার। কারণ শিশুর আবেগের সুষ্ঠু বিকাশের সাথে তার সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় বিকাশ সম্পর্কিত।

২। পিতামাতা ও শিক্ষকের উচিত, শিশুর যৌক্তিক দাবী পূরণ করা ও অযৌক্তিক দাবী কেন পূরণ করা সম্ভব নয়, তা বুঝিয়ে বলা। শিশুকে তার নিজের ও তার পরিবারের ক্ষমতা-অক্ষমতা সম্বন্ধে অবহিত করা উচিত। তাহলে সে অযৌক্তিক দাবী করবেনা, নিজের ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু করতে চাইবে না। এভাবে শিশুকে তার পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও অবস্থাগত পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিবিধান করতে শেখানো জরুরী।

৩। আত্মবিশ্বাসের অভাব, প্রতিকূল পারিবারিক-সামাজিক-আর্থিক-প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্নেহ-ভালবাসা-নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি শিশু-কিশোরদের মনে ভয় সৃষ্টি করে। শিশু-কিশোররা অনেক সময় ভয়, লজ্জা, নিন্দা ও সমালোচনার ভয়ে আবেগকে প্রকাশ না করে জোর করে দমিয়ে রাখে। আবেগকে জোর করে দমিয়ে রাখা অনুচিত। এতে যেকোন ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিয়ে, প্রয়োজনে সহযোগিতা করে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। তাদের সাথে বাবামাকে বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করতে হবে যাতে সন্তানরা তাদের কোন আবেগ (ভয়, দুঃখ, কষ্ট, লজ্জা ইত্যাদি) বা সমস্যা গোপন না করে।

সন্তানদের সাথে কিভাবে বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করা যায়, সে বিষয়ে অনেক বাবামারই পরিষ্কার ধারণা নেই। সন্তানের সাথে খেলা, ( খেলার সুযোগ করে দেওয়া, খেলতে মাঠে নিয়ে যাওয়া, অন্য শিশুদের সাথে খেলতে উৎসাহিত করা, সাইকেল চালানো বা সাঁতার শেখানো, বাড়ীতে শিশুদের খেলার জন্য একটি জায়গার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি), একসাথে সময় কাটানো-খাওয়া-টিভি দেখা-বেড়াতে যাওয়া, দোষ করলে শিশুকে বুঝিয়ে দিয়ে শাসন করা (অতিরিক্ত শাসন করা যাবেনা। তাতে শিশু আপনাকে ভয় ও ঘৃণা করবে, অনেককিছু গোপন করবে, আপনাকে এড়িয়ে চলবে), শিশু কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কি করছে, এগুলো মন দিয়ে শুনুন, খোঁজ রাখুন, কোন সমস্যায় পড়লে সাহায্য করুন, শুধু দোষারোপ করবেন না। শিশুর সাফল্যে আনন্দিত হোন, পুরষ্কার দিন। ব্যর্থতায় তাকে উৎসাহ দিন, সাহায্য করুন।। পারিবারিক নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শিশুর মত নিন। এভাবে ধীরে ধীরে শিশুর সাথে আপনার আন্তরিকতা তৈরী হবে।

বাবামার উচিত শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের সময় দেয়া, মাঝে মাঝে তাদের সারপ্রাইজ দেয়া, সাধ্যমত সন্তানকে উপহার কিনে দেয়া, পরিবার নিয়ে কাছাকাছি কোথাও খেতে যাওয়া, আত্মীয় বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, অসুস্হ রিলেটিভদের দেখতে যাওয়া, ছুটিতে আত্মীয়দের বাড়ী বা দেশের বাড়ী বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি। কোনমতেই সন্তানদের বিশেষ দিনগুলো ভুলে যাওয়া বা ব্যস্ততার কারণে বিশেষ দিনগুলোতে সন্তানের সাথে না যাওয়া উচিত নয়। এতে সন্তান আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন বাজে অনুভূতি তৈরী হয়। মাঝে মাঝে সন্তানকে অপ্রত্যাশিত কোন উপহার দিন, বেড়াতে নিয়ে যান। তাহলে সন্তানের ইতিবাচক আবেগের বিকাশ হবে এবং সন্তান বুঝবে আপনি তার আচরণে খুশী।

৪। আবেগের অভিজ্ঞতা দুরকম- সুখকর অভিজ্ঞতা (আনন্দ, ভালবাসা, মমতা, উল্লাস, কৌতুহল, সৌন্দর্যবোধ, সৃজনস্পৃহা ইত্যাদি) এবং দুঃখজনক অভিজ্ঞতা (দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, হতাশা, দুশ্চিন্তা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি)। আমরা মনে করি, জীবনে শুধু সুখকর অভিজ্ঞতাই জরুরী। কিন্তু জীবনে দুঃখজনক অভিজ্ঞতা বা কষ্ট পাওয়াও সমান জরুরী। কারণ ব্যর্থতা, দুঃখ, প্রত্যাখ্যান, হতাশা - এগুলোও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অনেকে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা তীব্র কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যা করে বা নেশাগ্রস্ত হয় জীবনের অর্থ খুঁজে পায়না বলে। তাই শিশুকে ছোটবেলা থেকে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেখাতে হবে, জীবনে নেতিবাচক কিছু ঘটলেই জীবনের অর্থ শেষ হয়ে যায়না। সব প্রতিকূলতাকে পরাজিত করে এগিয়ে চলার নামই জীবন। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের প্রতি (বাবামা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, মানুষ) দায়িত্ব পালনও জীবনের ধর্ম।

৫। আবেগের প্রকাশ ও নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও শিক্ষকের ভূমিকা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুদের সাহচর্যে আনন্দ উপভোগ করতে বা কৌতুহল মেটাতে গিয়ে শিশু-কিশোররা প্রায়ই নানা অপরাধে জড়ায়। কখনও কখনও তাদের কোন চাহিদা অপূর্ণ থাকলে তারা অনৈতিক কাজ করে। তাই এসব বিষয়ে পরিবার ও শিক্ষকের সতর্ক থাকা জরুরী। বাড়ীতে ও বিদ্যালয়ে শিশুদের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা, সঙ্গীত চর্চা, অঙ্কন, খেলাধূলা, আবৃত্তি, অভিনয়, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এসবে অংশ নিলে শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ ও আবেগমূলক চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটে। সহশিক্ষামূলক কাজে অংশ নিতে দিলে শিশুর আত্মশ্রদ্ধা তৈরী হয়।

৬।। আবেগের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পরিবার, আত্মীয়, সমাজ, শিক্ষক, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক পরিবেশ (প্রতিপক্ষকে নানাভাবে নির্যাতন করা বা সহাবস্থান ), দেশের আইনগত অবস্থা (বিচারহীনতা, প্রকাশ্য নানা অপরাধ ও অনিয়ম ঘটা বা না ঘটা) ইত্যাদির ভূমিকা রয়েছে।

শিশুরা বড়দের আবেগের প্রকাশ অনুকরণ করে। শিশুর চারপাশের মানুষের আবেগের প্রকাশ মার্জিত না হলে শিশুর আবেগের প্রকাশ ত্রুটিপূর্ণ হয়। বাবা মাকে কথায় কথায় গালি দিলে, মারলে, শিক্ষক আক্রমণাত্মক হলে, বন্ধু প্রতিশোধপ্রবণ হলে শিশুরাও তেমনই হয়। তাই শিশুদের সামনে অন্যদের, বিশেষ করে বড়দের এরকম আচরণ করা অনুচিত।

শিশুর আবেগের সুষ্ঠু বিকাশে গণমাধ্যম ও পাঠ্যক্রমের ভূমিকাও ব্যাপক।
"বখাটে ছেলের ভীড়ে ললনাদের রেহাই নাই, মেলায় যাইরে"- এধরণের গান নারী নির্যাতনকে উস্কে দেয়, মানুষের মধ্যে ধর্ষকাম প্রবৃত্তি (অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ লাভ) জাগায়। ফলে যৌন নিপীড়ন, রেপ, এসিড সন্ত্রাস, খুন, ইভটিজিংসহ নারীর প্রতি নানা সহিংসতা ঘটে। "পাগল করল ভাগিনারে" - এধরণের গান অনৈতিক সম্পর্কের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরী করে। রাস্তায় মেয়েদের উত্যক্ত করা, নারীরা শত নির্যাতন, অবহেলা সব সহ্য করবে - সিনেমা-নাটকে-সাহিত্যে এমন দর্শনের উপস্থিতি নারীর প্রতি পুরুষদের হীন মানসিকতা তৈরী করে দেয়। যেকোন পরিস্থিতি মেনে নিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার মানুষের চেষ্টাকে দেবদাসের মত নেতিবাচক চরিত্রগুলো নষ্ট করে দিয়ে বিপথগামী হতে উৎসাহিত করে। খবরে প্রতিনিয়ত নানা অপরাধ, অনিয়ম, দূর্ণীতি ও নারী নির্যাতন ঘটা ও সেসবের প্রতিকার না হওয়ার খবর পড়ে ও শুনে এগুলোকে মানুষ স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে। ফলে পরোক্ষভাবে অনাচার মেনে নেবার মানসিকতা তৈরী হয়।

"বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান, শিবঠাকুর বিয়ে করল তিন কন্যা দান। এক কন্যা রাঁধে বাড়ে..."- এধরণের কবিতা বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন ও পারিবারিক সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ায়। "বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা বউ সাজবে....", "খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি.. " - এসব কবিতা ছোট ছোট শিশুদের মাথায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার বা কিছু করার চিন্তার পরিবর্তে বিয়ের চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। এসব বিষয় পরিহার করা দরকার।

৭। সত্য-সুন্দর-মহৎ কাজের প্রতি আকর্ষণবোধ, অসত্য-অন্যায়-অসামাজিক কাজের প্রতি ঘৃণাবোধ, প্রতিবেশী, গরীব আত্মীয় ও সাধারণ মানুষের প্রতি মমতা-সহানুভূতি-সহমর্মিতাবোধ ইত্যাদির চর্চা নিজেরা যথার্থভাবে করে তা শিশুদের শেখাতে হবে।

৮। যেকোন সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ ও সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করাতে হবে। তাহলে শিশুর মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা তৈরী হবেনা।

৯। শিশুকে নিজের ক্ষমতা-অক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে এবং অপরকে তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা দিতে শেখাতে হবে। তাহলে নিজের অক্ষমতা নিয়ে শিশু মনে হতাশা, হীনমন্যতা তৈরী হবেনা, নিজের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে শিখবে। অন্যের প্রতি ঈর্শাও অনুভূত হবেনা।

১০। শিশুকে নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রেক্ষিতে তার আকাংখার স্তর নির্ণয় করতে দিতে হবে। তাহলে সে ব্যর্থ বা হতাশ হবেনা। বেশীরভাগ বাবামা ছেলেমেয়ের সাধ্যের অতিরিক্ত ফল আশা করেন, ব্যর্থ হলে গালি দেন। ফলে সন্তান কষ্ট পায়, কেউ কেউ পরীক্ষার ফল খারাপ করে আত্মহত্যা করে।

১১। প্রত্যেক মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে - এই সহজ সত্যকে স্বীকার করে সফলতা, বিফলতা বা জয়-পরাজয়কে সহজভাবে গ্রহণ করতে শেখাতে হবে। যেকোন ব্যর্থতা বা পরাজয়ের কারণ থাকে। সেটি উপলব্ধি করে পরবর্তীতে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য পরিশ্রম করতে উৎসাহ দিতে হবে ও সাহায্য করতে হবে।

১২। ভুলত্রুটি কেউ ধরিয়ে দিলে সেগুলি সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। বাবামাকেও সন্তানের ভুল, দূর্বলতা বা দোষকে উপেক্ষা না করে মেনে নিয়ে সেগুলো শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে।

১৩। ব্যর্থতা, হতাশা, নৈরাজ্য, নির্যাতন, প্রত্যাখ্যান প্রভৃতিকে জয় করার চেষ্টা করতে হবে। যেকোন পরিস্থিতিতে মনোবল অটুট রাখা শেখাতে হবে। তাহলে নিরাশ হয়ে আত্মহত্যা বা নেতিবাচক কিছু করবে না।

১৪। ছোটবেলা থেকে পরিবর্তিত সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশ, কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্র, অন্য যেকোন অবস্থা ও পরিবেশের সাথে সঙ্গতি বিধান করে চলার অভ্যাস গঠন করে দিতে হবে। তাহলে শিশুর সহ্যশক্তি বাড়বে।

১৫। আনন্দ, কৌতুহল, বিস্ময়, শিহরণ ইত্যাদি আবেগ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে হবে। এগুলো নতুন জ্ঞান আহরণে শিশুদের আগ্রহী করে। এসব আবেগ মানুষের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতাকে উন্নত করেছে।

১৬। আমরা শিশুদের শুধু পড়তে বলি, খেলতে দিইনা। কিন্তু খেলাও জরুরী। হারলে কেমন লাগে, জিতলে আনন্দের উপলব্ধিটা কেমন ইত্যাদির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় খেলার মাধ্যমে। খেলাধূলা করলে শিশু-কিশোররা ব্যস্ত থাকে। ফলে খারাপ কোন কাজে লিপ্ত হবার সুযোগ পায়না। শরীর-মন ভাল থাকে, বিনোদন পায়, ভাল লাগে, শিশুর সামাজিক বিকাশ হয়, খেলায় পারদর্শিতা শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ফলে কোন হতাশা বা ব্যর্থতায় শিশু ভেঙ্গে পড়েনা। সন্তান দোষ করলেও অনেক বাবামা অন্য বাচ্চাকে দোষ দেয়। এতে শিশু প্রশ্রয় পায়, তার মধ্যে অসহিষ্ণুতা জন্ম নেয়, আক্রমনাত্মক মনোভাব গড়ে ওঠে। এটি অনুচিত।

১৭। তিরস্কার, উপহাস বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দ্বারা শিশুর অসংযত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়না। তাই শিশুকে বুঝিয়ে আবেগকে সংযত করতে শেখাতে হবে।

১৮। শিশুদেরকে নিজের কাজ নিজে নিজে করার স্বাধীনতা ও দায়িত্ব দিয়ে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হতে দিতে হবে। এতে শিশুরা আত্মনির্ভরশীল হয়। ফলে ভয়, দ্বন্দ্ব, সংকোচ, দ্বিধা এসব নেতিবাচক আবেগ দূর হয়।

আবেগের সুষ্ঠু বিকাশ ও প্রকাশের মাধ্যমেই শিশুর স্বভাব-চরিত্র, ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। আবেগিক সমতা ব্যক্তির গঠণমূলক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে সহায়তা করে, ব্যক্তির জীবনে শান্তি, শৃংখলা, সুস্থিতি বজায় রাখে। তাই এ বিষয়ে সকলের, বিশেষ করে বাবামার সজাগ থাকা জরুরী।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৮
১১টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×