এ দেশ কোন কালেই শ্রমিক বান্ধব ছিল না। মোগল, বৃটিশ বা পাকিস্তান যারাই ছিল তারা সব সময় ছিল অভিজাত শিল্প মালিকদের পক্ষে। সেই ভুত আজও আমাদের প্রশাসনের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। প্রশাসন সব সময় মুখস্থ ধরে নেয় শ্রমিক মানে নিচু জাত, খারাপ জাত। আর শিল্প মালিক মানে দেশ দরদী, সমাজের উপকারী শ্রেণী। এই উপনিবেশিক ধ্যান ধারণার কারণে আমাদের দেশে শ্রমিক নির্যাতন হয়, এ বিষয়টি বোঝেন না প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা, বোঝেন না শিল্প মালিকরা। তারা ধরেই নেন, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়তে হলে শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণ করতে হবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানী খাত গার্মেন্টস হলো কেন ? কারণ এ খাতে সবচেয়ে সহজে শ্রমিক শোষণ ও নির্যাতন করা যায়। এ খাতের শ্রমিকরা বোঝেই না, তাদের শোষণ করা হচ্ছে।
পৃথিবীর সব দেশে শ্রমিক শ্রেণীর সর্বনিন্ম মজুরি ধার্য আছে। আমাদের দেশে এই তো সেদিন গার্মেন্টস সেক্টরে প্রবল আন্দোলনের ফলে গার্মেন্টস মালিকরা নূ্নতম মজুরি ১৬০০ টাকার মতো মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আসলে কি তারা মেনে নিয়েছেন ? এখনও বেশির ভাগ ছোট গার্মেন্টসে শ্রমিকদের ৭/৮ শত টাকা বেতন দেয়া হচ্ছে।
কাজের সময় ৮ ঘণ্টা। গার্মেন্টসের কাজের সময় ১২ ঘণ্টা। সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা। বিকেল ৫টার পর ৩ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক ওভার টাইম। সুযোগ পেলেই এই ওভার টাইমের টাকা মেরে দেয় মালিকপক্ষ। নানা তালবাহানা করে এ টাকা আটকে রাখে।
১২ ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি প্রায় সারা রাত কাজ করানো হয়। এসব অতিরিক্ত সময়ে কাজের টাকা নিয়ে অনর্থক ঘাপলা হয়।
অন্য দিকে সকাল ৮ থেকে ৫ মিনিট লেট করে এলে লাল কালি দিয়ে রাখা হয় তার উপস্থিতির খাতায়। তিন দিন লাল কালি পড়লে একদিনের বেতন কেটে রাখা হয়। এমন কোন শ্রমিক নেই যার প্রতিমাসে বেতন কাটা যায় না।
অন্যদিকে মালিকপক্ষের লোকজনের চরম দুর্ব্যবহার কহতব্য নয়। গালাগালি যত খারাপ হতে পারে। প্রায় মার খেতে হয় শ্রমিকদের। গালাগালি বা মারধোরকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হয়েছে।
গার্মেন্টস সেক্টরের আরেকটি উপদ্রব হল ঝুট ব্যবসা। কাগজে কলমে এ ব্যবসা অবৈধ হলেও বাস্তবে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের প্রথম পছন্দ ঝুট ব্যবসা। ক্যাডার থেকে স্থানীয় এমপি পর্যন্ত জড়িত থাকে ঝুট ব্যবসায়। এই ঝুটের কারণে স্থানীয় সন্ত্রাসী তথা রাজনৈতিক ক্যাডারদের সাথে সখ্য থাকে গার্মেন্টস মালিকের। এই সখ্য ব্যবহার করে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেয়া হয় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। কোন শ্রমিক তাদের উপরে শোষণ করার প্রতিবাদ করলে তাকে সাইজ করে এসব ক্যাডাররা।
গার্মেন্টস মালিকরা এত শোষণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কেন কোন ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন ? কেননা লেবার অফিসে মোটা অঙ্কের ঘুষ পাঠানো হয় নিয়মিত। লেবার অফিসের লোকজনও বসে থাকে ঘুষের জন্য। ঘুষ না পেলে ওই গার্মেন্টসের খবর আছে। ফলে লেবার অফিসের লোকজন শ্রমিকদের কোন স্বার্থ দেখে না।
কিছু শ্রমিক সংগঠন আছে যারা শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার নামে মালিকের সর্বনাশ করতে নামে। তাদের উদ্দেশ্য হল, মালিককে অরাজকতার ভয় দেখিযে নিজের পকেটে মোটা টাকা ভরা। শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলার ভয় দেখিয়ে অনেক তথাকথিত শ্রমিক নেতা মালিকের টাকায় কোটিপতি হয়েছেন।
মালিক, প্রশাসন ও শ্রমিক নেতা এই তিন শোষক ও ভণ্ডের মাঝখানে থেকে এদেশের শ্রমিক শ্রেণী কিভাবে ভালো থাকতে পারে ? আজ মে দিবসে অনেক অনুষ্ঠান হবে তাদের জন্য। আসলে কি এসব দরকার আছে ? এসব ভণ্ডামি ও প্রহসন করে কি দেশের কোন লাভ আছে ?