বিভাগ : গল্প
পাহাড় বিক্রেতা নজরুল অনুষঙ্গ...
'আমাদের এক বন্ধু পাহাড় বিক্রি করতো' শীর্ষক মোস্তাফিজ রিপনের পাকা হাতের গল্প। নজরুল পাহাড়া বিক্রি করে কথাটি শুনতেই একটা ধাক্কা লাগলেও তা কেটে যায় যখন আমরা জানি, নজরুল আসলে একজন পাহাড় ব্যবসাযী; তখন প্রাথমিক বিভ্রান্তির ভাবটা কেটে গিয়ে নজরুলের পাহাড় ব্যবসায় সম্বন্ধে ঔৎসুক্য জন্মে পাঠকের। কিন্তু গল্পের নামকরণে পাহাড় বিক্রেতার প্রসঙ্গটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ তা গল্পে নজরুলের চারিত্রিক অবস্থানের বিবেচনায় পূর্ণার্থে সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ নজরুলের চেয়ে গল্পে প্রধান হয়ে উঠেছে আমলা আরিফ এবং 'আমরা' সর্বনামে উপস্থাপিত কতিপয় বেপথু যুবক। এই যুবকেরা তাদের আমলা বন্ধু আরিফের নিকট থেকে অবৈধভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে টেন্ডারবাজি কিংবা চাঁদাবাজি অথবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। গল্পের এই সমতলেও পাঠক থিতু হওয়ার আগেই তাহেরের চায়ের দোকানে বিপথগামী যুবকেরা যখন আরিফের স্ত্রীর খুন হওয়ার সংবাদ পরিবেশন করে, তা আরো নাটকীয় হয়ে ওঠে। এবং এই নাটকীয় পরিস্থিতির চরম বিপর্যয় ঘটে যখন-- যুবকেরা তাদের ছয় ইঞ্চি পরিমাণ ছোড়াটা সরকারি আমলা বন্ধু আরিফের বুকে আমূল বসিয়ে তাকে মুক্তি দেয়। এর ফলে পাঠকের নিকট লেখক তাঁদের বিক্রেতা বন্ধু নজরুলের স্মৃতিচারণের কথাটি দীর্ঘসূত্রিতার বয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়াও মোস্তাফিজ রিপনের পাহার বিক্রি গল্পটির বড় দুর্বলতা হচ্ছে-- পাহাড় বিক্রির মূল নায়ক নজরুল সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্য এবং আরিফের স্ত্রীর হঠাৎ হত্যাকাণ্ডের কার্যকারণ নির্ধারণ না করা। সামগ্রিকভাবে গল্পে কতিপয় সন্ত্রাসী যুবকের অসংলগ্ন যাপিত জীবনের জীবনকথা মানের। তবে একথা সত্য যে লেখকের গল্প বয়নরীতি শক্তিশালী ও প্রশংসার্হ্য।
গল্প : কালিদহের কূহক
এ গল্পটির লেখক তারিক স্বপন। গল্পটি সম্পর্কে আমার নতুন কিছু বলার নেই। কারণ, গল্পটি এর আগে ব্লগে পাঠ করেই আমি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলাম। তা নিচে উদ্ধৃত করলাম :
পিতামহ রুগ্ন শীর্ণ হাত নেড়ে যে বিরাট অতিকায় মাছের গল্প শোনাতে শোনাতে বিগত দিনকালের সুখস্মৃতির ভেতর হারিয়ে যেতেন আর আক্ষেপ করতেন তেমনি আমরাও বিশুষ্ক কালিদহের গল্প শুনে আক্ষেপ করি, কিংবা না করে উপায় থাকে না। এটাই নিয়ম, এভাবেই বদলে যায়, পিতামহ দুঃখ করেন আর উত্তরবংশ শোনে অথব শুনতে শুনতে সেইসব দিনকাল চোখের সামনে মূর্ত হতে দেখে। অথব শুধুই শোনে কিছুই ভাবে না। তবে উত্তরপুরুষের থেকে যায় অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা; কারণ সে বেদনার্ত এক জিন বহন করে চলেছে আদিকাল থেকেই নিজের শরীরে, যে বেদনার কখনোই উপশম হয় না। প্রত্যেক প্রজন্মের কাছেই অতীত দিনকাল সুখস্মৃতি হয়ে চাঁদের মতো মনের আকাশে ভেসে বেড়ায়। অথবা কিছুই হয় না, নিছক কথার মারপ্যাচে মানস জুড়ে ধুম্র কুয়াশার জালে ছেয়ে যায়।
নিঃসন্দেহে গল্পটি ভালো হয়েছে, যে কারণে আমার ভালো না লেগে উপায় ছিল না। ভীষণ ভালো লেগেছে। আবু কায়েসের মৃত্যুর পর তারিক স্বপন নিঃসন্দেহে কালিদহের কূহকে অনেক সাবলীল ও পরিপক্ক। তবে গল্পে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি সব শব্দ ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারেন নি বোঝা যায়। আশা করি এ ব্যাপারে তিনি পরবর্তী সময়ে আরো যত্নশীল হবেন।
গল্প লিখে যান। বলা বাহুল্য আপনার গল্পে মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, হুমায়ুন মালিক এবং প্রয়াত শহীদুল জহিরের ঢঙ দেখে যারপর নেই আশান্বিত হয়েছি। হয়তো আপনার হাতেই বাংলাদেশের গল্প-সাহিত্যের বিপ্লব সংঘটিত হবে।
আগ্রহী পাঠকগণ নিচের লিংক অনুসরণ করতে পারেন :
লিংক : Click This Link
ব্যাঘ্র শিকার ও জীবিকা...
'বনমজুর' গল্পের লেখক মাহবুব লীলেন সুন্দরবন অঞ্চলের বাঘ শিকারী আবদুল কাদের সরকারের পাকা হাতের বাঘ শিকার করার আদ্যোন্ত ঘটনা টানটান উত্তেজনায় চমৎকার বর্ণনা করেছেন। মৎস শিকারীর ছদ্মবেশে আবদুল কাদের সরকার বনরক্ষীদের ধোঁকা দিয়ে লুকানো রাইফেল তাক করে শিকারের অপেক্ষায় চুপচাপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বসে থাকে-- ফলে বাঘ মামা পাকা শিকারী কাদের সরকারকে ফাঁকি দিতে পারে না। নামের সাথে তার সরকার শব্দটি সংযুক্ত থাকলেও এর মহিমা বা মাহাত্ম্য বোঝে না আবদুল কাদের; অথবা বলা যায়, তা বোঝার দরকার হয় না-- জীবিকার্জনের জন্য। গল্পে এই সরকার বিষয়ক প্যারাডক্স নিম্নরূপ :
মানুষের বাঘ মারা নিষেধ। কিন্তু বাঘে যে হামেশা মানুষ মারে? সুন্দরবনের এমন কোনো বাঘ আছে যার পেটে যায়নি মানুষের মাংস? অথচ সরকার কিছুই বলে না এখানে। শুধু বাঘ কেন? হারিণ মারাও নিষেধ। কিন্তু হরিণ কি থাকে? হরিণ তো সব হয় বাঘের পেটে না হয় চোরা-শিকারির নৌকায় যায়।--পৃ.৪৯
বন্যপ্রাণী হত্যা করা সরকারি আইনে নিষেধ এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ নিয়ম জীবন ও জীবিকার তাগিদে আবদুল কাদেরের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব হয় না; কিংবা তার মতো বনমজুররা এই আইন মানার নাগরিক তাগাদাও অনুভব করে না। আবদুল কাদের বাঘ শিকার করে নিঃসন্দেহে সরকারি আইন অমান্য করে অপরাধ করেছে, তবে প্রাকৃতিক অলঙ্ঘনীয় নিয়ম হচ্ছে-- এক প্রাণীকে হত্যা করেই অন্য প্রাণীর জীবন ধারণ। আবদুল কাদের যদি বাঘ শিকার নাও করে, তথাপি কিন্তু সরকারি আইন রক্ষা করতে পারে না হরিণদের। কারণ, অন্য পশু হত্যা করেই বাঘের জীবন বাঁচে, আহার জোটে। সুতরাং নিরীহ হরিণের প্রাণ যদি সরকারি আইন রক্ষা করতে না পারায় কোন দোষ না হয়, তাহলে আবদুল কাদের বাঘ শিকার করলে-- তা দোষের হবে কেন? কারণ মানুষও তো প্রাণী বৈ অন্য কিছু নয়। ফলে কাদের সরকারের এই ব্যাঘ্র শিকার মানব নির্মিত আইনের চোখে অপরাধ হলেও বৃহত্তর প্রাকৃতিক নিয়মের বিবেচনায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত না হয়ে উপায় থাকে না।
গল্পকার মাহবুব লীলেনের ব্যাঘ্র শিকার এবং বনমজুর কাদের সরকারের জীবিকা উপার্জন বিষয়ক প্যারাডক্স এক কথায় চমৎকার ও পরিশীলিত গল্প। শিকারী কাদের এবং একটি বাঘ শিকারের এই ঘটনা জুড়ে গল্পকারের ঠাঁসবুনোন সাবলীল উপভোগ্য। তবে এ গল্পের দু'একটি বাক্যের অসঙ্গতি লেখকের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এছাড়া 'বনমজুর' গল্পটি ঝরঝরে একরৈখিক পরিণামমুখী সাবলীল কাহিনীবৃত্তে শিল্পসফল। গল্পকার মাহবুব লীলেনকে ধন্যবাদ এজ্ন্য যে, প্রাকৃতিক প্যারাডক্স ব্যবহার করে মানব সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চমৎকার একটি গল্প উপহার দেয়ার জন্য।
..............ক্রমশ দেখুন