বঙ্গবন্ধু কি আসলেই দালালদের মুক্তি দিয়েছিলেন? অনেক জ্ঞানপাপীরাও মনে করেন বা বলে থাকেন যে বঙ্গবন্ধু সবাইকে ক্ষমা করেছিলেন। এই ব্লগেও দেখলাম এসব কথা বলা হচ্ছে। আসলেই কি তাই?
দালাল আইন হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর। এই আইনে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল কাদের, আর কাদের জন্য ক্ষমা প্রযোজ্য ছিল না। আইন অনুযায়ী যাদের বিরুদ্ধে ৩০২, ৩০৪, ৩৭৬, ৪৩৫, ৪৩৬ ও ৪৩৮ ধারায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তারা ক্ষমা পাবে না।
৩০২ হলো খুন, ২০৪ খুনের চেষ্টা, ৩৭৬ ধর্ষন, ৪৩৫ অগ্নিসংযোগ, ৪৩৬ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং ৪৩৮ জাহাজে অগ্নিসংযোগ।
এই যদি হয় আইন তাহলে কি করে দালালরা মুক্তি পেলো। এটা ঠিক যে এখন মনে হয় যারা সমর্থক ছিল বা সাধারণ সৈন্য যারা হুকুম তামিল করেছে তাদের ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আজকাল রাজাকারদের আস্ফালন দেখে সেটাই মনে হয়। আবার এটি নিয়ে অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েও। বঙ্গবন্ধু পরবর্তীরা শাসক বঙ্গবন্ধুর উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে দালালদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের সুযোগ দিয়েছে। ১৯৭৫ এর পরে এই আইনটি বাতিল করে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হলো কেন দালাল আইন করা হলো, কেন বিচার হলো না। বঙ্গবন্ধু যে কেবল একক সিদ্ধান্তে করেছেন তা কিন্তু আমার মনে হয় না। আন্তর্জাতিক চাপও একটা প্রধান কারণ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। মনে রাখতে হবে সেসময় জার্মানদের কোনো সমর্থক ছিল না। রুজভেল্ট, চার্চিল ও স্টালিন বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল সমগ্র আরববিশ্ব, নিক্সন-কিসিঞ্জারের আমেরিকা ও চীন। তখনও বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের স্বীকৃত দেশ না। ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেননি, অথচ বন্দীরা ছিল তাদের কাছেই।
আরেকটি বিষয়। বাংলাদেশের তখনকার অবকাঠামো, আর্থিক সামর্থ্য ও বিচার ব্যবস্থা যা ছিল তা দিয়ে কি এত দালালের বিচার করা সম্ভব ছিল? জাতিসংঘের তত্বাবধানে ১৯৯৪ সালে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রোয়ান্ডার জন্য ব্যয় হয়েছিল ৮০ মিলিয়ন ডলার। ৫ হাজার মামলা করা হয়েছিল। তবে যে গতিতে এই ট্রাইব্যুনাল চলেছিল তাতে সব অভিযুক্তদের বিচার করতে প্রয়োজন হতো ১২০ বছর।
তাহলে কি এখন আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সুযোগ নেই? আছে, অবশ্যই আছে। নতুন করেও শুরু করা যায়। অবশ্য কিছু কাজ করাই আছে, প্রয়োজন কেবল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের।
সবচেয়ে ভাল উদাহরণ আমাদের জন্য, সারা বিশ্বের জন্য দক্ষিন আফ্রিকা। বর্ণবাদনীতি অবসানের পর দক্ষিন আফ্রিকায় নেলনস মেন্ডেলা ১৯৯৫ সালে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েসন কমিশন গঠন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বর্ণবাদের প্রভাব সমীক্ষা করে দেখা এবং দায়ীদের চিহ্নিত করা। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু।
আমরাও এখন গঠন করতে পারি এ ধরণের ট্রুথ কমিশন। তাতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। মনে করতে পারি যে ১৯৯৪ সালে গঠন করা হয়েছিল গণ তদন্ত কমিশন। বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এই কমিশনের চেয়ারম্যান। ১৬জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছিল। এরা হল,
১। আব্বাস আলী খান (এখন মৃত)
২। মতিউর রহমান নিজামী
৩। মুহাম্মদ কামরুজ্জামান
৪। আব্দুল আলিম
৫। দেলোয়ার হোসেন সাইদী
৬। মাওলানা আবদুল মান্নান (মৃত)
৭। আনোয়ার জাহিদ
৮। আবদুল কাদের মোল্লা
৯। এস এ এম সোলায়মান
১০। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী
১১। মাওলানা আবদুস সোবহান
১২। মাওলানা এ কে এম ইউসুফ
১৩। মোহাম্মদ আয়েনউদ্দিন
১৪। আলী আহসান মুজাহিদ
১৫। এবিএম খালেক মজুমদার
১৬। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন
(এই কমিশন গঠনের আগেই গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার হয়েছিল বলে এই কমিশনের তালিকায় তার নাম নেই। কমিশনের রিপোর্টটি পাওয়া যায়।)
আসুন রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরাও একটা ট্রুথ কমিশন গঠনের দাবি জানাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০০৭ বিকাল ৩:১০