somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চর্যাপদ

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। তবে অসমীয়া ও উড়িয়া ভাষার সাথে অনেক মিল থাকায়, অসমীয়া এবং উড়িয়া ভাষারও আদি নিদর্শন হিসেবে দাবী করেন অনেক ভাষা পন্ডিত। একে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি নামেও অভিহিত করা হয়। এটা আসলে একটা গানের সংকলন। বৌদ্ধ ধর্মমতে এর বিষয়বস্তু সাধন ভজনের তত্ত্ব প্রকাশ। চর্যাপদের তিব্বতীয় ভাষার অনুবাদটি ‘Tibetan Buddhist Canon’ বা ‘তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ’ হিসেবে সংরক্ষিত।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রয়েল লাইব্রেরী থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে এটি আধুনিক লিপিতে প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায়। এর রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০ থেকে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর পদগুলো রচিত হয়। সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পন্ডিতই ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন।

চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থে ২৩ জন কবির নাম আছে। সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খন্ড)’ গ্রন্থে ২৪ জন কবির কথা বলেছেন। চর্যাপদের কবিরা আসাম, বাংলা, উড়িষ্যা ও বিহার থেকে এসেছেন বলে ধারনা করা হয়।

চর্যাপদ ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যাওয়ায়, এতে কতটি পদ বা গান আছে তা নিয়েও মতভেদ দেখা দেয়। সুকুমার সেনের মতে এর পদের সংখ্যা ৫১, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৫০টি। চর্যাপদের ২৪ নং (কাহ্নপা রচিত), ২৫ নং (তন্ত্রীপা রচিত) ও ৪৮ নং (কুক্কুরীপা রচিত) পদগুলো পাওয়া যায় নি। ২৩ নং (ভুসুকপা রচিত) পদটি পাওয়া গেছে ছিন্ন অবস্থায়।

সংস্কৃত টীকাকার মুনিদত্তের মতে চর্যাপদ ‘Twilight Language’; সংস্কৃত ‘সান্ধ্য ভাষা’ বা ‘আলো আঁধারী ভাষায়’ রচিত। পরিবর্তীতে বিধুশেখর শাস্ত্রী বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সাথে এর রচনারীতির সাযুজ্য থাকায় এর ভাষা ‘Intentional Lanuage’; সংস্কৃত ‘সন্ধ্যা ভাষা’ হিসেবে অভিহিত করেন। যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায় নি, যে ভাষার অর্থও একাধিক অর্থাৎ আলো আঁধারের মত, সেই ভাষাকেই পন্ডিতগন সান্ধ্য ভাষা বা সন্ধ্যা ভাষা বলে থাকেন।

চর্যাপদের প্রথম পদ লিখেছেন লুইপা। সর্বাধিক ১৩টি পদ (১২টি পদ পাওয়া গেছে) লিখেছেন কাহ্নপা, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮টি পদ লিখেছেন ভুসুকপা।

চর্যাপদের কবি ও তাঁদের পদের নম্বরঃ
লুইপা ১, ২৯ নং পদ
কুক্কুরীপা ২, ২০, ৪৮ নং পদ
বিরুপা ৩ নং পদ
গুন্ডরীপা ৪ নং পদ
চাটিল্লাপা ৫ নং পদ
ভুসুকপা ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯ নং পদ
কাহ্নপা ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫ নং পদ
কম্বালম্বরপা ৮ নং পদ
ডোম্বীপা ১৪ নং পদ
শান্তিপা ১৫, ২৬ নং পদ
মহীধরপা ১৬
বীণাপা ১৭
সরহপা ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯ নং পদ
শবরপা ২৮, ৫০ নং পদ
আর্যদেবপা ৩১ নং পদ
ঢেগুনপা ৩৩ নং পদ
দারিকপা ৩৪ নং পদ
ভাদেপা ৩৫ নং পদ
তাড়কপা ৩৭ নং পদ
কঙ্কণপা ৪৪ নং পদ
জয়নন্দীপা ৪৬ নং পদ
ধর্মপা ৪৭ নং পদ
তন্ত্রীপা ২৫ নং পদ।


লুইপার লিখিত চর্যাপদের প্রথম পদ (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পাঠ অনুসারে)

কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল।।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ
লূই ভণই গুরু পূছঅ জাণ।।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই
সুখ দূখেতেঁ নিচিত মরিঅই।।
এড়িঅউ ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস
সূনু পাখ ভিড়ি লাহুরে পাস।।
ভণইলূই আমহে ঝাণে দীঠা
ধমণ চবণ বেণি পিন্ডী বইঠা।।

আধুনিক বাংলায় রুপান্তরঃ

কায়া তরুর মত পাঁচটি তার ডাল
চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করেছে।।
দৃঢ় করে নাও মহাসুখ পরিণাম
কবি লুই বলছে গুরুকে জিজ্ঞাস করে জান।।
সমস্ত সমাধিতে কি করে
সুখ দুঃখে নিশ্চিত মরা।।
এড়িয়ে যাওয়া যায় ছন্দ ও করণের পারিপাট্য
শূন্য পাখা পাশে চেপে ধর।।
লুই বলছে আমি স্বপনে দেখেছি
ধমণ চমণ দুই পিঁড়িতে আমি বসে।।
(ছন্দ=বাসনা, করণ=ইন্দ্রিয়চেতনা)


ধারনা করা হয়, ক্কুকুরীপা ছিলেন চর্যাপদের একমাত্র নারী কবি। তবে এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। ক্কুকুরীপা রচিত অতিপরিচিত দুটি পদঃ

দিবসহি বহূড়ী কাউহি ডর ভাই
রাতি ভইলে কামরু জাই।। (২ নং পদ)

অর্থাৎ, দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয়, কিন্তু রাত হলেই সে কামরূপ যায়।


ঢেগুনপার রচিত ৩৩ নং পদে আবহমান বাঙালির চিরায়ত দারিদ্র্যের ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমনঃ

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।।

অর্থাৎ লোকশুন্য স্থানে প্রতিবেশীহীন আমার বাড়ি। হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক এসে ভিড় করে।


ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ভুসুকপা ছিলেন পূর্বঙ্গের লোক। তাঁর রচিত ৪৯ নং পদে পদ্মা (পঁউআ) খালের নাম আছে, ‘বাঙ্গাল দেশ’ ও ‘বাঙ্গালী’র কথা আছে। তাঁর রচিত পদসমুহের মাঝে বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
ভুসুকপা রচিত অতিপরিচিত একটি পদঃ

অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।। ( ৬ নং পদ )


সুত্রঃ ড. সৌমিত্র শেখর, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা।
http://en.wikipedia.org
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×