somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওরা না বলুক, বাবা তুমি আমার হিরো, আমার কাছে তুমি মুক্তিযোদ্ধা।

০২ রা মার্চ, ২০১৩ রাত ৩:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এখনকার বাচ্চাদের যেমন গলা দিয়ে ভাত নামতে কষ্ট হয় আমাদের এরকমই আজব এক সমস্যা ছিল। সেটি অবশ্য ভিন্নধরনের! এখন গলা দিয়ে খাবার ঢুকাতে কষ্ট হয়! আর তখন বাড়ীতে মা কিংবা বড় বোনের হাতে বানানো উলের সোয়েটারের গলা দিয়ে মাথা ঢোকানো ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই ধস্তা-ধস্তির পর্যায়টি পার হলে আমার মনে হতো অন্ধকার কুয়োর মধ্যে থেকে বের হয়ে বহু প্রতিক্ষীত সূর্যের দেখা পেলাম! আর মা কিংবা বড় আপা ভাবতেন গাধাটার মাথাটা এত বড় কেন! নিজেদের বুনোনের হাত যশ নিয়ে তাঁদের মাঝে কোনরূপ সংশয় থাকবার প্রশ্নই থাকতো না। বাবা যথারীতি ভ্রু-কুচকে দৃশ্যটি বিরক্তি সহকারে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং এক পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠোনে গিয়ে পায়চারী করতেন, আর বলতেন, তারা তারি করো, মাঠে প্যারেড তো শেষ হতে চলল, এত দেরি করলে যাবো কখন। মায়ের হাত ধরে কিছুক্ষণ পরই উঠোনে বাবার পাশে এসে দাড়াতাম। বাবার গায়ে পুরোনো একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কোট আর ভিন্ন রংয়ের বেলবটম প্যান্ট, পায়ে খাদিম কেডস। তাঁর ক্ষূদে সহযোদ্ধার অবস্থা আরও করুণ! গায়ে সেড় দুয়েক ওজনের মোটা উলের সোয়েটার আর নি¤œাঙ্গে হাফ প্যান্ট! ঠক্ ঠক্ করে শীতে কাপছি! দু-হাটুতে ঠোকা-ঠুকি! পায়ে ডোড়া কাটা ইলাষ্টিকহীন মোজার উপরে বড় ভাইয়ার ছোট বেলার খাদিম কেডস! সেটা নাকি আবার ধারাবাহিকভাবে মেজ ভাইও পড়েছেন! এখন আমার অধিকারে এসেছে! মা বলতেন, যাও বাপ-বেটা মিলে ১৬ই ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন কর গিয়ে। বাবা মুচকি হাসতেন। সে হাসিতে, (এখন মনে হয়) কিসের যেন এক আনন্দ ছিল, একটা গর্ব ছিল। সেই আনন্দ আর গর্বের কাছে পৃথিবীর সকল কিছুই যেন হার মানায়।

বাবা বুক ফুলিয়ে কুচকানো কোট গায়ে বাড়ীর গেটের কাছে গিয়ে দাড়াতেন, পিছনে আমি। দু প্রজন্মের দুই যোদ্ধা ১৬ই ডিসেম্বরের তাৎপর্য দুজনের কাছে তখন দুরকম। বাড়ির গেটে চিকন একটা বাশেঁর ডগায় সূর্যদয়ের সময় টানানো (গত সন্ধ্যায় আয়রন বা ইস্ত্রি করা) পতাকা কুয়াশায় ভিজে একটু নুয়ে পড়েছে। রোদ উঠলে শুকোবে এবং তারপর একটু বাতাস পেলে পত্ পত্ করে উড়বে এই ভেবেই বাবা বোধ হয় প্রতি ১৬ই ডিসেম্বরে আস্বস্ত হয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে হাঁটা শুরু করতেন। এপ্রসঙ্গে দুটো কথা না বললে অপুর্ণতা থেকে যেতে পারে! আমাদের বাড়ীতে কয়েকটি বিলাস দ্রব্য ছিল! একটা সাদা কালো টেলিভিশন, একটা ঢালাই লোহার আয়রণ (ইস্ত্রি), একটা রেডিও, একটা উদ্ভট দর্শন টেপ রেকর্ডার এবং কয়েকটি ক্যাসেট ( হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর একটি, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও দেশাত্মবোধক গানের একটি, বড় বোনের একটি কি দুটি ক্যাসেট ছিল সিনেমার গানের )। সেই ঢালাই লোহার আয়রণ সাধারণত বাড়ীর মেয়েরাই ব্যবহার করতেন। বাড়ীর স্ত্রীলোকেরাই বেশী ব্যবহার করতেন বলেই আমরা ছোট বেলায় এই বস্তুটিকে ইস্ত্রি বলে ডাকতাম বোধ হয়। যাইহোক বাবা এই বস্তুটির ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হতেন শুধু ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায়, জাতিয় পতাকাটি আয়রণ করবার জন্য, নিজের গায়ের কোট কুচকানো হলেও তাতে তার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু পতাকা নিপাট ভাজহীন হওয়া চাই। ঠিক সময়ে পতাকা উঠবে, ঠিক সময়ে পতাকা নামবে, দিনের বাকি সময় দেশাত্মবোধক গান শুনবেন আর একটু পর পরই পতাকাটি দেখে আসবেন ঠিক-ঠাক রয়েছে কিনা। পতাকার বাঁশের উপর কোনো কাক বসলে হায়-হায় করে তেড়ে যেতেন, যেন পাক সেনা এসে বসেছে। কাকগুলো খুবই অপ্রস্তুত হয়ে চলে যেত; হয়ত ওরা বুঝতো পতাকার বাঁশে বসে কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। অথচ অনেক সময় দেখেছি বাবা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, অনতিদূরে মা আমের কিংবা বড়ইয়ের আচার শুকাতে দিয়েছেন। কাক এসে মহা আনন্দে আচার খেয়ে লোপাট করছে, বাবার তাতে কিচছু যায় আসে না। পতাকার বাঁশে বসলে রক্ষে নেই বাছা।

এই টুকরো স্মৃতি কেন লিখলাম জানি না। তবে মনে হলো এই স্মৃতির কথা না লিখলে মূল বিষয়ের অপূর্ণতা থেকে যাবে এবং এই স্মৃতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে বাবার দেশ প্রেমের উপস্থাপন করাটা আমার জন্য সহজতর হবে বলেই মনে হয়েছে।

ছোট বেলা থেকেই বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি, যেগুলির কিছু ছিল রোমাঞ্চকর, কিছু ছিল চোখে জল চলে আসত, কিছু ছিল প্রচন্ড ঘৃনার, কিছু ছিল আফসোসের (এই কারণে আফসোস যে, কেন আমি তখন ছিলাম না; তখন আমি থাকলে যুদ্ধে যেতে পারতাম)। এই গল্প গুলি শুনে শুনে আর বিভিন্ন সময়ে বাবার প্রতিক্রিয়া, মতামত, মনোভাব, জাতিয় দিবস উদযাপন দেখে আমি ছোট বেলা থেকেই জেনে এসেছি বাবা ছিলেন মুক্তি যোদ্ধা।

বাবার কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘বাবা তোমার কাছে যুদ্ধের সময়কার কিছু নেই? বন্দুক কিংবা ডায়েরী, কিংবা ছবি?”
বাবা বলেছিলেন, ‘‘না রে! বন্দুক তো যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু কেড়ে নিয়েছিলেন! বন্দুকের বদলে আরও বড় দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর ডায়েরী লিখবার মতন কিংবা ছবি উঠবার মতন সময় ছিলনা। দায়িত্বটা ছিল অনেক গুরুত্ব পূর্ণ অন্যকিছু করবার অবকাশ ছিল না।”
‘‘তাই বলে কিছুই থাকবে না!”
‘‘আছে রে আছে! যা আছে তার মর্ম বুঝতে হলে তোকে আরও বড় হতে হবে। কথা দিচ্ছি সেগুলো তোকেই দিয়ে যাবো! তখন দেখিস।”

বাবার হেয়ালীতে তখন বড্ড মনখারাপ হয়েছিল। এখন আর হয় না। কারণ সেগুলো এখন আমার একান্ত নিজের সম্পদ। মাঝে মাঝে বের করে হাতে করে বসে থাকি একলা ঘরে, আর বাবার কথা মনে করে চোখে জল আসে। এতদিন ভেবেছিলাম এই দলিল গুলো কাউকেই দেখাবো না কোনোদিন। কিন্তু প্রজন্ম চত্তরের গণজাগরণে প্রথম দিকে তিন দিন কাটানোর পর এখন মনে হচ্ছে, সবাইকে বলা যেতে পারে একজন বঞ্চিত, স্বীকৃতি বিহীন মুক্তি যোদ্ধার কথা; দেখানো যেতে পারে মুক্তিযূদ্ধের সময়ে সেই দলিলসমূহ। তবে আমি খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখি, এই লেখার পেছনে আমার কোনরূপ জাগতিক স্বার্থ জড়িত নয়। এমনকি এখন আর স্বীকৃতিরও প্রয়োজন নেই; এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে কারো কোনো সার্ফিকেশানও দরকার নেই। কারণ আমি নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবেই জানি এবং আজীবন এই বিশ্বাস নিয়েই বেচে থাকব (প্রসঙ্গত, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বাবার নাম নেই!)। এখনকার সরকার কি বলল বা করল তাতে আমার কিছু দরকার নেই। আমার কাছে আমার বাবা দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। বাবার মুখে শোনা গল্পগুলোই গুছিয়ে লিখবার চেষ্টা করছি। জানিনা কতটুকু গুছিয়ে লিখতে পারব।।।

বাবা তখন দিনাজপুরে চাকুরী করতেন। আমাদের সাত ভাই-বোনদের মধ্যে তখন দুই বোন ও এক ভাই এই তিনজন, আর একভাই মায়ের গর্ভে। চাকুরী-সংসার আর অবসরে বই কিংবা সংবাদপত্র পড়া, সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে চাড়া স্বরে আলোচনা এই নিয়েই চলছিল জীবন।

২৫ মার্চ ১৯৭১, ভয়াল সেই রাতের পর স্বাধীনতার ঘোষণা, বাবা কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একদিকে যুদ্ধে যাবার দায়িত্ববোধ অন্যদিকে অনাগত সন্তান সহ চার সন্তান ও স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোনদের নিয়ে উৎকন্ঠা। ভেবে চিন্তে সবাইকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে ভারতে গিয়ে হাজির হলেন। আশ্রয় মিলল হিন্দু এক গৃহস্থের বাড়ীতে। এই হিন্দু পরিবারটি আমাদের পরিবারকে অনেক সহযোগীতা করেছিলেন। এমনকি গরুর মাংসও খাবার অনুমতি দিয়েছিলেন! যদিও গরুর মাংস জোগাড় করা এবং খাওয়ার প্রশ্নই আসত না। তখন নাকি মা আমার ভাই বোনদেরকে ভাতের ফ্যান খাইয়ে রাখতেন। যাইহোক, বাবা পরিবার নিয়ে নিশ্চন্ত হয়ে দেশে ফিরে এলেন দুই-তিন দিনের মধ্যেই রাতের আধাঁরে, যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই। সহকর্মীদের কয়েকজনকে খুঁজে পেলেন। তাদের কাছথেকে অস্ত্রও পেলেন। শুরু হলো যুদ্ধ। কোনো কমান্ডার নেই, দলনেতা নেই, যাযাবরের মতন এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধ। সামান্য গোলাবারুদ। এই নিয়েই আরও কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধাদের দলের সাথে দেখা হলো। গোলাবারুদ আরও পাওয়া গেল। শুরু হলো প্রতিরোধ। এভাবেই কেটে গেল দুটি মাস। বাবার পায়ে গুলি লাগল। মাংস ছিড়ে বেরিয়ে যাওয়া সেই গুলির ক্ষতে একটু পচন দেখা দিলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বর্ডারে চিকিৎসা নিয়ে কয়েকদিন পর ফিরে আসবার জন্য। বাবা আশ্রয়দাতারে বাড়ীতে গিয়ে নবজাতকের মুখ দেখলেন। আশ্রয়দাতার গ্রাম্য ডাক্তার বন্ধুর চিকিৎসা নিলেন। পরের দু’দিন ঐগ্রামেই এক গৃহস্থের খেতে দিনমজুর হিসাবে কাজ করে সামান্য কয়েকটি টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘‘এই নাও এ দিয়ে যেকদিন চলে চলুক। এর পর দু’চারখানা গহনা যা আছে বিক্রি করে দিও। আমি দাদাকে বলে রেখেছি। দাদার সাথে লতিফকে পাঠিয়ে দিও (আমার চাচা)। আমি চললাম, আর ফিরতে পারব কিনা জানি না।”

বাবা আবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফিরে এলেন। এক সহকর্মী ও সহযোদ্ধা বললেন, ‘‘রশিদ ভাই, বড় স্যার আসছিলেন ৩ দিন আগে রাতে। আপনার খোঁজ করলেন। গুলি লেগেছে শুনে বলে গেছেন, আপনি যেন অন্য কোথাও না যান। এখানেই যুদ্ধ করতে বলে গেছেন আপনাকে। স্যার আবার আসবেন কয়েকদিনের মধ্যেই, আপনার সাথে কি নাকি দরকার আছে।”

কয়েকদিন পর বড় স্যার ক্যাম্পে এলেন। হাতে এক খানা চিঠি ধরিয়ে দিলেন। চাকুরীরত অবস্থায় চিঠি অনেক পেয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে টাইপ রাইটারে টাইপ করা সরকারী চিঠি! বাবা খুবই অবাক হয়েছিলেন চিঠিখানা পেয়ে। ভাঁজ খুলে যা দেখলেন তা ছিল অবাক করবার মতনই!

চিঠি - ১



Government of the People’s Republic of Bangladesh
Office of Administrator, North-Western Zone,
Gangarampur, Duck-Banglow, P.C. Gangarampur
West Dinajpur

Memo No. 2/61 Date: 6/6/71
Mr. Abdur Rashid (Designation) S.O. Bldgs. D.G.P. is hereby appointed to work in Nehemba relief camp in the dist. of Dinajpur in addition to his own duties. He should take up his duties and report compliance. The appointment has been made in the interest of public service.

The instructions contained in memo no. G.A. /143(4) dated 28/5/71 by the G.A. Deptt. of Govt. of the people’s Republic of Bangladesh, as extract copy of which is enclosed should be strictly followed. The appointment may be modified future, if necessary.


Administrator
North-Western Zone


[চিঠিখানা দেখে অবাক হবার কারণটা হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধরত একটা দেশের অস্থায়ী সরকার মাত্র ৩ মাসের মাথায় একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও আলাপ আলোচনা দেখি এই সময়ে। কিন্তু কিভাবে এই রাষ্ট্রে স্বাধীনতা যুদ্ধরত অবস্থায় একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠতে শুরু করেছিল সেবিষয়ে তেমন আলোচনা দেখা যায় না।

বাবার প্রবল আপত্তি কানে তুললেন না বড় স্যার (বড় প্রকৌশলী)। যুক্তি সহকারে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন, ‘‘রশিদ, তোমার পায়ের অবস্থা তো বেশি ভাল না। এভাবে থাকলে তো আর কয়দিন পরে হাঁটা চলাই করতে পারবে না। তোমাকে মুজিব নগর সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিম দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের নেহেম্বা রিফিউজী ক্যাম্পের ইন চার্জ করা হয়েছে। রিফিউজী ক্যাম্পের পাশাপাশি ইয়ুথ ক্যাম্পও করতে হবে। এই সব ক্যাম্প থেকে এবং দেশের ভিতর থেকে যুবকদের মনোবল চাঙ্গা করতে হবে। তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য, আমাদের জয় সুনিশ্চিত এটা এই যুবকদের বোঝাতে হবে। আর যখন রিফিউজী ক্যাম্পে থাকবে তখন ক্যাম্পের সবকিছু দেখাশুনা করতে হবে। এই চিঠির সঙ্গে জব ডেসক্রিপশান সংযুক্তি হিসাবে দেওয়া আছে। সম্মুখ যুদ্ধের চাইতে এটাকে কোন অংশে ছোট করে দেখো না। এদেশে এখনো অনেক মানুষ আছেন যারা পাকিস্তান সরকারের অনুগত হয়েই কাজ করছেন। তুমি যুদ্ধে যোগদান করে মুজিব নগর সরকারের প্রতি শুরুতেই আনুগত্য প্রকাশ করেছো। তোমার প্রতি এই নির্দেশ যথাযথ ভাবে পালন করবে।”
বাবা তখন বলেছিলেন, ‘‘স্যার যুদ্ধে আমরা হারব না জানি। কিন্তু যদি পরাজিত হই তবে ফাঁসি হবে। এটা মেনে নিতে পারব না স্যার। আমি প্রয়োজনে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেব। মৃত্যুর পূর্বে অন্ততঃ কয়েকটাকে তো শেষ করে যেতে পারব।”
‘‘রশিদ, যা বলছি তাই করো। নর্থ ওয়েষ্ট জোন এর এই অঞ্চলে আর কেউ নেই এই দায়িত্ব পালন করবার মতন। তুমি মুজিব নগর সরকারের কর্মচারী এখন থেকে। আর কথা বাড়িও না। যত তাড়াতারি পারো কর্ম স্থলে যোগ দাও। ক্যাম্পের কাজ শুরু করতে হবে। যেকোন যুদ্ধের শুরুর কিছুদিন পরের সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়ে যোদ্ধাদের মনোবল ধরে রাখবার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নতুন সহযোদ্ধা। প্রতিটা রণ ক্ষেত্রে এখন নতুন যোদ্ধাদের যোগদান জরুরী। দেশের অনেক যুবক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন রিলিফ ক্যাম্প এবং দেশের অভ্যন্তরে। তারা যুদ্ধে যোগ দিতে চায়, কিন্তু কোন না কোন কারণে তারা ট্রেনিং ক্যাম্প-এ এসে পৌছতে পারছে না। তোমার-আমার এবং তোমার মতন আরোও কিছু মানুষের দায়িত্ব এখন মুজিব নগর সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য ও দেশপ্রেম বজায় রেখে সরকারের প্রশাসনিক শক্তি হিসাবে কাজ করা। জয় বাংলা। আমি চললাম।”

ছবি - ২






*** *** *** *** ***
এরকম বেশ কিছু চিঠি আমার অধিকারে রয়েছে মুক্তি যূদ্ধের সময়ের। খুব যত্নসহকারে রেখেছি। সবকটি চিঠি এখানে দিয়ে পোষ্ট ভারী না করে বরং মূল বিষয় নিয়েই এগিয়ে যাই।
*** *** *** *** ***

বাবা নেহেম্বা রিফিউজী ক্যাম্পে চলে গেলেন। যুদ্ধের পুরোটা সময় এবং যুদ্ধপরবর্তী কিছুদিন তিনি সেখানকার ইন-চার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে বিজয় পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার গল্প বাবার কাছে শুনেছি। সেসব গল্পে রোমাঞ্চিত হয়েছি। পশ্চিম দিনাজপুর থেকে যখন বাংলাদেশের মধ্যে ঢুকতেন উদবাস্তদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে আসবার জন্য তখন পথের দুধারে লাশের স্তুপের দেখা পেয়েছেন অসংখ্য। রাজাকারদের চোখে ফাঁকি দিয়ে চলতে হতো। সেই সঙ্গে তিনি বিভিন্ন গ্রামের যুবকদের সঙ্গে মিটিং করতেন। তাদের বোঝাতেন বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। আমাদের সকলেরই এখন এই যুদ্ধ দেশ মাতার রক্ষার জন্য, স্বাধীনতা, স্বাধীকার, সম্মানের জন্য। অনেক যুবক তৈরী হয়েই থাকত যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। বাবা তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতেন। আবার দেশের ভিতরে যারা মুজিব নগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন তাদের সঙ্গে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন। রিফিউজীদের স্বাস্থ্য, আহার, থাকবার ব্যবস্থা, এতসবকিছু করেও তার মধ্যে নাকি কোনো ক্লান্তি আসতো না।

এভাবেই একদিন চলে এলো ১৬ ডিসেম্বর। বাবা এবং তার ক্যাম্পের সকলেই ভেসেছিলেন আনন্দে। এর মাঝে অনেক সহকর্মী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। অনেকে বিজয়ের বেশে ফিরে এসেছেন। বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য বাবার কাছে যে ছোট বন্দুকটি ছিল তা থেকেই ফাঁকা গুলি ছুড়ে ছুড়ে আনন্দ করেছেন। অবশেষে একখানা মাণচিত্র বুকে নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চললেন। এতদিন পর বাবাকে দেখে মায়ের যত রাগ-অভিমান সব হারিয়ে গেল বিজয়ের আনন্দে।

স্বাধীনতার গৌরবোজ্জল সেই সব স্মৃতির অধ্যায় শেষ হলো। শুরু হলো নতুন দেশে নতুন করে যাত্রা শুরু করবার পালা।

চলবে - - - - - - - -
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৩ রাত ১২:৩৯
১৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×