শৈশবে এক্সসিবিশনে গিয়ে দেখতাম বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ বোতলে ভরা। সেই বোতল দেখে অবাক তাকিয়ে থাকতাম। একবার বড় বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই মৃতদেহগুলো পচে না কেন ? উনি বলেছিলেন, এগুলো ফরমালিন দেয়া।
সেই থেকে জানতাম, ফরমালিন মৃতদেহে ব্যবহার করার জিনিস।
কিন্তু এই পরিণত বয়সে এসে জানি, ফরমালিন এখন আমাদের জাতীয় খাদ্য। আমরা যা কিছুই খাচ্ছি, তার প্রায় ৮০ ভাগ ফরমালিনে চুবানো। ফরমালিন খেয়ে খেয়ে ক্যান্সারের মহামারি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আমাদের দুর্নীতিবাজ আমলা এবং রাজনীতিবিদরা তাদের পকেট ভরায় ব্যস্ত। আমরা বিষাক্ত ফরমালিন খেয়ে ধুকে ধুকে ক্যান্সারে মারা গেলে তাদের কিছু আসে যায় না।
এবার পড়ুন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর একটি প্রতিবেদন :
২৮ জুলাই ২০১৩
ইফতারি, ফল ও খাদ্যের সংগৃহীত নমুনার ৮২ শতাংশ ফরমালিনযুক্ত
মহানগরী ঢাকায় ইফতারি, ফলসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সমাহার থাকলেও এগুলো বিষাক্ত কেমিক্যাল তথা ফরমালিনমুক্ত কিনা এ ব্যাপারে ক্রেতা নিশ্চিত হতে পারছেন না। ঈদে সেমাই এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় নিম্নমানের দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরী করা হয়। এছাড়াও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফল পাকানো, সতেজ রাখা ও সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা হ্েচ্ছ বিষাক্ত ক্যামিকেল। নানা ধরনের বিষাক্ত ও নিম্নমানের খাদ্যের কারণে আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। ভেজাল খাদ্যে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। কিছু খাবার এমনই বিষাক্ত যে তা ডিএনএকে পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। ফরমালিনযুক্ত খাবার মানুষের শরীরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এসব খাবার গলায় ক্যান্সার ও রক্ত ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শিশুদের ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি ও লিভার পচে যাওয়া, রক্ত সরবরাহ বিঘিœত হওয়া, অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কিডনি রোগে ভুগছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ঢাকার বিভিন্ন স্থানের ইফতারি, ফলসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ফরমালিন পরীক্ষা করে। পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন আজ ২৮ জুলাই ২০১৩, রবিবার, সকাল ১১:০০ টায় পবা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলনে Z-300 Formaldehyde Meter ও Chromotropic Acid দ্বারা ফরমালিন পরীক্ষা করে দেখানো হয়।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের আলোকে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন-পবা’র সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক আসলাম খান, নির্বাহী সদস্য শামীম খান টিটো, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়- শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ - মাংস, দুধ, মিষ্টি, প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয়, ইফতারিসহ প্রায় সব ধরনের খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও ভোক্তা অধিকার কর্মীদের বক্তব্যে, এফবিসিসিআই-এর বক্তব্যে, গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ ও প্রতিবেদনে এবং সা¤প্র্রতিক সময়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) -এর ‘নফতারি, ফল ও খাদ্যে ফরমালিন পরীক্ষার ফলাফল’ এ বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
বিভিন্ন খাদ্যেদ্রব্যে ফরমালিন পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ -
বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে ব্যাপক হারে ফরমালিন ব্যবহারের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের উপস্থিতি পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ১৩ জুন থেকে ২৬ জুলাই ২০১৩ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর ২৯টি এলাকা থেকে আমের ৬১টি, কলার ২৩টি, মালটার ২৯টি, আপেলের ২৭টি, আঙ্গুরের ১৯টি, খেজুরের ৩১টি, টমেটোর ১২টি, বেগুনের ৫টি, শশার ৫টি এবং অন্যান্য সবজির ৯টি, সেমাইয়ের ২৩টি, নুডুলসের ১৯টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব ফল বিভিন্ন বাজার ও এলাকা হতে ক্রয় করে পবা কার্যালয়ে Chromotropic Acid এবং Z-300 Formaldehyde Meter দ্বারা পরীক্ষা করা হয়।
প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, ফরমালিন পরীক্ষার জন্য সংগৃহীত ২৬৩ টি নমুনার মধ্যে ২১৫ টিতে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা মোট নমুনার ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ আম, ৯১ শতাংশ কলা, ১০০ শতাংশ মাল্টা, ৫৯ শতাংশ আপেল, ৯৫ শতাংশ আঙুর, ৭৭ শতাংশ খেজুর, ৭৫ শতাংশ টমেটো, ২০ শতাংশ শশা, ৬০ শতাংশ বেগুন, ১০০ শতাংশ সেমাই এবং ৯০ শতাংশ নুডুলসে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
সুপারিশ
১. নিরাপদ খাদ্য আইনের আওতায় গঠিত কর্তৃপক্ষের সাথে ভেজালবিরোধী বা খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনাকারী অন্য সরকারী সংস্থা ও পরীক্ষাগারগুলোর কাজের সমন্বয়ের বিষয়টি নিরাপদ খাদ্য আইনে উল্লেখ থাকতে হবে।
২. নিরাপদ খাদ্য আইনটি জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে অনুমোদনপূর্বক বাস্তবায়ন করতে হবে । একই সাথে এ আইন কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশানোর সাথে জড়িত ও রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদানই যথেষ্ট নয়। এদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই আইনের ২৫-গ ধারায় খাদ্যে ভেজাল দেয়ার জন্য কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল খাবার বিক্রয়ের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
৪. নিয়মিতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা এবং বিদ্যমানসমূহ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
৫. জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজাল রোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৬. টিসিবির মাধ্যমে ফরমালিন আমদানি করা এবং টিসিবি শুধুমাত্র সরকারি লাইসেন্সধারীদের কাছে ফরমালিন বিক্রি করবে। ফরমালিন ব্যবহার ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
৭. খাদ্যে বিষ মেশানোর সাথে জড়িত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৮. ভেজাল বিরোধী টিম কর্তৃক খেজুর, কলাসহ অন্যান্য ফল, সকল খাদ্য মজুদকারী গুদাম/কারখানা /মোকাম বিশেষ করে সেমাই, মুড়ি, চিড়া কারখানা পরিদর্শন করা এবং জড়িত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যমান আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৯. খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং পরিদর্শন ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনায় সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের সাধন করা।
১০. পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক ফরমালিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা। এলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
১১. গণমাধ্যমে প্রচার- প্রচারণার মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিষয়ে সচেতন করা এবং স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের দিকগুলো তুলে ধরা।
১২. খাদ্যের বিষমুক্ততা নিশ্চিত হয়ে গণমাধ্যমে খাদ্য সামগ্রীর বিজ্ঞাপন প্রচার করা।
১৩. বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় সরকারিভাবে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে খাদ্যে রাসায়নিকের পরিমাণ চিহ্নিত করার জন্য স্থাপিত পরীক্ষাগারটির জন্য জরুরীভিত্তিতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগপূর্বক তা চালু করা।
১৪. বিভিন্ন সংস্থার পরীক্ষাগারগুলোর বিদ্যমান ক্যাপাসিটি কাজে লাগানো, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পরীক্ষাগারগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়নসাধন করা।
১৫. ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে তাদের পরিবার-পরিজন সর্বশান্ত হচ্ছে। তাছাড়া রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। রাসায়নিকের মিশ্রণে বিষাক্ত খাদ্যের কারণে সৃষ্ট এ বিপর্যয় রোধে সরকারীভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।
ধন্যবাদসহ
(আতিক মোরশেদ)
কো-অর্ডিনেটর
০১৮১৪৩৮২৩৪০
আমার দাবী :
ইউরোপীয় ইউনিয়নভু্ক্ত কোন দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নাই। এমনকি মানুষ খুন করলেও ভয়ংকর খুনীরও মৃত্যুদণ্ড হয় না। কিন্তু খাদ্য ও ঔষধে ভেজাল করলে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। কারণ একজন খুনী মাত্র একজন মানুষকে খুন করে, আর একজন খাদ্যে ভেজালকারী গোটা জাতিতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রণ করার শাস্তি সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দেয়া দাবি জানাই। কারণ যারা খাদ্যে বিষ মেশায় তারা হাজার হাজার মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ভয়ংকর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোন শাস্তি হতে পারে না। মৃত্যুদণ্ড ছাড়া এই ভয়ংকর অপরাধ ঠেকানোর কোন পথ নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



