somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছাত্র রাজনীতিঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯৭-২০০২ এ সময়টাতে রোকেয়া হলে ছিলাম। এরপরেও ছাত্রী ছিলাম, কিন্তু পারিবারিক কারণে প্রিয় হলটি ছাড়তে হয়েছিল। আমার হল জীবনটা অনেক ভালই কেটেছিল, খুব মিস করি সে জীবন। ছাত্রজীবনের প্রথম সময়টা ছিল আওয়ামী লীগের শাসনামল। হলে উঠেছিলাম মেধাতালিকা অনুযায়ী, যদিও ডাব্লিং করতে হয়েছে। আমাদের সময়ে প্রতি রুমে একজন করে ডাব্লিং থাকতে হয়েছে, মানে সীটের অতিরিক্ত একজন, রুমে যে সবচেয়ে জুনিয়র তাকে শেয়ার করতে হতো ডাব্লিংকে। মেধাতালিকায় ২/৩ বার উঠানোর পরও যদি কেউ হলে উঠতে চাইতো তাদেরকে বিভিন্ন দলের নেত্রীদের বিশেষ ব্যবস্থায় উঠতে হতো।

আমাদের পরের বছর ছাত্রী সংখ্যা আরো বাড়লো, শুরু হলো গণরুমের কন্সেপ্ট। এরপর প্রতিবছর ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর প্রতি রুমে ডাব্লিং-এর সংখ্যা, সীট সংখ্যাও বাড়তে থাকে, আগে অনার্স বিল্ডিং-এ সিঙ্গেল সীট ছিল, সেটাকে ডাবল করা হয়, যদিও সেখানে আর ডাব্লিং দেয়া হতো না। আবার আমাদের হলের ভিতরে ছিল ফয়েজুন্নেসা হল, যেটা মূলত এমফিল, পিএইচডি ছাত্রীদের জন্য, সেখানেও ডাব্লিং দেয়া হতো। যাই হোক, এরপরও সবাই হল প্রশাসনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সীট পেয়েছে, খুব কম মেয়েই অনেক পরে আসার কারণে দলীয় নেত্রীদের ধরে হলে উঠতে হয়েছে।

আমাদের সময়ে হলের ভিপি, জিএস ছিল ছাত্রদলের। সেই কবে এক ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, সে প্যানেল তখনো ছিল, যদি নেত্রীরা ততদিনে পাশ করে বেরিয়ে গেছে, তবুও হলে ছাত্রদলের কোন প্রোগ্রাম থাকলে, উনারা আসতেন। তাদের মধ্যে দুইজন এখন সংসদেও আছেন সংরক্ষিত নারী আসনে।

আমি যে বিল্ডিং ছিলাম তার নীচতলা ছিল ছাত্রলীগের মেয়েদের, নেত্রীদের কয়েকজন ছিলেন আদু আপা, ফি বছর ড্রপ দেয় আর সীট দখল করে রাখে। যখন সীট সংকট বাড়তে থাকলো, প্রভোস্ট ম্যাডাম অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের পরীক্ষা দিইয়ে একসময়ে হল থেকে বিদায় করে।

ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ সভাপতির বিভিন্ন কর্মকান্ডের বা বিভিন্ন ঘটনার কথা আমরা প্রায়ই শুনতাম। তারা রেগুলার ছাত্র ছিল। একজন ফার্মেসী থেকে পাশ করে এমবিএ ভর্তি হয়। তার এক আত্মীয় ছিলেন আমার রুমমেট, উনার মতে এমবিএ-তেও টিকতে পারার কথা না, নেতা দেখে টিকে গেল আর কি। তার বাগদত্তা আবার আমাদের হলের ছাত্রী ছিলেন, মানে ওই নেতা ছিলেন আমাদের হলের দুলাভাই। :)

হলের বিভিন্ন ছাত্রী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন মূলত বামদলের ছাত্রীরা। এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট এরা উল্লেখযোগ্য। ছাত্রমৈত্রী নামেও নাকি একটা দল আছে, যদিও আলাদাভাবে এদের কোন নেত্রীকে আমি চিনতাম না। ছাত্রদল আর ছাত্রলীগের মেয়েরা ছিল মূলত সুবিধাবাদী, মেয়েদের কোন দরকারে এদেরকে পাওয়া যেত না। অবশ্য ছাত্রদল, ছাত্রলীগ ফার্স্ট ইয়ারদের বেশ জমকালো নবীনবরণের আয়োজন করতো, সেটা ভালই লাগতো, মজা হতো অনেক। তাছাড়া জাতীয় নেতাদের জন্মবার্ষিকী, মৃত্যবার্ষিকীতে মিলাদ উপলক্ষে কিছু খানাপিনা আমরা দল-মত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করতাম, তুলনা চলতো কোন দল ভাল খাইয়েছে, গতবারের চেয়ে কোনটা ভাল হয়েছে, কোনটা খারাপ হয়েছে। সে সাথে দলীয়দের মেকি কান্নাকাটি, মাইকে কানফাটা বক্তৃতার অত্যাচারও সহ্য করতে হতো।

লক্ষ্য করুন সব দলের মেয়েরাই একসাথে হলে ছিল, যদিও দল অনুযায়ী ব্লক আলাদা ছিল। যে বিল্ডিং-এ ছাত্রলীগ ছিল সেখানে কোন ছাত্রদল বা বামদল ছিল না, যে বিল্ডিং-এ ছাত্রদল ছিল সেখানে অন্যরা ছিল না। বামদলরা আরেক বিল্ডিং-এ থাকতো, সবাই যার যার গ্রুপিং অনুযায়ী থাকতো। মাঝে মাঝে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের মাঝে টিভিরুম তথা অডিটোরিয়ামে বিভিন্ন প্রোগ্রামের সময় ঝগড়া লেগে যেত, এক্ষেত্রে মূলত অগ্রগামী ছিল ছাত্রদলের এক আপা। ঐ আপার ঝগড়াটে স্বভাবের কথা কেন্দ্রীয় নেতারাও জানতো। মাঝে মাঝে উনার নামে বিচার যেত সভাপতির কাছে, উনি সেটা মিটমাট করে দিতেন। আর ছাত্রদল আর ছাত্রলীগের দুই সভাপতির সম্পর্কও ভাল ছিল, আমরা ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় তাদের তেমন কোন গন্ডগোলের কথা খুব একটা শুনিনি।

আমাদের হলে ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা একটাই দেখেছি। একদিন সন্ধ্যার পর হলে ফিরে দেখি শিবিরের এক মেয়ে ধরা পড়েছে, উনি মাস্টার্সে পড়েন। ছাত্রলীগ আর বামদলের মেয়েরা মিলে তাকে হল থেকে বের করে দিয়েছে। হলে অনেক হৈ চৈ হচ্ছে এ নিয়ে। রুমে এসে শুনলাম ঐ মেয়ের রুমে গিয়ে দলবদ্ধভাবে হামলা করা হয়েছে, তার বইপত্র রুমে ছুঁড়ে বাইরে ফেলা হয়েছে, রুমমেটরা বাধা দিতে গেলে তাদের উপরেও হামলা করা হয়েছে। তারা ঐ মেয়ের সীট বাতিল করার জন্যও হল প্রশাসনের কাছে দাবী তুললো। এ আপু অনেকদিন থেকেই হলে আছেন, তার রুমমেটরাও জানতো তার ছাত্রীসংস্থার সাথে সম্পর্কের কথা। হঠাৎ করে সেদিনই কেন এ আক্রমণ হলো এটা ঠিক বোঝা গেল না, ছাত্রলীগের মেয়েরা কি আগে জানতো না , নাকি অন্য কোন ব্যাপার জানি না।তবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনের একটা প্রভাব যে ছিল সেটা বোঝা যায়। যদিও এ ঘটনা অনেক সাধারণ ছাত্রীরা সহজভাবে নেয়নি। বিশেষ করে রাতের বেলা একটা মেয়েকে হল থেকে বের করে দেয়া, আবার তার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র যেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল সেগুলো হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে পড়া আর হাসাহাসি করা, এ ব্যাপারগুলো অনেকেরই পছন্দ হয়নি। অনেক সাধারণ মেয়েরাই রুমে রুমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল যেখানে সংসদে জামাত আছে, তাদের যেহেতু স্বাধীনতাবিরোধী বলে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়নি, সেখানে হলে কেন শিবিরের মেয়েরা থাকতে পারবে না, যেখানে সে এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন বৈধ ছাত্রী। পরদিনই ছিল এ ব্যাপারে জরুরী জেনারেল মিটিং ডেকেছিল ম্যাডামরা পুরো ঘটনাটা জানতে, ছাত্রীদের বক্তব্য শুনতে। হলের সব মেয়েরা সেদিন হলরুমে উপস্থিত ছিল। আক্রান্ত ছাত্রীরা তাদের উপর যে আক্রমণ হয়েছে সেটার বর্ণনা দেন, যতদূর মনে পড়ে ছাত্রলীগ আর বামদলের মেয়েরা ঐ মিটিং-এ উপস্থিত ছিল না, বা কম সংখ্যক ছিল, তারা তেমন জোরালোভাবে তাদের কাজের স্বপক্ষে জোরালো দাবী করতে আসেনি। অন্যান্য সাধারণ ছাত্রীরাও আলোচনায় অংশ নেয়, ম্যাডামরাও ছাত্রীদের মিলে মিশে থাকার পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় ঐ মেয়ের সীট না কাটার, তার পক্ষেই মেয়েদের অবস্থান ছিল। পুরো ঘটনায় ছাত্রদল নিশ্চুপ ছিল।

আরেকটি বড় ঘটনা দেখেছি শামসুন্নাহার হলে ছাত্রদলের আদু আপাদের বিতাড়িত করার আন্দোলন থেকে কিভাবে সেটা ভিসি স্যার আর প্রভোস্ট ম্যাডামের ন্যাক্কারজনক শিক্ষক রাজনীতির ভয়ংকর স্বীকার হয়। সে ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে আপনারা সবাই জানেন।

উক্ত দুই ঘটনা ব্যতীত মেয়েদের হলে দলীয় রাজনীতির তেমন কোন ক্ষতিকর প্রভাব দেখিনি। এর মূল কারণ ছিল মনে হয় তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। অথবা তাদের মন-মানসিকতাও নিশ্চয় সেরকম ছিল না চর দখলের মতো হল দখল করা, সাধারণ ছাত্রীদের শান্তি হারাম করা এসব কাজের জন্য। আমাদের কখনো কোন মিছিলে যেতে বাধ্য করা হয়নি। হলে এ আন্দোলনগুলো হতো তাতে মেয়েরা নিজেরাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দিতো, সেটা কোন দলীয় মিছিল ছিল না, সাধারণ ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ছিল, যদিও সামনে সারিতে যাদের দেখা যেত তারা ছিল বিভিন্ন বামদলের।

বকরের মৃত্যসহ আরো যত ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাতে একটা আকাংখাই বারবার মনে এসেছে প্রতিটা হলেই কি এমন হতে পারে না? ছাত্রদের হাত থেকে অস্ত্র সরিয়ে নেয়া যায় না কোনভাবেই? ব্যাপারটা কি খুবই কঠিন? সব দল মিলেমিশে চলতে পারে না আমাদের এই প্রিয় ক্যাম্পাসে? উপরের নেতাদের মাঝে তো ঠিকই খাতির থাকে, পাতি নেতাদের মাঝেও কি সদ্ভাব থাকতে পারে না? এটা কি খুব অলীক স্বপ্ন?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৯:৩৮
২৮টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদি ভাই, ইনসাফ এবং একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের গল্প

লিখেছেন গ্রু, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৮



ইদানিং একটা কথা খুব মনে পড়ে। হাদি ভাই।

মানুষটা নেই, কিন্তু তার কথাগুলো? ওগুলো যেন আগের চেয়েও বেশি করে কানে বাজে। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরা আসলে কীসের পেছনে ছুটছি? ক্ষমতা? গদি? নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×