যার সামনে বসে ছিলাম তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী। অঢেল টাকা। এখন ব্যবসায়ীদের একজন শীর্ষ নেতা। বেশ পরিচিত মুখ।
উদ্দেশ্য একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া। সেই কাজটিই করছিলাম। কিন্তু একটানা করা যাচ্ছে না। একের পর এক ফোন। ফলে বার বার আমার রেকর্ডার বন্ধ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে নিচ্ছি নোট।
প্রথম ফোন: রিং বাজতেই বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরলেন তিনি। ওপাশের ব্যক্তিটিকে জানিয়ে দিলেন যে কাল সকাল ১০টায় এসে যেন চেকটা নিয়ে যান।
ফোন রেখেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইলেকশন চান্দা। সাথে সাথে আমার সাংবাদিক মন সজাগ হয়ে পরলো। জানতে চাইলাম কতো?
-৩ লাখ টাকা।
মনে হলো মাত্র তিন লাখ টাকা। বলেই ফেললাম, এতো কম দিয়ে পার পেলেন।
হাসলেন তিনি। বললেন, এ তো একজন। এরকম আরো অনেক আছে।
-কয়জন?
২৫-৩০ তো হবেই।
দ্বিতীয় ফোন: রিং হতেই নাম্বারটা দেখে ধরলেন। ধরেই দেখি চরম বিরক্ত। আবার সেই একই ধরণের আলাপ। পরেরদিন সকালে অফিসে আসতে বললেন।
ফোন রেখে বললেন-এখন নাম্বার দেখে ফোন ধরি। এইটা অচেনা নাম্বার ছিল। তিনিও জানেন যে তার নাম্বার দেখলে ধরবো না। তাই অন্য নাম্বার দিয়ে ফোন করেছে।
জানলাম তিনি একটা দলের নেতা। একসময় গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন।
জানতে চাইলাম কত দিবেন? উত্তর-৫ লাখ তো দিতেই হবে।
এইবার আসল সাক্ষাৎকার বাদ দিয়ে অন্য এক সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করলাম। জানতে চাইলাম, এটা তো দিচ্ছেন প্রার্থীদের, যারা আপনাকে চেনে, আপনার সাথে পরিচয় আছে এবং আপনার সাথে যাতায়তও আছে। দলকে দিতে হয় কতো।
জানলাম যে, বড় দুই দলকেই দিতে হয়। অংকটা হচ্ছে ৫০ লাখের মতো। বুঝলাম তার নির্বাচনী চান্দা প্রায় ২ কোটি টাকা।
তারপর জানলাম আরেকটা তথ্য। তিনি বললেন, আগের দিন ফোন করেছিল একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট। তারও নাকি নির্বাচন করার অর্থ নাই। জিজ্ঞাস করলাম কত দিবেন?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বলে কথা। তাকে তো আর ১০ লাখের কম দিতে পারি না। তাছাড়া নিজেই সরাসরি ফোন করেছিলেন।
আবার মূল সাক্ষাৎকারে চলে আসলাম।
এবার আমার লেখা পুরোনো একটা রিপোর্ট খুঁজে বের করলাম। ২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল। খানিকটা প্রাসঙ্গিক বলেই এর অংশ বিশেষ এখানে তুলে দিলাম।
নির্বাচনী অর্থায়ন নিয়ে দাতারা উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে, নির্বাচনী অর্থায়নে বাংলাদেশে বড় ধরণের অনিয়ম ঘটে এবং বাংলাদেশে যে উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি রয়েছে তার সবচেয়ে বড় উৎসই এটি। দাতারা চায় নির্বাচনী ব্যয়ের সব তথ্য জনসম্মুখে প্রচার করার যে বিধান রয়েছে তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হোক।
বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন সহায়তা ঋণের (ডিএসসি-৩) যে দলিল প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, তারা ছাড়াও সব দাতাই এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা আরো বলেছে, এ সংক্রান্ত আইন যাতে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় তা বিবেচনা করা হবে বলে সরকারও সম্মত হয়েছে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের প্রধান ক্রিস্টিন আই ওয়ালিক গত আগস্টে এক লিখিত বক্তৃতায় এ বিষয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক। তার হিসেবে বিগত জাতীয় নির্বাচনে ২০ হাজার কোটি টাকা বা প্রায় ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার রাজনৈতিক দলগুলো খরচ করে। যা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ। এই হিসেব অনুযায়ী নির্বাচন ব্যয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের খরচ হয় ২১ ডলার করে। কিংবা নির্বাচন খরচ মেটাতে প্রতি বাংলাদেশীকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরের মতে, নির্বাচনের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ এসেছে মুলত দুর্নীতির মাধ্যমে। আর ভৌত অবকাঠামোর খাতই এক্ষেত্রে বড় হিসাবে বেছে নেওয়া হয়ে থাকে। তার মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ের কোনো প্রক্রিয়া না থাকায় দুর্নীতি, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি এবং বিভিন্ন কাজে পৃষ্টপোষকতা (তদবির) দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের সম্পদ আসে।
এর আগেও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়ন নীতি পর্যালোচেনা করে ২০০৩ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, নির্বাচনী ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা থেকেই বাংলাদেশে দুর্নীতি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এখানে নির্বাচনে জিততে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন হয় এবং নির্বাচন করার ব্যয় অনেক বেশি। মতাসীনরা মূলত এই খরচ তুলতেই তাদের সময় ব্যয় করে, আর যারা জিততে পারে না তাদের চেষ্টা থাকে পরিবেশ অস্থিতিশীল করার। এ অবস্থায় বাংলাদেশে দুর্নীতি কমাতে চাইলে এই নির্বাচনী অর্থায়নের সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিতেই হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বাচনী তহবিল হচ্ছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দুষ্টচক্র। এখন দলে ঢোকার জন্য একবার, মনোনয়ন পেতে আরেকবার এবং নির্বাচনে জিততে আবার অর্থ ব্যয় করতে হয়। একজন প্রার্থী মূলত অর্থনৈতিক দালালি বা নিজের ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করেন। অর্থ সংগ্রহের প্রধান উৎস হিসেবে হয় তিনি ব্যাংকের অর্থ ফেরত দেন না বা সরকারি দরপত্র কুগিত করেন অথবা শেয়ারবাজারে জালিয়াতি করেন কিংবা বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট কোনো প্রকল্পে ভাগ বসান। সুতরাং বলা যায়, পুরো অর্থনীতিকেই এভাবে ব্যবহার করা হয় এবং অর্থনীতির দুষ্টচক্র হিসেবে এটা কাজ করে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলই হচ্ছে একমাত্র সংগঠন যাদের জবাবদিহিতার কোনো আইনগত কাঠামো নাই। এই রাজনৈতিক দলই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনানুষ্ঠানিত খাতে পরিণত হয়েছে। তাদের আয়-ব্যয়ের কোনো হিসেব নেই, হিসাবের কোনো নীরিক্ষা হয় না, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি না মানলে রিট করার কোনো বিধান নাই। এসবই দুর্নীতির সুযোগ বাড়িয়ে দেয়।
কার্টুন: আরিফুর রহমান। নেট থেকে নেওয়া।
সাংবাদিক জীবন: তিনি যেভাবে নির্বাচনী চান্দা দিচ্ছিলেন......
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৯টি মন্তব্য ১২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন
মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন
তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।