রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায় চোর সন্দেহে এক যুবককে হাত-পা-চোখ বেঁধে মারধর করে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহত সেই যুবক দু'দিন চিকিৎসা শেষে মারা গেছে। নিহত যুবকের নাম শাকিল। সে পেশায় রিকশাচালক ছিল। তার স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার একটি আড়াই বছরের ছেলে আছে।
জানা যায়, কয়েক দিন আগে নর্দ্দার একটি বাড়ি থেকে কিছু বৈদ্যুতিক তার চুরি হয় (দাম ছিল প্রায় হাজার টাকার মতো)। সে সময় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চুরিতে জড়িত একজনকে শনাক্ত করা হয়। তাকে আটক করে মারধর করে চুরির ঘটনায় আর কেউ সম্পৃক্ত কি না এ তথ্য জানতে চায় বাসিন্দারা। এ সময় শাকিলের সম্পৃক্ততার কথা জানালে তাকে ডেকে নয় তলা বাড়ির ছাদে নিয়ে হাত-পা-চোখ বেঁধে মারধর করা হয়।
শাকিলের এক আত্মীয় জানান, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। এর কোনো তথ্য-প্রমাণও নেই। সেদিন রিকশা চালিয়ে শাকিল চা দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। দু'জন ছেলে এসে তাকে ডেকে নিয়ে যায়। নয় তলা বাড়ির ছাদে নিয়ে হাত-পা-চোখ বেঁধে তাকে মারধর করে।
এই ঘটনাটি নিয়ে বেশ কিছু গণমাধ্যমে (চ্যানেল ২৪, একাত্তর) সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু জনমনে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি ঘটনাটি। যেমন সাড়া ফেলতে পারেনি সেই ঘটনাটি, যে মহিলা তার সন্তানকে ঢাকার এক নামকরা স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য এক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদের এটা-ওটা জিজ্ঞেস করেছিল। আধ পাগল মহিলাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
এ দু'টো নয় কেবল, বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই এভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। আলোচনা হয় যেসব ঘটনায় ধর্মের ফ্লেভার থাকে।
ফরিদপুরের ঘটনার কথাই বলা যাক। মন্দিরে আগুন লাগার ঘটনায় কয়েকজন নির্মাণশ্রমিককে যে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলল, এই ঘটনাটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। করবেই বা না কেন উত্তেজিত জনতা যে হিন্দু। মূল অপরাধী দু'জনও হিন্দু। কোনো হিন্দু ব্যক্তিকে এভাবে হত্যার পর হিন্দু জনতা যেমন জেগে উঠত, মুসলিম হত্যায় মুসলিম জনতা তেমনই জেগে ওঠেছে। অথচ উচিত ছিল মানুষ হিসেবে সচেতন হওয়া, বিচার দাবি করা। কারণ, একজন খুনিকেও পিটিয়ে হত্যা সভ্য সমাজের নিয়ম নয়।
ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে মাঝেমধ্যেই এ হামলায়, ও হামলায় কত মানুষ মারা যায়। কখনও কাউকে গর্জে উঠতে দেখা যায় না। কারণ, হামলাকারীরা একই ধর্মের। কিন্তু কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও দ্বারা কোনো মুসলমান আক্রান্ত হলে মুসলিম সমাজ গর্জে ওঠে। বিশেষ করে ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হলে বাংলাদেশেও তার ঝড় বয়ে যায় (বাংলাদেশ-পাকিস্তানে হিন্দু নির্যাতন হলে এর প্রভাবও ভারতে পড়ে।)। কিন্তু এই ঝড়টার তেমন প্রভাব থাকে না যদি চিন উইঘুরদের ওপর নির্যাতন চালায়। ওদের জোর করে শূকর খাওয়ালেও ওদের বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজ নেই (চিন পাকিস্তানের বন্ধু- এ জন্যই কি?)।
ইসরায়েল যে গাজা তামা তামা করে ফেলল; তাদের প্রধান মিত্র কিন্তু আমেরিকা। এটা সবাই জানে আমেরিকার সামরিক সহায়তায় ইসরায়েল এত বর্বরতা চালিয়েছে। কিন্তু কেউ কিছু বলবে না। কারণ কী? বড়লোকের ঠেঙানিও ভালো কিন্তু গরিবের উচিত কথাও খারাপ।
আরও একটা ব্যাপার দেখা যায়। দেশকে নিয়ে কোনো মুসলমান বিষোদগার করলে কোনো দোষ হয় না, বাইরে অর্থ পাচার করলে তেমন হৈচৈ নেই। কিন্তু কোনো হিন্দু এ কাজ করলে তার দেশপ্রেম নেই, তার প্রেম ভারতের জন্য। ভাবখানা এমন দেশের সব মুসলিম দেশপ্রেমিক। অথচ সুযোগ পেলে সবাই দেশ ছেড়ে ভালো দেশে পালায়। দোষ হয় শুধু হিন্দুর।
সবার আগে নিজের দেশ; সে যে ধর্মেরই হোক। অন্য দেশের প্রতি আবেগ থাকতেই পারে, তাই বলে নিজের দেশকে ছোট করে নয়। চিনাদের কি দেশপ্রেম নেই? জাপানিজ-রাশিয়ানদের দেশপ্রেম নেই? তারা কেন শুধু ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশপ্রেম বিসর্জন দেয় না?
সত্যি বলতে স্বাধীনতার এত বছরেও এ দেশে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেনি। ধর্মীয় উন্মাদনার প্রসার ঘটেছে কেবল। অন্য দেশকেই নিজের আপন ভেবে প্রজন্ম বেড়ে ওঠেছে
ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:২২