somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্পয়লার মুভি রিভিউ – হিউগো (Hugo, 2011)

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা খুব সহজেই মুগ্ধ হয়, মুগ্ধ হতে ভালোবাসে। আমি তাদেরই দলে। কিন্তু আপনি যখন মুভি দেখতে বসে চলচ্চিত্র পরিচালক মহান মার্টিন স্করসেস, অভিনেতা বেন কিংসলে আর আশা বাটারফিল্ডের রসায়নে পড়ে যাবেন, আমি বাজি ধরে বলতে পারি আপনি যত বড় সিনেমাবোদ্ধাই হোন না কেন মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।

১৯৩১ সালের গল্প। ১২ বছরের এক এতিম বালক, হিউগো ক্যাব্রেট (Asa Butterfield) প্যারিসের গ্যারে মন্টপারনেস (Gare Montparnasse) রেইল স্টেশনের দুই দেয়ালের মাঝে লুকিয়েবসবাস করত, স্টেশনের ঘড়িটা দেখভাল করত যেন ওটা ঠিক সময় দেয়, আর বেঁচে থাকার জন্য স্টেশনের খাবার দোকানগুলো থেকে খাবার চুরি করে খেত।

খুব ছোট বেলায় হিউগোর মা মারা যায়। এর পরে, আর বিয়ে করে নি ওর বাবা ((Jude Law)। ছেলেকে এমনভাবে বড় করে তুলেছে সে, কখনোই মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি ওকে। সে ছিল প্যারিসের নাম করা ঘড়ির কারিগর। বিভিন্ন নষ্ট ঘড়ি, যন্ত্রপাতি মেরামত করাতেই তার যত আনন্দ। আর এই আনন্দটাই ছুঁয়ে গিয়েছিল শিশু হিউগোর মনে। ওর বাবা মুভি দেখতে খুব ভালোবাসত। ছেলেকে নিয়ে যেত মুভি দেখতে, তার জীবনের দেখা প্রথম ও সবচেয়ে প্রিয় মুভি জর্জ মিলিয়েস (Georges Méliès) প্রযোজিত ও পরিচালিত Voyage to the Moon (1902) এর গল্প শোনাত ছেলেকে।

একবার স্থানীয় এক মিউজিয়াম থেকে ভাঙা একটা রোবট (automaton) নিয়ে আসে ওর বাবা মেরামত করার জন্য। এরপর থেকে, সেই রোবট মেরামত করাটাই হয়ে উঠে দুই বাপ-বেটার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু একটা অগ্নি-দুর্ঘটনায় হঠাৎ করেই মারা যায় হিউগোর বাবা। থেমে যায় হিউগোর লেখা-পড়া, ঠাঁই হয় গ্যারে মন্টপারনেসে মাতাল ঘড়ির কারিগর চাচা ক্লাউডের (Ray Winstone) কাছে। ওর চাচা ওকে গ্যারে মন্টপারনেসের ঘড়িটার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। একা হয়ে যায় হিউগো। বড় নির্মম এই পৃথিবীতে তবুও ও বেঁচে থাকে, ওর বাবার স্বপ্ন, বাবার আদর্শ বাঁচিয়ে রাখে ওকে। সেই রোবটটি মেরামত করার জন্য সে স্টেশনের পাশের খেলনার দোকান থেকে নিয়মিতভাবে বাবার নোটবুকে আঁকা নকশা অনুযায়ী পার্টস চুরি করে। ওর বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন ওরা দুই জন একসাথে জুলভার্ণের দুঃসাহসিক অভিযানের বইগুলো পড়ত, একসাথে সিনেমা হলে যেয়ে মুভি দেখত। এখনও ও চুরি করে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে নতুন আসা মুভিগুলো দেখে নিয়মিত।

এক দিন রবোটটার জন্য একটা পার্টস চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়ে যায় পাপা জর্জ (Ben Kingsley) এর কাছে। উনি ওর বাবার আঁকা নোটবুকটা চোরাই বলে, নিজের কাছে নিয়ে নেন। এরপর থেকে হিউগো আঠার মতো লেগে থাকে পাপা জর্জের পিছে, সারাদিন ঘুরঘুর করে, উনার পিছনে পিছনে উনার বাড়ি পর্যন্ত যায় নোটবুকটা ফিরে পাবার আসায়। বিরক্ত পাপা একদিন ছাই দেখিয়ে বলে, এই যে তোর নোটবুক।

পুরো মুভিতে আমরা যে দুরন্ত, সৌম আর কষ্টকে অক্লেশে মেনে নেয়া বিষ্ময় বালক হিউগোকে খুঁজে পাই, নোটবুকের ছাই দেখে কান্নায় ভেঙে পড়া হিউগোকে তার সাথে মেলানো কষ্ট হয়ে যায় দর্শকের কাছে। বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে ছোট্ট হিউগোর অভিব্যক্তি দেখে দর্শক বুকের মাঝে যে কষ্টটা অনুভব করেছিল, বাবার নোটবুকের ছাই দেখে সেই হিউগোর কান্নায় দর্শকও যেন কেঁদে ভারমুক্ত হয়।

এই নোটবুক উদ্ধার করতে যেয়েই হিউগোর সাথে পরিচয় হয় পাপা জর্জের পালিত নাতনি ইসাবেল (Chloë Grace Moretz) এর সাথে। সম-বয়সী ইসাবেলও ওর মতই এতিম বালিকা। ওদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, ও ইসাবেলের কাছে জানতে পারে পাপা জর্জ আসলে ওর নোটবুকটি পুড়িয়ে ফেলেন নি। এতে হিউগো আশাবাদী হয়ে উঠে নোটবুকটি ফিরে পেতে। ইসাবেল যার পৃথিবী শুধু বইয়ের রাজ্যে সীমাবদ্ধ, অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় হিউগোকে সাহায্য করতে রাজী হয়ে যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে এক দশকও হয়নি। ভেঙে পড়া ফ্রান্সে অর্থনীতি নতুন করে গড়ে উঠছে আবার, এমন একটা অস্থির সময়কে ধারণ করেছে এই মুভিটি। যুদ্ধে পা হারানো এক সৈনিক (Sacha Baron Cohen) এই স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনস্পেক্টর, তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে স্টেশনের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে আসছে সুনামের সাথে। হিউগোর নির্ঝঞ্জাট প্রতিদিনের জীবনে এই ইন্সপেক্টরই একমাত্র উপদ্রব। তবুও দর্শকরা রাশভারী ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিররূপী ইন্সপেক্টরের এই চরিত্রের কারণে কিছুটা বিনোদন খুঁজে পাবেন। সুকঠিন চরিত্রের এই ইন্সপেক্টরের ভালোবাসা আকাঙ্ক্ষী কোমল হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে দর্শকও মোহিত হবে হয়ত।

হিউগোর নোটবুক ফিরে পাবার এই অ্যাডভেঞ্চারে, দর্শক খুঁজে পায় ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি জর্জ মিলিয়েস (Georges Méliès)কে। যিনি একক প্রচেষ্টায় প্রথম দিকের চলচ্চিত্রশিল্পকে দিয়ে গেছেন সুগভীর ভিত্তি। যিনিই প্রথম চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন ইল্যুশন, হরর, সাইন্সফিকশন।

মার্টিন স্করসেসকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। যিনি Taxi Driver (1976), Raging Bull (1980), Goodfellas (1990), Casino (1995), Aviator (2004), The Departed (2006), Shutter Island (2010) এর মত অসংখ্য মহাকাব্যিক সব মুভি একের পর এক উপহার দিয়ে শুধু নিজেকেই নিরন্তর ছাড়িয়ে গেছেন, তাঁকে আর নতুন করে নিজেকে প্রমাণের কিছু নেই। ব্রিয়ান সেলৎসনিকের (Brian Selznick) এর উপন্যাস ‘দ্য ইনভেনশন অফ হিউগো ক্যাব্রেট’ (The Invention of Hugo Cabret) এর প্রধাণ চরিত্র ‘হিউগো’কে নিয়ে এবার স্করসেস তাঁর চলচ্চিত্রের ঝুলিতে যোগ করলেন আরও একটি নতুন রত্ন। ‘হিউগো’ দিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করলেন 3D চলচ্চিত্র নির্মানে, এবং নির্মান কুশলীতে ছাড়িয়ে গেলেন জেমস ক্যামেরুনের কিংবদন্তী 3D মুভি The Avatar (2009) কেও।

The Boy in the Striped Pajamas (2008) মুভিতে ব্রুনো চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করা আশা বাটারফিল্ড, এবার হিউগো চরিত্রে অভিনয় করে যথারীতি আলো ছড়িয়েছে পুরো মুভিতে।

মুভিটি আপাতদৃষ্টিতে শিশুতোষ মুভি মনে হলেও, এর মাধ্যমে মার্টিন স্করসেস চলচ্চিত্র শিল্পেরই জয়গান গেয়েছেন। এই শিল্পের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে এর মাধ্যমে। জর্জ মিলিয়েসের ছায়ায় দর্শক যেন বারে বারে খুঁজে পেয়েছেন আমাদের সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তী মহান মার্টিন স্করসেসকেই।

‘আমার মনে হয়, সমগ্র পৃথিবীটাই একটা বড় যন্ত্র। তুমি জান, যন্ত্রে কখনো অতিরিক্ত পার্টস থাকে না। ওগুলো সব সময়ই ঠিক যতগুলো পার্টস লাগে, তা দিয়েই গড়ে উঠে। আমি সিদ্ধান্তে পৌছেছি, সমগ্র পৃথিবীটাই যদি একটা বড় যন্ত্র হয়, আমি কোন অতিরক্ত পার্টস নই। আমি এই পৃথিবীতে জন্মেছি কোন একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যই। আর তার মানে, তুমিও ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যই জন্মেছ।’

এত অসাধারণভাবে বারো বছরের একটা শিশুর জীবনযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন স্করসেস, তাই তার এই আপাত পরিণত সংলাপটাকে এতটুকুনও বেমানান মনে হয়নি মুভিটিতে।

Paramount Pictures এর ব্যানারে ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভিটি অস্কারের ৮৪ তম আসরে Best Picture সহ মোট এগারো ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল এবং Best Cinematography, Best Art Direction, Best Visual Effects, Best Sound Mixing, ও Best Sound Editing সহ মোট পাঁচটি পুরস্কার জিতে নিয়েছে। এছাড়া, BAFTA Award এ দুটি পুরস্কার, Golden Globe Award এ Best Director সহ ৩টি পুরস্কার জিতে নিয়েছে এই মুভিটি। এছাড়া, মুভিটির IMDB Rating 7.7/10, আর রোটেন টম্যাটোতে এটি পেয়েছে ৯৪% ফ্রেস মুভির স্বীকৃতি। মুভিটির টরেন্টস ডাউনলোড লিংক

সূত্র:
১। উইকিপিডিয়া ডট ওআরজি
২। আইএমডিবি ডট কম
৩। রোটেনটম্যাটোস ডট কম



সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ২:৩৭
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×