somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দার্জিলিংয়ের ডায়রী: ৪র্থ (চতুর্থ) পর্ব (কালিম্পং পর্ব)

৩০ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৪:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
দার্জিলিংয়ের ডায়রীঃ ৩য় পর্ব (দার্জিলিং পর্ব)
দার্জিলিংয়ের ডাইরী: ২য় পর্ব (মানেভঞ্জন পর্ব)
দার্জিলিংয়ের ডায়রী: ১ম পর্ব (মিরিক পর্ব)



যারা আগের ৩টি পর্ব পরেননি তাদের জন্য নিচের বিষয়গুলো জানা দরকার।
আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে অনেকেই শখ করে বেড়াতো যেত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং শহরে। মধুচন্ত্রিমার কথা বলতে পারবোনা তবে ফ্যামিলি ট্যুরের জন্য দার্জিলিং ছিলো অনেকেরই প্রিয় জায়গা। সম্ভবত দার্জিলিংয়ের জনপ্রিয়তার কারন ছিলো তখনকার কোলকাতার সিনেমা, যেখানে দার্জিলিংয়ের দৃশ্য দেখানো হতো প্রচুর। কোলকাতার টালিগঞ্জের ছবির নায়ক নায়িকাদের প্রিয় লোকেশন ছিলো ’দার্জিলিং’। এছাড়াও বড়দের উপন্যাসে ও ছোটদের রহস্য গল্পেও দার্জিলিং এসেছে বার বার। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চরিত্র গোয়েন্দা ফেলুদার প্রিয় জায়গা ছিলো এই পার্বত্য শহরটি। দার্জিলিং নিয়ে লেখা ধারাবাহিকের এটা চতুর্থ পর্ব। আগে ৩টি পর্ব লেখা হয়েছে ”মিরিক”, ”মানেভঞ্জন” ও মূল দার্জিলিং শহর নিয়ে। এবারের পর্ব - কালিম্পং শহর নিয়ে। নতুন পাঠকদের জন্য আমরা আবার পুরোনো জায়গায় ফিরে যাবো কিছুক্ষনের জন্য।
দ্য টিমঃ
আমাদের টিমে ছিলাম ৪ জন। চারজনই জাহাঙ্গীরনগর ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। ব্যাচেলার ট্রিপ দেবার বয়স আছে কিনা আলোচনা হতে পারে, তবে আমাদের মধ্যে তৌফিক আখতার লিটন আসলেই ব্যাচেলর। এখনও বিয়ে-সাদী করেনি। ফলে আমাদের ব্যাচেলর ট্যুর ১০০% বিবাহিতদের নিয়ে তা বলা যাবেনা।

প্রথম ৩টি পর্ব পড়া থাকলে আপনারা জেনে থাকবেন আমরা দার্জিলিং ট্যুরের প্রথম রাতটি কাটাই মিরিকে। মিরিকের ডিটেইল বর্ননা দার্জিলিং ট্যুরের প্রথম পর্বে দেয়া হয়েছে। দার্জিলিং ট্যুরের দ্বিতীয় পর্ব বা মানেভঞ্জন পর্বে মানেভঞ্জন নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। তারপর লেখা হয়েছে দার্জিলিং নিয়ে ৩য় পর্বে। এই পর্বে আমরা চলে যাব কালিম্পং শহরে।

শুরু থেকে ধরলে আমাদের ট্যুরের রুট ছিলো এমন : ঢাকা থেকে বুড়িমারি/চেংড়াবান্দা, চেংড়াবান্দা থেকে শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে মিরিক, মিরিক থেকে মানেভঞ্জন, মানেভঞ্জন থেকে চিত্রি, চিত্রি থেকে মানেভঞ্জন হয়ে দার্জিলিং, দার্জিলিং থেকে কালিম্পং, কালিম্পং থেকে শিলিগুড়ি হয়ে আবার চেংড়াবান্দা।

কালিম্পং ট্যুরঃ
দার্জিলিংয়ের দুটোদিন একটু অন্যরকম কেটেছিলো আমাদের। অনেক পাওয়ার মধ্যেও যেন না পাওয়ার বেদনা কাজ করছিলো। কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্যের কারনে দার্জিলিং মানুষের অনেক প্রিয় জায়গা। ৪ দিন ধরে দার্জিলিং জেলায় অবস্থান করার পরও যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রইলো তখন আমাদের কালিম্পং যাওয়ার সময় হয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার বিমাতাসুলভ আচরনে মনে মনে আমরা কিছুটা হতাস। বাংলাদেশে বসে যখন ট্যুর প্লান করেছিলাম তখন কালিম্পং ট্যুর প্ল্যানের মধ্যে ছিলোনা। আমাদের ইচ্ছা ছিলো মিরিক হয়ে মানেভঞ্জন, তারপর রিম্বিক, রিম্বিক থেকে দার্জিলিং এবং দার্জিলিংয়ে ২দিন থেকে শিলিগুড়ি হয়ে বাংলাদেশ। কিন্তু মানেভঞ্জনে গিয়ে জানা গেল রিম্বিক বেশ দুরে এবং যাওয়া আসা করতে অনেক সময় লাগবে, ফলে রাস্তায় অনেক সময় চলে যাবে, সাথে সাথে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যাবে জিপ ভাড়ায়। কারন দূর্গম পাহাড়ী রাস্তায় জীপ ভাড়াও অপেক্ষাকৃত বেশি। তখনই আমি প্রস্তাব করেছিলাম, যেহেতু রিম্বিক না যাওয়ায় একদিন বেঁচে যাচ্ছে, সে সুযোগে কালিম্পংটা ঘুরে আসি। আর মানুষের গল্পে কালিম্পংয়ের কথা অনেক শুনেছি। বই বা পত্রিকায়ও অনেক পড়েছি। বিশেষত দার্জিলিং থেকে কালিম্পং পর্যন্ত রাস্তাটা নাকি অসাধারন সুন্দর। আমার বড় ভাইয়ের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তার মধ্যে একটি !!!

দার্জিলিংয়ের শেষ সকালটা আমাদের ভালোই কাটলো। সকালে নাস্তা খেলাম ম্যালের কাছে একটি নর্থ ইন্ডিয়ান রেস্তোরায়। এই ভ্রমণে আমরা এমনিতেই ভারতীয় খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পরেছিলাম। তারমধ্যে উত্তর ভারতীয় বা নর্থ ইন্ডিয়ান খাবার দেখলাম সবাই বেশ পছন্দ করেই খাচ্ছিলো। সবাই ৫ আইটেমের থালি নিয়ে নাস্তা করে হোটেলে ফিরে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে কালিম্পং যাত্রায় বের হয়ে পড়লাম। কালিম্পংয়ের জীপ ষ্ট্যান্ড খুজতে বেশ কিছু সময় গেলো। আমাদের হোটেল থেকে বেশ কিছুক্ষণ নিচের দিকে নেমে বেশ ব্যস্ত বাজার নাম সম্ভবত চাদনীচক এ কালিম্পংয়ের শেয়ারড্ জীপ পাওয়া গেলো। আমরা জীপের টিকেট কেটে বাজারের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। দার্জিলিং জেলাতে যেহেতু ৪ রাত কাটিয়ে ফেলেছি, কালিম্পং নিয়ে কারো মধ্যেই খুব একটা উচ্ছাস কাজ করছিলো না। তত দিনে আমরা পার্বত্য রাস্তা আর অনেক রুদ্ধশ্বাস সৌন্দর্যই দেখে ফেলেছ্। কালিম্পং যাওয়া কিছুটা ‘নামকা ওয়াস্তে’ বা পরে যেন বলতে পারি যে আমরাও কালিম্পংয়ে গিয়েছি।


তিস্তাব্রিজ।

সময়মতই জীপ কালিম্পংয়ের দিকে রওনা দিলো। ঠিক যেদিক থেকে আমরা দার্জিলিংয়ে প্রবেশ করেছিলাম তার উল্টোদিকের পথ ধরে জীপ নিচের দিকে নামতে থাকলো। বড় ভাইয়ের কাছে শোনা সেই বিখ্যাত কালিম্পংয়ের রাস্তাকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছিলো না। তবে আরও কিছুক্ষণ চলার পর আমরা বুঝতে পারলাম কেন এই রাস্তাটিকে অসাধারন বলা হয়। দার্জিলিং শহর প্রায় ৬৮০০ ফুট উচ্চতায়। সেই দার্জিলিং থেকে রাস্তাটি তিন্তাবাজার বলে একটি জায়গা দার্জিলিং থেকে কালিম্পং যাওয়ার পথে পড়ে, সেখানে তিস্তানদীর উপর ব্রিজ পার হতে হয়। সেই জায়গাটি দার্জিলিং থেকে কয়েক হাজার ফুট নিচে। এতো অল্প রাস্তায় এতো নিচে নেমে আসার পথে অনেক রোমাঞ্চকর জায়গা বা বাঁক পরে। আশপাসের দৃশ্য অসাধারন। দুপরের খাবার সময় অর্থাৎ ১.৩০শে আমাদের জীপটি তিস্তাবাজারের কিছুটা আগে একটি ধাবা জাতীয় খাবারের দোকানে থামে। ড্রাইভার সবাইকে ৩০ মিনিট করে সময় দিলো দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে। আমরা চিপস্, মম, লুচি আর চা দিয়ে হালকা লাঞ্চ করে নিলাম। ইচ্ছা, কালিম্পংয়ে গিয়ে ভালো করে লাঞ্চ করবো। দার্জিলিং থেকে কালিম্পং যাওয়ার পথে সিকিমের রাস্তা পরে। তিস্তা ব্রিজ পাড় হয়ে রাস্তাটি আবার পাহাড়ের গা বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। বেশ কিছুদুর যাবার পর সিকিমের রাস্তাটি বায়ে চলে যায়, আর কালিম্পংয়ের রাস্তা ডানে পাহাড়ের উপরে উঠতে থাকে।

আগের তিনটি পর্ব পড়া থাকলে বুঝতে পারবেন কালিম্পং প্রথমে আমাদের ভ্রমণসূচিতে ছিলো না। তাই কালিম্পং যাবার সময় সবার ভিতর একটা অলসতা কাজ করছিলো। ঘুম ঘুম চোখে জিপের জানলা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকলাম আমরা। আমাদের ভিতরে দেশে ফেরার একটা তাড়নাও কাজ করছিলো। ততদিনে ৫ দিন কেটে গেছে ঢাকা থেকে দুরে। বাংলাদেশ থেকে খবর এসেছে দেশের অবস্থা খারাপ। ঢাকায় হেফাজত ইসলাম মতিঝিলে বিশাল সমাবেশ ডেকেছে। সরকার নিজে ধর্মঘট ডেকেছে। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচলা বন্ধ থাকবে আমাদের আসার দিন। আমরা সবাই একটু চিন্তাগ্রস্থ ছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশে বাসের রওয়ানা দেয়া অনিশ্চিত। বুড়িমারি থেকে ঢাকা কিভাবে পৌছাবো এই চিন্তা আমাদের কালিম্পং বিষয়ক উৎসাহে আরও এক ঘড়া পানি ঢেলে দিলো।

অবশেষে আমরা কালিম্পং পৌছালাম বিকালের দিকে। কালিম্পং ষ্টেডিয়ামের একটু দুরে আমাদের জিপ থামলো। প্রচুর ভির। গাড়ি থেকে নামতেই অনেক বাংগালী দালাল আমাদের ঘিরে ধরলো। হোটেল খুজে দিতে চায়। আমরা কিছুটা কনফিউসড্ ছিলাম। কারন কালিম্পং নিয়ে খুব একটা খোঁজ খবর করা ছিলো না। ভালো হোটেলের নাম ধাম, ঠিকানা জানা ছিলো না। তবে ঠিক করলাম দালালদের কাছ থেকে হোটেল নিবো না। দালালরা আমাদের ভয় দেখাতে লাগলো, হোটেল অনেক দুরে, আমরা নিজে এতো ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে যেতে পারবোনা। আমাদের পিঠের ব্যাগের সাথে দার্জিলিং থেকে যুক্ত হয়েছিলো একটি করে এক্সট্রা ব্যাগ। শপিং, চাপাতা ও শাল কিনেছিলাম। দালালদের হাউকাউ কিচির মিচির এরিয়ে আমরা হাটা দিলাম সামনের দিকে। দেখা যাক ভালো কোন হোটেল পাওয়া যায় কিনা। একটা ছোট গলি পেরিয়ে শহরের চৌরাস্তায় বের হয়ে দেখলাম বেশ কিছু হোটেল আশে পাশে আছে। আমরা দেখতে ভালো এমন একটি চারতালা হোটেলে ঢুকে কথাবার্তা শুরু করলাম। চারজনের জন্য একটা বড় রুম দরকার। হোটেল থেকে বলা হচ্ছিলো দুটো বেড এক সাথে করে দিলে আমরা থাকতে পারবো। কিন্তু ওদের বেডের অবস্থা খারাপ দেখে আর দুই বেড একসাথে করলেও মাঝখানে যে শুবে তার অসুবিধা হবে দেখে আমরা আবার নিচে নেমে হোটেল খুজতে থাকি।

দার্জিলিংয়ে অনেক শীত ছিলো তাই আমরা ভারি জ্যাকেট পড়ে রওনা দিয়েছিলাম। কালিম্পংয়ের উচ্চতা দার্জিলিং থেকে অনেক কম। ৪০০০ থেকে ৪৫০০ ফুট। তাই তাপমাত্রা বেশ স্বাভাবিক । মোটা জ্যাকেটে ঘাম হচ্ছিলো। তাই জ্যাকেটের চেইন খুলে দিয়েছিলাম। পিঠে ভারি ব্যাগ, হাতে শপিং ব্যাগ। জ্যাকেটের চেইন খুলে দেয়ায় ভিতরের হাতকাটা গেঞ্জী বের হয়ে ছিলো। হঠাৎ জুয়েল খুব হাসতে শুরু করলো। ‘আরে খোকনকে ত জোস লাগছে, অভিযাত্রী অভিযাত্রী লাগছে’। ‘মুসা ইব্রাহিমকে খুব একটা শক্ত পোক্ত লাগেনা, এম. এ মুহিতের মতো লাগছে। তারাতারি ওর ছবি তোল’। আমরা হোটেল খোঁজা বাদ দিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। পরে হোটেলে ওঠার পর অবশ্য ছবি দেখে সবাই একচোট হাসাহাসি করেছিলাম। কারন এম.এ মুহীতের অনুসারিদের ছোটখাট ভূ’ড়িগুলো ছবিতে ড্যাব ড্যাব করে থাকিয়ে আছে দেখে।


অভিযাত্রী দল।

যাক হোটেল একটা পাওয়া গেল। ৪ তালার উপরে ২ রুমের ডুপ্লেক্স। হোটেল কলস এ। প্রতি রুমে একটি করে ডবল বেড। আমি আর জুয়েল উপরের রুমে। সাথে দুটি সোফাসহ বসার জায়গা। নিচে আমান ও লিটন। ওদের রুমে পশ্চিম দিকে একটা জানালা। আমাদের রুমে তিনটি জানালা। পূর্ব পশ্চিম ও উত্তর দিকে। বাহিরে পুরো শহরের ভিউ ও পাহাড়ের অসাধারন দৃশ্য। নিচে ষ্টেডিয়াম বা বড় মাঠ। খুব সুন্দর। যে যার মতো ব্যাগ রেখে গোসল সেরে নিলাম সবাই। ততক্ষনে দিনের আলো কমে আসছিলো। জানালা দিয়ে ষ্টেডিয়ামে ফুটবল প্রাকটিস দেখলাম। হোটেলের কিচেনে ফোন দিয়ে পাকোড়া আর চা খেয়ে নিলাম। হোটেল থেকে জানালো নিচে ওদের রেষ্টুরেন্ট আছে। তবে ভেজ রেন্টুরেন্ট, মাছ মাংশ পাওয়া যাবেনা। চা-নাস্তা করে হালকা আড্ডা ও বিছানায় গড়াগড়ি করে সন্ধায় বেড় হলাম শহর পরিদর্শনে ও সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ফেসবুকে আপডেট দেবার জন্য। পারলে দেশে ফোন করে কথাও বলবো সবাই। কালিম্পং ছোট্ট শহর। আমরা হৃষি রোডের এমাথা ওমাথা করে চৌরাস্তার পাশে একটা সাইবার ক্যাফেতে ঢুকে পরলাম। চারজন চারটি কম্পিউটার দখলে নিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দিলাম যে আমরা সহীসালামতে কালিম্পংয়ে আছি। ভালো আছি। সাইবার ক্যাফের মালিক ফোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন। পরে জেনেছিলাম উনি শুধু আমাদের জন্য ৫০০ রুপি ফোনে রিচার্জ করেছিলেন। আমরা সবাই বাংলাদেশে যার যার বাসায় ফোনে কথা বললাম। শিলিগুড়িতে বাসের অফিসেও ফোন করে আমাদের টিকিট রি-কনফার্ম করলাম। কালিম্পং ততক্ষণে আমাদের ভালো লাগতে শুরু করেছে। আসলে আমরা প্রকৃতির টানে ঘুরতে বের হলেও মানুষের কারনে অনেক জায়গা অনেক সময় বেশি ভালো লাগে। কালিম্পংয়ের মানুষের ব্যবহার আমাদে খুব ভালো লাগছিলো। সাইবার ক্যাফে ও ফোনের খরচ দার্জিলিং থেকে অনেক কম মনে হলো।


ভেজিটেবল বিরিয়ানী।


মাসালা দোসা।


আমাদের হোটেল।




হোটেল থেকে দেখা দৃশ্য।

রাতে খাওয়া দাওয়া করলাম হোটেল কলসের নিজস্ব রেষ্টুরেন্টে। কাশ্মিরী ভেজিটেবল বিরিয়ানী। ভেজিটেবল বিরিয়ানী বলে নাক সিটকে খাওয়া শুরু করলেও একটু পরে হাভাতের মতো খেতে থাকলাম। আমরা ৪ জন এখনও গল্প করি কালিম্পংয়ে খাওয়া বিরিয়ানী আমাদের খাওয়া সেরা বিরিয়ানী। খেয়েদেয়ে সোজা হোটেল রুমে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে অনেক ঠান্ডা পরেছে। আমাদের রুমের খাটে বসে কম্বলে পা ঢুকিয়ে বসে দার্জিলিংয়ের ছবি টেলিভিশনে কানেক্ট করে দেখলাম সবাই। সদ্য ঘোরা জায়গাগুলো স্মৃতি হয়ে গেছে দেখে মনটা খারাপ হলো। আবার সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে মন ভালোও হলো। আড্ডা শেষে তারাতারি ঘুমাতে গেলাম। তারপর দিন অনেক কাজ। আধাবেলা কালিম্পং ট্যুর শেষে শিলিগুড়ি ফিরতে হবে। সকালে জুয়েলের হাউকাউয়ে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলতেই ঠান্ডায় জানালা দিয়ে আসা আলোয় হালকা ধাক্কামতন লাগলো। ক্যামেরা বের করে ফেল্লাম তাড়াতাড়ি। বেশ ঠান্ডা লাগছিলো। মোটা জ্যাকেটটাও পড়ে ফেল্লাম। জুয়েল সব জানালা খুলে দিয়েছিলো। অবাক হয়ে দেখলাম এক জানালা দিয়ে ধোঁয়ার মতোন মেঘ ডুকছে আর আরেক জানালা দিয়ে বিরুচ্ছে। আমি ততক্ষণে ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। জানালার বাহিরে তাকাতেই দেখলাম কালচে রঙের বাড়ির ছাদগুলো সাদা মেঘের চাদরের নিচে ঢাকা পড়েছে। পুব দিকের পাহাড়ের পিছন দিকটা আলোর রেখায় উদ্ভাসিত। ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে আছি আমি। সুর্য বেরুলেই সাটার টিপবো। কিন্তু অপেক্ষার সময় যেন কাটতেই চায়না। অবশেষে সুর্যদেবের দেখা মিললো। তবে সাইজে ছোট। প্রথমে বেশ নরম আলোর বলের মতো। আস্তে আস্তে তেজ বাড়তে লাগলো। সোনালী আলোয় চারপাশ ততক্ষণে আলোকিত হয়ে গেছে। সোনালী আলোর বর্ণচ্ছটায় আমাদের রুমের মেহেগনী কাঠের মেঝেতে যেন আগুল লেগে গেলো। কাঞ্চনজংঘা না দেখতে পাওয়ার দুঃখ কিছুটা ঘুচলো।






সকাল বেলার দৃশ্য।

সকালে নাস্তা করলাম মাসালা (মসলা) দোসা দিয়ে। দক্ষিণ ভারতীয় খাবার। দোসাটা বেশ উচ্চমার্গিয় ছিলো, যাগে কিনা ইংরেজীতে বলে হাইক্লাস। মাদ্রাজি দোসা মাদ্রাজে বসে (বর্তমানে চেন্নাই) খেয়েছি। কালিম্পংয়েরটা কোন দিক দিয়ে খারাপ লাগলো না। নাস্তা শেষে কলস হোটেলের ছেলেরাই একটা গাড়ি ভাড়া করে দিলো হাফডে ট্যুরের জন্য। এখানে ষ্পট ভিত্তিক ট্যুর হয়। ২১ স্পট, ১২ স্পট। এভাবে। আমরা কাছাকাছি অল্প কিছু জায়গা ঘুরতে চাচ্ছিলাম। দুপুরে শিলিগুড়ি ফিরতে হবে। মারুতি ওমনি গাড়ির ড্রাইভারের নাম উদয়। বেশ পাংকু। সাদা টি শার্ট ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছে। চুল পিছনে ঝুটি বাঁধা। বেশ গাব্দাগোব্দা সুন্দর চেহারা। গাড়িতে উঠে উদয়কে জিজ্ঞাসা করলাম ইংরেজী রক গান আছে কিনা? ওর চেহারা দেখে মনে হয়েছিলো ও রক মিউজিক পছন্দ করে। ও বল্লো শুধু হিন্দি গান আছে। যা আছে তাই সই। ৯০ দশকের আশিকি মার্কা গান বাজতে লাগলো। অনেকদিন পর ভালোই লাগলো। যদিও মনে মনে বাজছিলো অঞ্জন দত্তের কাঞ্চনজংঘা। অঞ্জন দত্তের গানে মধ্যে কালিম্পংয়ের ট্যুরিষ্ট লজের কথা বলা হয়েছে। আমরা উদয়কে বল্লাম ট্যুরিষ্ট লজে নিয়ে যাও।


উদয়।

প্রথমেই আমরা গেলাম আর্মি গল্ফকোর্স ও টুরিষ্ট লজ দেখতে। বলে রাখা ভালো পুরো কালিম্পংয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির অনেক জায়গা ও কর্মকান্ড আছে। সুন্দর গল্ফের মাঠ। মাঠের উল্টোপাসেই টুরিষ্ট লজের ব্রিটিশ আমলের বিল্ডিং। টুরিষ্ট লজের পোষাকী নাম মর্গান হাউজ যা বর্তমানে হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই স্থাপনার সাথে অঞ্জন দত্তের গানের সাথে কোন মিল পেলাম না। বেশ কেতাবী একটা কটেজ টাইপের বাংলো বিল্ডিং। সুন্দর পরিবেশ। আমরা বেশ আপসোস করছিলাম এমন একটা জায়গায় না থাকতে পেরে। ঘুরে দেখতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যাচ্ছিলো। আমরা গাড়ি নিয়ে ছিলাম খুব অল্প সময়ের জন্য। দুপুর ১২.৫০ পর্যন্ত। উদয়কে বল্লাম আমরা বেশি দেরি করে ফেললে যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়। ও দেখলাম খুব ভালো। বললো দেখতে এসেছেন। যত ইচ্ছা থাকুন আমার সমস্যা নাই। আবারও মুগ্ধ হলাম কালিম্পংয়ের মানুষের ব্যবহারে। চেহারায় কোন বিরক্তি নাই। নিজের ফোন থেকে বিনে পয়সায় কল করতে দিলো উদয়। টাকা নিলোনা। হাসতে হাসতে বললো আমিতো ফোনের ব্যবসা করিনা। সমস্যা নাই।






টুরিষ্ট লজ ও গল্ফ মাঠের ছবি।

কালিম্পংয়ে আমরা খুব অল্প সময় ছিলাম। কিন্তু যতোক্ষণ ছিলাম, পুরো সময়টা খুব ভালো কেটেছে। সুন্দর গোছানো জায়গা। ছিমছাম। দার্জিলিং আসলে অবশ্যই কালিম্পং আসা উচিত। গল্ফ কোর্স থেকে আমরা গেলাম পাইন ভিউ নার্সারীর ক্যাকটাস গার্ডেন। নার্সারী খুব বড় না। তবে দুর্লভ সব ক্যাকটাসের সমাহার ঘটানো হয়ে ওখানে। সারি বাঁধা গ্রীনহাউসের ভিতরে নানান জাতের ক্যাকটাস। সাথে অদ্ভুত সুন্দর ফুল। ক্যাকটাসের ফুলের অনেক ছবি তোলা হয় আমাদের ক্যামেরা দিয়ে। ক্যাকটাস ছাড়াও বাহিরে সুন্দর বাগান ও দুর পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায় এই নার্সারী পিছন থেকে। বেশ সময় ধরে নিজেদের নিয়ে ফটোসেশন করা হয় এখানে। সুর্য তখন বেশ তাপ ছড়াচ্ছে। এখানে একটা ছোটখাট ঘটনার শিকার হলো আমান। পাইনভিউ নার্সারী থেকে বেড় হওয়ার সময় রাস্তার পাশের জংলা ঝোপে আমানের হাত লাগার পর হঠাৎ চিৎকার দিলো। সাথে সাথে হাতটা লাল হয়ে কিঞ্চিৎ ফুলে গেলো। বিছুটি পাতা। আমানের অবস্থা বেশ সঙ্গিন লাগলো। ব্যাথায় মুখ শুকনা। ড্রাইভার উদয় বল্লো একদুই ঘন্টা পর একনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।


পাইনভিউ নার্সারীর গেটে তোলা ছবি।


ক্যাকটাসের ফুল


ক্যাকটাসের গ্রীন হাউসের ভিতরে।


নার্সারীর বাহিরের অসাধারন দৃশ্য।

পাইনভিউ নার্সারীর পাশেই বিশাল একটা বুদ্ধ মূর্তি আর বুদ্ধ মন্দির। আমরা রাস্তার পাশ থেকে মুর্তিটির ছবি তুলে নিলাম। তারপর আমরা গেলাম হনুমান পার্কের হনুমান মূর্তি দেখতে। পাহাড়ের উপর বিশাল হুনুমানের মূর্তি। মূর্তির বেদিতে উঠে চারিদিকের সুন্দর ভিউ দেখা যায়। সাথে সাথে মুর্তির নিচ থেকে মূর্তির সাথে ছবি তোলা যায়। পুরো কম্প্রেক্সটাই খুব সুন্দর। ফুল বাগান দিয়ে ঘেরা। ছবি তোলা হয়ে গেলে আমরা মূর্তির কাছ থেকে নেমে আসি। রওনা দেই দুরপীন হিল মনাস্টেরীর দিকে।





বুদ্ধ ও হনুমানের মূর্তি।

দুরপিন হিল মনাস্টেরী বা গোম্ফা কালিম্পংয়ের সবচেয়ে বড় বুদ্ধ উপাসানালয়। এটা ১৯৭৬ সালে দালাই লামা প্রতিষ্ঠাপিত করে। এই মনাস্টেরীর পোশাকি নাম Zangtok Pelri Phodang। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৩৭২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মনাস্টেরী থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়।


দুরপিন হিল মনাস্টেরীর ভিতরে।


দুরপিন হিল মনাস্টেরী

দুরপিন হিল থেকে আমরা সর্বশেষ ষ্পট ডেলোতে গেলাম। ডেলো টুরিষ্ট ষ্পটটি বেশ সুন্দর। বড় জায়গাটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। প্রথমে গেট দিয়ে ঢুকতেই সাজানো বাগান আর মাঠ। মাঠের শেষে খুব সুন্দর টুরিষ্টদের জন্য টুরিষ্ট লজ টাইপের বিল্ডিং। পুরোনো ইউরোপীয় ধাঁচে বানানো বিল্ডিং। পুরো কমপ্লেক্সটাই উচু পাহাড়ের মাথায় বসানো। সব দিক দিয়েই বহুদুরের দৃশ্য দেখা যায়। ডেলোতে সময় কাটানোর জন্য অসুবিধা হয় না। পরিস্কার মাঠের চারিদিকে বসার জন্য বেন্চ পাতা আছে। গরমে আইসক্রিম ও স্ন্যাক্স বিক্রি হচ্ছিলো। মাঠে বিশাল ঘোড়া দিয়ে পর্যটকদের ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে। আছে প্যারগ্লাইডিংয়ের ব্যবস্থা। সময়ের অভাবে আমরা প্যারাগ্লাইডিং করতে পারলাম না। আফসোস হচ্ছিলো। আমরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলাম যে, এরপর দার্জিলিংয়ে আসা হলে দার্জিলিংয়ের চেয়ে বেশি সময় কালিম্পংয়ে থাকবো। কারন কালিম্পংয়ের সব জায়গা বেশ নিরিবিলি আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মানুষের ব্যবহার ও খরচ কিছুটা কম। নিচে ডেলোও ছবিগুলো দেখলে একটা আইডিয়া পাবেন।







ঘোরাঘুরি শেষে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ১ বেজে গিয়েছিলো। কোনমতে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম শিলিগুড়ির দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:২৬
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×