somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহ! ঢাকাই খাবার :)

০৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গমগম করছে চকবাজার। হইহুল্লোড় চলছে খুব। চলছে ব্যবসায়ীদের অবিশ্রান্ত বিকিকিনি। হঠাৎ নকিব আর চোপদারদের ছুটোছুটি...হুঁশিয়ার...! নবাব পরিবারের কেউ এলেন বোধ হয়। ৩০০ বছর আগের কোনো একদিনের ছবি এটি।
আজ নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ নেই। কিন্তু তবু সেই আগের মতোই গমগম করে চকবাজার। এখনো হাজারো সওদার পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। বাতাসে সুবাস ছড়ায় বৈচিত্র্যময় সব ঢাকাই খাবার। আর সেসবের স্বাদ আস্বাদনে দূরদূরান্তের মানুষ এসে জড়ো হন এখানে।
ঐতিহাসিকেরা বলছেন, ৪০০ বছর আগে ঢাকা যখন প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তারও আগে ঢাকায় জনবসতি ছিল। তাদের খাদ্যতালিকা, রন্ধনপ্রণালি ছিল এক রকম। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আদি খাবারে অন্য সব সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে। বহু বিবর্তনের পর খাবারে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজনে নতুন ধারার খাবারদাবার আত্মপ্রকাশ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শরীফ উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ঢাকাই খাবার বলে যে খাবারটা প্রচলিত, সেটা মূলত মোগলাই খাবার। তবে এর রকমভেদ আছে। পারস্যের খাদ্যরীতির সঙ্গে ঢাকার খাদ্যরীতির মিশেল ঘটেছে। রান্নার ঢঙে পরিবর্তন এসেছে। পারস্যের রান্নায় যে মসলা ব্যবহূত হয়, তার পরিবর্তে দেশীয় মসলা যুক্ত হয়েছে। কালক্রমে তৈরি হয়েছে নতুন এক ধারার খাবার। এটাই ঢাকাই খাবার।



ঢাকাই খাবারের ইতিকথা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ঢাকাবাসীর রসনাবিলাসের ঐতিহ্য সন্ধান করেছেন তাঁর ‘রসনাবৃত্তি: বৈচিত্র্য ও রূপান্তর’ প্রবন্ধে। কোথা থেকে এল ঢাকাই খাবার, সেটি খুঁজতে গিয়ে তিনি উদাহরণ টেনেছেন চর্যাপদ থেকে। তিনি বলেন, প্রাচীন যুগের (অষ্টম-দ্বাদশ শতক) প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন ‘চর্যাপদে’ চালের উল্লেখ আছে, দুগ্ধ ও দুগ্ধপানের কথা উল্লেখ আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে অবহট্ট ভাষায় লেখা ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ বইয়ের একটি পদে বলা হয়েছে, ‘...যে প্রেয়সী (নিয়মিত) ওগরা বা নরম-গরম ভাত কলার পাতায় গাওয়া ঘি-দুধের সংযোগে মৌরলা মাছের ঝোল ও নালিতা শাক পরিবেশন করে, তার কান্তা বা স্বামী (অবশ্যই) পুণ্যবান।’

ঐতিহাসিকেরা বলছেন, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ঢাকায় পাল ও সেনরাজাদের অধীনে জনগণের খাদ্যাভ্যাস ছিল এক ধরনের। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে ঢাকার খাদ্যতালিকায় প্রাধান্য পায় ভাত ও নিরামিষ। ধীরে ধীরে ভাত, মাছ ও দুধ ঢুকে যায় জনসাধারণের নিয়মিত খাদ্যতালিকায়। প্রাক-মোগল যুগে ঢাকার সুলতানি খাদ্যাভ্যাস ছিল তুর্কি, আরব, ইরানি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাদের মাংস ও রুটি খাওয়ার অভ্যাস ঢাকার ভাত-মাছের অভ্যাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এরপর আসে মোগলেরা। ঢাকায় সুবেদার ইসলাম খানের বাবুর্চিদের হাতে তৈরি খাবার মোগল খাবার হিসেবে পরিচিতি পায়। ঢাকার রান্নায় ব্যবহূত অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে দিনে দিনে এই খাবারই ঢাকাই খাবার নামে পুরান ঢাকায় প্রচলিত হয়। এসব খাবারের মধ্যে আছে বিরিয়ানি, কাবুলি, খিচুড়ি, শিরবিরঞ্জ, হালিম, বাকরখানি রুটি, চালের গুঁড়ার পিঠা, দোলমাজাতীয় তরকারি। পরে পর্তুগিজ, আর্মেনীয়, ইউরোপীয়সহ বিভিন্ন জাতির আগমনে মোগল চাপাতি রুটির পাশাপাশি পাউরুটি, বিস্কুট, পনির, ছানার মিষ্টি ঢাকাই খাবারের তালিকায় যুক্ত হয়।



কিছু খাবার হারিয়ে গেছে, কিছু টিকে আছে পরিবর্তিত রূপে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক কানিজ ই বতুল গবেষণা করেছেন ঢাকার বিলুপ্ত খাবার নিয়ে। তিনি বলেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মুনশি মীর আমান দেহেলভির (দিল্লিবাসী) ১৮০১ সালে প্রকাশিত বাগ ও বাহার বইয়ে শাহি নিমন্ত্রণের খাবারের তালিকায় তোররাবন্দি, শবডেগ, মোরগপোলাও, মোরগ মোসাল্লাম, সিশরাঙ্গা (খাগিনা), হালিম, নার্গিসি কোফতা, কাবাব, হারিরা, মাকুতি, মুতানজান, শিরমাল, গাওজাবান রুটি, গাওদিদা রুটি, বাকরখানি রুটি—এমন সব খাবারের নাম পাওয়া যায়। এসব খাবারের অনেকগুলো হারিয়ে গেছে। কিছু টিকে আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

কানিজ ই বতুল হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয় ‘জাহাজি কোরমা’র কথা বলেছেন। তিনি জানান, গরু বা খাসির হাড়বিহীন মাংস মরিচ ছাড়া জয়তুনের তেলে রান্না করে চীনামাটির পাত্রে করে সঙ্গে নিতেন সমুদ্রপথের যাত্রীরা। ১৫ দিন পর্যন্ত এই মাংস ভালো থাকত। সমুদ্রপথে যাঁরা হজ করতে যেতেন বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে আরব, ইরাক, ইরানসহ নানা দেশে যেতেন, তাঁরাই এমন খাবার সঙ্গে রাখতেন।



আরেক জনপ্রিয় খাবার রেজালা বাংলাদেশের যেকোনো উত্সবে অবিচ্ছেদ্য। ঐতিহাসিকেরা বলছেন, ‘রেজালা’ শব্দটি এসেছে ‘রজিল’ (নিম্নবিত্ত) থেকে। মোগল দরবারি লোকেরা খাবারে মরিচ ব্যবহার করতেন না। কিন্তু দরবারের কর্মচারীরা ছিলেন এ-দেশীয়। তাঁরা ঝাল খাবারে অভ্যস্ত ছিলেন। একপর্যায়ে দরবারের কর্মচারীরা কোরমায় ঝাল দিয়ে খেতে শুরু করলেন। এ খাবারের ভিন্ন স্বাদ ও ঘ্রাণের প্রতি ধীরে ধীরে অন্দরমহলের নারীরাও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁরা কাঁচামরিচের বোঁটা ছিঁড়ে বিচি ফেলার পর ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে দুধে ভিজিয়ে রাখতেন। তারপর দুধসহ কাঁচামরিচ কোরমায় দিয়ে ভিন্ন স্বাদের কোরমা, অর্থাত্ রেজালা রান্না করতেন।



ঢাকাই খাবার এখন

বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ঢাকাবাসীর কাছে প্রিয় ঢাকাই খাবার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকাই খাবারের সুখ্যাতি। এখনো রোজার মাসজুড়ে পুরান ঢাকার চকবাজারে চলে ঢাকাই খাবারের বেচাকেনা। চকবাজার ও এর আশপাশের এলাকা বাহারি খাবারের সুবাসে এখন ম-ম করছে। কয়েক শ বছরের পুরনো চকবাজারে এখনো বিরিয়ানি, মুরগি মোসাল্লাম, বিভিন্ন জাতের কাবাবের পাশাপাশি শরবত বিক্রি হয়।

চকবাজারের শরবত বিক্রেতা চুয়াডাঙার ছেলে জামান মিঞা অত কিছু বোঝেন না। শুধু জানেন এখানে বাহারি শরবতের চল আছে, ভালো বিকোয়। ‘কিংবদন্তির ঢাকা’য় নাজির হোসেন লিখেছেন, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ দাহম উপলক্ষে বিভিন্ন মহল্লা থেকে বহু লোক মওলুদ (মিলাদ) পড়ার জন্য সমবেত হতেন। অপরাহ্নে বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হত। এই অনুষ্ঠানে প্রৌঢ় ও যুবকেরা অংশগ্রহণ করতেন এবং এ দৃশ্য দেখার জন্য বহু লোক রাস্তা ও মসজিদের বারান্দায় সমবেত হতেন। তা ছাড়া এখানকার পান ও শরবত ছিল অত্যন্ত উত্কৃষ্ট ধরনের। এ জন্যও বহু দূরদূরান্ত থেকে লোক এখানে এসে পান ও শরবত খেয়ে তৃপ্ত হত। এককালে শহরের খোশবাশ বলে পরিচয় দানকারীগণ পান-শরবতের পশরা নিয়ে এখানে জলসার মত আড্ডা জমিয়ে রাখতো।’

জামান মিঞার মতো বহু মানুষ জেনে না-জেনে শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ফেরি করে বেড়ান। আর ভোজনরসিকেরা ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে বরাবরই ভিড় জমান পুরান ঢাকায়; আর রোজার মাসে তা যেন নতুন মাত্রা যোগ করে।শুধু ইফতারের জন্য নয়, মধ্যরাতে সেহরির জন্য ভিড় দেখা যায় পুরান ঢাকার খাবারের দোকানগুলোতে।
(সংগৃহিত)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×