তখন এইচ.এস.সি প্রথম বর্ষে পড়ি। লিকলিকে স্বাস্থ্য এবং গাল-বসা চেহারা নিয়ে মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াই। আহা, অনেকের কত সুন্দর চেহারা, কত সুন্দর স্বাস্থ্য, আমার কেন নাই বিধাতা ?
ফিজিক্স পড়তাম এক শিক্ষকের কাছে। একদিন তার ব্যাচে দেরিতে পৌছেছি। তার আগেই আমাকে নিয়ে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। শিক্ষক মহোদয় আমার নাম স্মরণ করতে না পেরে অন্যদের জিজ্ঞাসা করলেন , এমুন এমুন ছেলেটা কোথায় ?
অন্যরা তো বুঝতে পারল না, এমুন এমুন ছেলে আসলে কে । তারা একজন আরেক জনের দিকে তাকাল। স্যার মহোদয় তার সুডৌল গালের উপর হাত দিয়ে অবতল লেন্স তৈরি করে বললেন, এমুন এমুন।
এবার সবাই বুঝে ফেলল সেই হতভাগা আমি ছাড়া আর কেউ না। আমার এক সহপাঠী মধুর গলায় উত্তর দিল, স্যার, এমুন এমুন (যথারীতি গালের কাছে অবতল লেন্স দেখিয়ে) ছেলেটা স্যার বাইরে, রিক্সাওয়ালার টাকা ভাঙ্গাতে গেছে।
এই প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সকাল বেলাই একটা হাস্যরস হয়ে গেল।
আমি তো এত ঘটনা জানি না। নিপাট ভদ্রলোকের মধ্যে স্যারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মে আই কাম ইন, স্যার ?
স্যার উত্তর দেয়ার আগেই দেখি, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি নিজের দিকে ভালো করে তাকালাম। পোশাক আশাকে কোন সমস্যা আছে কিনা। বিশেষত পোস্ট অফিস খোলা কিনা সেইটা ভালো করে দেখলাম। না, কোন সমস্যা নাই। তাহলে পাবলিক হাসে কেন ?
স্যার আমাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। আমি বসতে না বসতেই স্যার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। বুঝলাম, এভরিথিং রং। কোন বড় সমস্যা তৈরি করেছি। আমি একবার এর দিকে তাকাই, ওর দিকে তাকাই। দেখি যার দিকেই তাকাই, সে-ই হাসে। বড় বিপদে পড়লাম।
সেই দিন পড়া থেকে বেরিয়েই আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠীকে চেপে ধরলাম। ব্যাপারটা কী, সবাই আমাকে দেখলে হাসে কেন ? বন্ধুও দেখি কিছু না বলে কেবল হাসে।
অবশেষে তার হাসি-রোগ সারার পর কাহিনী খুলে বলল। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, ওই ব্যাটার কাছে পড়ব না। কিন্তু উনি এত ভালো পড়ান যে, আবার ফিরে যেতেই হল।
মাঝখান থেকে ওই ব্যাচে আমার নাম হয়ে গেল এমুন এমুন ছেলেটা।
০২.
চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে না এমন মানুষ বিরল। আমরা সবাই জীবনের কোন না কোন মুহূর্তে চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগি। কখনও কারো মন্তব্যে, কখনও কারও উপহাসে, আমরা নিজের চেহারার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।
বিশেষত মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন চেহারা নিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়ে যায়। যখন চাকুরির ইন্টারভিউয়ে ফেইল মারে, তখনও মনে হয় চেহারাটা আরেকটু স্মার্ট হলে হয়তো হয়ে যেত। আবার বিয়ে সময়ও চেহারা নিয়ে দুশ্চিন্তা কম হয় না। চেহারাটা আর একটু সুন্দর হলে হয়তো পাত্র পক্ষ পছন্দ করেই ফেলত।
আসলে প্রত্যেক মানুষই জন্মায় সুন্দর হয়ে । এ জন্যই শিশুরা সব সময়ই সুন্দর। অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, কোন বদ অভ্যাস, মাদকাসক্তি ইত্যাদির কারণে চেহারা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের যত্ম নিলে - বিশেষত খাবার, বিশ্রাম ও ব্যায়াম করলে মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো হয়, সঙ্গে সঙ্গে চেহারাও ।
নায়িকা রেখা প্রথম বয়সে দেখতে অনেক কুশ্রী ছিলেন। কিন্তু এই রেখাই একটা বয়সের পর সৌন্দর্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছিলেন। নায়িকা রেখা তার এই সৌন্দর্যের জন্য যোগব্যায়ামকে সাধুবাদ দেন। অধুনা শিল্পা শেঠি আরেকটি উদাহরণ। শিল্পা শেঠীও প্রথম জীবনে দেখতে সুন্দর ছিলেন না। কিন্তু যোগ ব্যায়াম করে তিনি এখন নজর কাড়া সুন্দরী। তার একটা বিখ্যাত যোগ ব্যায়াম শেখার ডিভিডিও বাজারে আছে।
যারা অভিনেতা এবং মডেল - তাদের চেহারা দিন দিন ভালো হতে থাকে। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে তাদের যে রকম চেহারা ফিগার থাকে, কয়েক বছর পর দারুণভাবে সুন্দর হয়ে ওঠে। কারণ তারা নিজেদের যত্ন নেন।
০৩.
আমি কখনও মডেল ছিলাম না। মডেল হওয়ার কোন ইচ্ছাও কোন কালে ছিল না। আমার বিখ্যাত বড় ভাই ও ফটোগ্রাফার এটিএম জামাল আমার কিছু ছবি তুললেন। ছবি তোলার পর আমি তো অবাক । আমার সেই এমুন এমুন চেহারা তার অভিজ্ঞ ও সৃষ্টিশীল ক্যামেরার কারিশমায় বদলে গেছে।
ফ্যাশন ফটোগ্রাফার এটিএম জামাল ছবি তোলেন ভাল। ফটোগ্রাফার হিসেবে তার দক্ষতা অসাধারণ। লাইট ও ক্যামেরা এঙ্গেল মিলিয়ে এমন একটা ভঙ্গি বের করে আনেন মডেলের, যে অবাক হতে হয়। তিনি ফ্যাশন মডেলিং এর জন্য একজন উপযুক্ত ফটোগ্রাফার।
এটিএম জামাল ফটোগ্রাফির পাশাপাশি দেশীয় একটা বুটিক হাউজের মালিক। নারায়ণগঞ্জে তার নকশা নামের বুটিক হাউজটি এক নামে সবাই চেনে। নকশার একটা শাখা চালু হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকায়। সেই নতুন শাখা উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি কিছু ফেস্টুন ডিজাইন করেছেন। সেই ফেস্টুনে মডেল হিসেবে নিয়েছেন হতভাগা এমুন এমুন আমাকে !
এই সেই এমুন এমুন ফেস্টুন।
০৪.
আমার সেই শিক্ষক মারা গেছেন বেশ কিছুদিন আগে। আজ বুঝি তিনি হয়তো আমাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন। কিন্তু তার এই ঠাট্টা আমার জীবনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। আমি সব সময় আমার চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতাম। অনেক পরে এই হীনমন্যতা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু যদি না কাটত তবে একটা জীবন হীনমন্য হয়েই কাটিয়ে দিতে হত।
শিক্ষকদের একটা বাক্য ছাত্রদের জীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে। তাই যারা শিক্ষক তারা যেন হুট করে কোন ছাত্র সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করেন। সেই মন্তব্যের বিষময় ফল হয়তো ছাত্রটাকে সারা জীবন বহন করতে হয়।
আল্লাহ আমার সেই বিখ্যাত শিক্ষককে বেহেশত নসীব করুন।
ফটোগ্রাফার এটিএম জামালের তোলা আরও কিছু ছবি
পুনশ্চ :
ইদানিং যাই লেখি সবই কেবল নিজের ঢাক-ঢোল ফাটানো হয়ে যায়। ব্লগিং ছেড়ে দিতে হবে মনে হয়। সবাই এক সময় বুড়ো হয়, ব্লগারও।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




