আমাদের দেশে নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে আসলে প্রথমেই যার নামটির কথা মনে পড়ে তিনি হলেন মহিয়সী বেগম রোকেয়া। যিনি বুঝেছিলেন নারীদের চিরাচরিত গৃহস্থালীর কাজের বাইরেও আরো কিছু করার আছে, তিনি বুঝেছিলেন মুসলিম নারীদের অতিরিক্ত পর্দার নামে যেটা করা হচ্ছিল ঐসময়কার সমাজে সেটা আসলে এক ধরণের অবরোধ, তাই তিনি লিখেছিলেন অবরোধবাসিনীদের দুঃখ-দুর্দশার গল্প। তিনি আন্দোলন শুরু করেছিলেন মুসলিম নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য।
ঐ কাছাকাছি সময়ে আরো অনেক মুসলিম দেশেই নারী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, অন্যান্য অমুসলিম দেশগুলোতেও নারীদের ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া শুরু হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে নারীদের অধিকারের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষগুলো সচেতন হচ্ছিল, অনেক দেশে প্রথমবারের মত নারীদের ভোটাধিকার দেয়া শুরু হয়েছিল। কি শিক্ষা, কি কর্মস্থল সব জায়গায় নারীদের সুযোগ-সুবিধাগুলো নিয়ে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন, বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া শুরু হয়, যার একটা হলো এই নারীদিবস। নারীদিবসের ইতিবৃত্ত নিয়ে গতকাল ব্লগে নানারকমের পোস্ট এসেছে, তাই আজ আর নতুন করে সেটা নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছে না, সে ব্যাপারে আর কিছু বলারও বাকী নেই।
আমি বরং একটু অন্যদিকে নজর দেই। আজ প্রায় ১০০ বছর বা তারও অধিককাল পরে সমাজে নারীদের অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? এখানে আমি মূলত মুসলিম নারীদের ব্যাপারে কথা বলবো। আর এ প্রসঙ্গে পুনরায় উচ্চারণ করতে চাই মুসলিম নারীনেত্রী ডঃ শরীফা আল খতীবের সেই প্রশ্নটি, "কেন এখানে কোন নারী বক্তা নেই"?
এ প্রশ্নটি যিনি করেছেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম কমিউনিটিতে নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার একজন পাইওনিয়ার। একজন মুসলিম নারীনেত্রী। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম কমিউনিটিতে পরিবারে, গৃহ অভ্যন্তরে নারীদের প্রতি যে নির্যাতন করা হয় তার প্রতিবাদে প্রথম সোচ্চার হোন, কমিউনিটির সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন নারীদের এসব সমস্যার কথা। এ নিয়ে নানারকম সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপের আয়োজন করতে থাকেন, যাতে করে মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তারা যেন তাদের নারীদের ব্যাপারে আরো যত্নবান হয়, নারীরা যেন তাদের সঠিক মর্যাদা পান।
এ প্রশ্নটি তিনি করেছিলেন ১৯৯৩ সালে বসনিয়ার গণহত্যার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে মুসলিম কমিউনিটি কর্তৃক যে র্যালীর আয়োজন করা হয় সেখানে। র্যালী উপলক্ষে সেখানে কিছু বক্তৃতার আয়োজন করা হয়, যার মাঝে সব বক্তাই ছিলেন মুসলিম পুরুষ। আর কোন নারী বা পুরুষের মাথায় ঐসময়ে ঐ প্রশ্ন আসেনি। উনার প্রশ্ন শুনে অনুষ্ঠানের আয়োজক তড়িঘড়ি করে শেষ মুহূর্তে কিছু পরিবর্তন আনেন, একজন মুসলিম নারীকে বক্তা হিসেবে সংযুক্ত করেন, যিনি ছিলেন ডঃ শরীফা আল খতীব।
শরীফা দুঃখের সাথে বলতেন অনেক মুসলিম নারী কমিউনিটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে কারণ তাদের অভিযোগ, "তোমরা পুরুষেরা আমাদের কথা শোনো না, আমরা কেন তোমাদের কথা শুনবো?" কিন্তু শরীফা ছিলেন মধ্যপন্থী নারীবাদী। তিনি মহান আল্লাহ্তাআলার প্রতি অবাধ্য হতেন না, তিনি অজ্ঞ মুসলিম পুরুষদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। আমাদের বেগম রোকেয়াও সেরকম ছিলেন, তিনিও আল্লাহ্তাআলার অবাধ্য হতেন না, কিন্তু প্রতিবাদ করতেন সমাজের প্রচলিত ভুল ব্যবস্থাগুলোর ব্যাপারে।
শরীফা মুসলিম নারীদের মসজিদে স্থান পাবার ব্যাপারেও আন্দোলন করেছেন। আজ অনেক দেশেই অনেক মসজিদেই নারীদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা নেই। অথচ ইসলামের প্রথম যুগে নারীদের অবস্থা এমন ছিল না। তারা জামাতে নামায আদায় করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন রকমের সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, বিভিন্ন রকমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এর মধ্যে নর্থ আমেরিকান কাউন্সিল ফর মুসলিম উইমেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কোরআনের পিকথাল অনুবাদের একজন সম্পাদক ছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি......।
এ মহিয়সী নারী ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ইন্তেকাল করেছেন। তার ব্যাপারে আরো জানতে...
এ সুযোগে ঐ একই ওয়েবসাইটে পাওয়া নারীর ক্ষমতায়নের কিছু টিপ্সও পাঠকদের সাথে শেয়ার করিঃ
১। নারীর ঐতিহ্যবাহী পরিচয়ের স্বীকৃতিঃ
মা, স্ত্রী, কন্যা হিসেবে নারীর যে আদি পরিচয়, গৃহে থাকার যে পরিচয় তাকে স্বীকৃতি দেয়া। খুব কম মুসলিম পরিবারই নারীদের এ পরিচয়গুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। আমরা একজন নেতাকে বা বক্তাকে প্রশংসিত করি, কৃতজ্ঞতা জানাই, অথচ তাদের এসব কাজের পেছনে যে মা বা স্ত্রী বা কন্যার অবদানটুকু আছে সেটা স্বীকার করি না। এক্ষেত্রে মা হয়তো তার ছেলেটিকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছিল ছোটবেলায়, একজন স্ত্রী হয়তো বিভিন্ন সময়ে জ্ঞান, চিন্তা ও বিভিন্ন রকমের গঠনমূলক আলোচনা ও পরামর্শের দ্বারা নেতাকে সাহায্য করেছিল, কন্যা হয়তো বিভিন্ন প্রজেক্টের ফান্ড সংগ্রহে সাহায্য করেছিল। তাই যেকোন প্রোগ্রামে নারীদের এসব আদিপরিচয়গুলোকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দিতে হবে।
২। পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়াঃ
পরিবারেই নারীরা সবচেয়ে বেশী অবহেলিত হয়, নির্যাতনের স্বীকার হয়। আমাদের রাসূল(সাঃ) এ ব্যাপারে অনেক সোচ্চার ছিলেন, আমাদেরও তাই হতে হবে।
৩।নারীর সেবামূলক কাজের স্পষ্ট স্বীকৃতি এবং কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ
অনেক সময়েই দেখা যায় কোন একটা সভাতে পুরুষেরা বক্তৃতা করছে, আবার শ্রোতারাও হয়তো পুরুষেরা বা নারীরাও। কিন্তু এর মাঝে কিছু নারী ব্যস্ত থাকে আপ্যায়নে, তাদের বক্তা হয়ে ওঠা হয় না, চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করার সুযোগ থাকে না। আবার অনেক নারী সপ্তাহান্তে বিভিন্ন স্কুলে বা ঘরোয়াভাবে শিশুদের ধৈর্যের সাথে ইসলামী শিক্ষা দিয়ে থাকেন, যেগুলো একটু কঠিনই। অথচ তাদের এ অবদানগুলোকে উচ্চারিতকন্ঠে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। বিভিন্ন সংগঠনের লিফলেট বা নিউজলেটারে এসব পর্দার আড়ালের নারীদের নাম কৃতজ্ঞতার সাথে উল্লেখ করা উচিত।
৪। নারীদের ব্যাপারে শিক্ষাঅর্জন (ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীসহ)ঃ
এক্ষেত্রে ইসলামের প্রথম যুগের বিভিন্ন মহীয়সী নারীদের যেমনঃ মরিয়ম(রাঃ), ফাতিমা(রাঃ), আয়েশা(রাঃ), খাদিজা(রাঃ) ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আরো জানতে হবে অন্যান্য মহিয়সী নারীদের ব্যাপারেও যারা যুগে যুগে ইসলামের পথে তাদের সময়, শ্রম, জ্ঞান, সম্পদ অকাতরে খরচ করেছেন, অথচ ইতিহাসে তেমন গুরুত্ব পাননি।
৫। ইসলামের বিভিন্ন মহিয়সী নারীদের নামে নারীশিক্ষার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করাঃ
এক্ষেত্রে আয়েশা(রাঃ) নামই প্রথমে আসে। তিনি তার জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা দিয়ে অসংখ্য মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাই বর্তমান যুগে নারীদের শিক্ষা(ইসলামী শিক্ষাসহ) অর্জনের ক্ষেত্রে মহীয়সী নারীদের নামে বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এতে করে এখনকার মুসলিম নারীরা উজ্জীবিত হবে, আত্মবিশ্বাসী হবে।
৬। জুমআর খুতবাতে নারীদের অবদানের কথাগুলোও নিয়মিত প্রচার করাঃ
আমাদের ইমাম এবং খতীব সাহেবেরা বিভিন্ন মহিয়সী নারীদের কথা খুতবাগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করবেন, ঘরে অবস্থিত মা-বোনদের ইসলামের ব্যাপারে আরো বেশী আগ্রহী করে তুলবেন, ইসলামে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে আরো বেশী বেশী করে বলবেন।
৭। বিভিন্ন মসজিদে, ইসলামিক সেন্টারে, সংগঠনে নারীর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব নিশ্চিত করাঃ
এটা শুধু মসজিদে নারীদের ইস্যু নিয়ে কথা বলার জন্য "নারী কমিটি" নয়, বিভিন্ন শূরা কমিটিতেও নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। রাসূল(সাঃ)-এর যুগে নারীরা বিভিন্ন মাসআলা জানতে সরাসরি নবীজীকে বা পরবর্তীতে বিভিন্ন খলীফাবৃন্দকে বা ইসলামী নেতাদের সরাসরি জিজ্ঞ্যেস করতেন, বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। এক্ষেত্রে তাদের কন্ঠস্বর যথেষ্ট বলিষ্ঠ ছিল, নীচুস্বর ছিল না।
৮। কথায়-কাজে-কর্মে দ্বৈতনীতি পরিহার করাঃ
পুরুষেরা কোন অনৈসলামিক, অনৈতিক কাজ করলে......পুরুষেরাতো অমন একটু-আধটু করবেই, এদিকে নারীরা তা করলে তাদেরকে চরিত্রহীন বলা --- এ জাতীয় ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অবশ্যই সকলকে ত্যাগ করতে হবে।
৯। মুসলিম নারীদের নিয়ে বিতর্ক ক্লাব গড়ে তোলাঃ
মুসলিম নারীদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতা বা নির্ধারিত বক্তৃতা বা উপস্থিত বক্তৃতা -- এ ধরণের অনুষ্ঠান বেশী বেশী করে আয়োজন করা এবং তাতে নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা। এতে করে বিভিন্ন আলোচনায় নারীরা ইসলামের নারীইস্যুগুলোতে আরো স্বচ্ছ ধারণা লাভ করবে। এক্ষেত্রে পুরুষেরাও অংশগ্রহণ করতে পারে, যাতে করে তারাও স্বচ্ছ ধারণা পায়।
১০। জ্ঞান বিতরণঃ
"জ্ঞানই শক্তি" -- মুসলিম নারীদের মাঝে এ ধারণা আরো বেশী বেশী করে ছড়িয়ে দিতে আরো বেশী বেশী করে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপের আয়োজন করা, এ আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন রকমের ইন্টারনেট সুবিধা গ্রহণ করেও সেটা করা যেতে পারে, যেমনঃ ই-মেইল, ব্লগ, ফোরাম, ফেইসবুকসহ নানা সামাজিক নেটওয়ার্কের সাহায্যে।
বিভিন্ন ভাষায় তথ্যগুলো অনুবাদ করে সারা বিশ্বে বিভিন্ন কমিউনিটিতে জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া।
আমি যদিও এখানে মুসলিম নারী এবং ইসলামের কথাই মূলত হাইলাইট করেছি, তবে এটা সমাজের যেকোন অংশের নারীদের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৯:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



