নারীকে নিয়ে ইতিহাসে রুশো-রাস্কিন থেকে শুরু করে টলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার সহ প্রমুখ সাহিত্যিক কম মাতামাতি করেন নি। রুশো-রাস্কিনদের চিন্তাধারা যেমন প্রভাবিত করেছিলো রবীন্দ্রনাথকে। তেমনি তৎকালীন ইংল্যান্ডের সামাজিক প্রথা প্রভাবিত করেছিলো শেক্সপিয়ারকে। এক উপন্যাসে শেক্সপিয়ার বলেছেন- “ভাগ্যলক্ষ্ণী যাকে সুন্দরী করে, সে সতীসাধ্বী নারী হয় না। আর যাকে সতীসাধ্বী নারী করে, সে সুন্দরী হয় না।”
এমনিভাবে হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরীন নারীদের সম্মানের বর্তমান হাল-হাকিকত নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে সমাজের বুদ্ধিজীবীদের চোখ ঘোলা করে ছেড়েছেন। তসলিমা নাসরীনের কথা শুনলে মনে হয় নারীর গতিরোধ করে ফেলেছে ধর্ম যতোটা, ততোটা আর কিছুই করতে পারেনি। অন্যদিকে হুমায়ুন আজাদ ধর্মবর্ণের বাইরে গিয়ে সমাজে পুরুষের নারী সম্পর্কে যে তুলতুলে অনুভূতি আছে, সেটাকে মানবিকতার দোহাই দিয়ে নির্লজ্জ্বভাবে ধর্ষণ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
বস্তুতঃ নারী হচ্ছে কোমল পানীয়ের মতোই যা শুধুমাত্র পুরুষের আনন্দময় উদরপূর্তির জন্য অপরিহার্য। তেমনিভাবে পুরুষও নারীদের জন্য ফসলক্ষেতের লাঙ্গলমাত্র যা নারীদের গভীর রাতেই প্রয়োজন হয়। এছাড়া একে অন্যকে নিয়ে ভাবার ফুসরত কই? আর প্রেম-ভালোবাসার জন্য যে অদম্য অনুভূতি একে অপরের প্রতি অনুভব করে, তা স্পষ্টত গভীর রাতের চূড়ান্ত পরিণতির ভাবনা ভিন্ন আর কিছুই নয়। তবে চূড়ান্ত পরিণতি এক হলেও উদ্দেশ্যের সাফল্য সম্পর্কে খানিকটা পার্থক্য আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ প্রেম করার জন্য নারী খোঁজে, আর নারীরা বিয়ে করার জন্য পুরুষ খোঁজে। পুরুষের চোখে বরাবরই বিয়ে যেমন বোঝা বলে গণ্য, অধিকাংশ নারীর চোখে তেমন নয়। বরং বিয়েকে নারীরা তাদের জীবনের নিরাপদ ও অনিন্দ্য আনন্দময় আশ্রয় বলে গণ্য করে।
পাশ্চাত্য সমাজে নারী হচ্ছে পণ্য, আর উপমহাদেশে নারী হচ্ছে সমাজের প্রতিমা বা অলঙ্কার। এর মাঝামাঝি নারীদের যে অস্তিত্বের বিকাশ প্রয়োজন, তা নারীরা কখনোই করে উঠতে পারেনি। নারী গবেষক ও হুজুগে পন্ডিতদের মতে, পুরুষই নারীকে এগোতে দেয়নি। কথা যে ডাহা মিথ্যা নয় তা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এও তো সত্যি যে, নারীকে রুখতে গিয়ে পুরুষও সেভাবে এগোতে পারেনি!
বেগম রোকেয়া বলে গেলেন- নারী ও পুরুষ একত্রে কাজ করলেই মানবজীবনের উৎকর্ষ সাধিত হবে। কিন্তু একত্রে কাজ করতে গিয়ে গণ্ডগোল বাড়ছে বৈ কমছে তো না। সমাজ যে পুরুষশাসিত, সে ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এ কারণেই একত্রে কাজ করা থেকে শুরু করে, কবিতার পাতা কিংবা গল্পের খাতায়, বিজ্ঞাপনের নাচ, কিংবা সিনেমার ফিতায়- সবখানেই সাধারণ নারীরা উপেক্ষিত। সেখানে অতিমানবী অতীব প্রয়োজন। যে মানবীকে হতে হবে এক্সট্রা ধরণের সুন্দরী, যার হাসিতে পুরুষের ভিতর থেকে বাইরের অবস্থা উথলে পড়বে, যে কথা বললে ভোগের তীব্র কামনা-বাসনায় পুরুষের রক্ত ছলকে উঠবে- তবেই না কবিতা, গল্প, বিজ্ঞাপন কিংবা সিনেমা হবে সার্থক।
এসব কথার ধূয়া তুলে নারীদের হীন অবস্থা বয়ান করে নারীদের অসহায়ত্বের প্রতিধ্বনি তুলেন যেসব বুদ্ধিজীবীরা, তারাও কি কখনো কোনো সিনেমায় কালো কুৎসিত নায়িকা দেখার জন্য প্রস্তুত থাকেন? রজনীকান্তকে নায়ক মানতে কারো আপত্তি নেই, কিন্তু তার মতো কুচকুচে কালো কাউকে কেউ নায়িকা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না কেনো? কিংবা কোনো কবিতায় থেবড়া নাক আর পুরু ঠোঁটের নারীকে কল্পনা করতে প্রস্তুত থাকেন?
এসব ক্ষেত্রে কোনোকালে সাধারণ নারীদের দাম ছিলো না, এখনও নেই। সৌন্দর্য্যের পূজারী পুরুষরা, কারণ নারীরা সৌন্দর্য্যের প্রতীক। যে কারণে সুন্দরী হওয়া মাত্রই নারীরা বুঝে ফেলে যে, ‘My beauty is my capital,’ যে নিজের সৌন্দর্য্যের গুরুত্ব না বুঝে একে যাচ্ছেতাই ভাবে ব্যবহার করে, কিংবা ভূগর্ভস্থ সম্পদের মতোই কুমারীত্বের খোলসে নিজেকে আটকে রাখে, সে হয়তো পুরুষের চোখে হয় নন্দিত। কিন্তু নারীজাতই তাকে বোকা বলে সম্বোধন করে। (নারীর এই চিন্তাধারাও নাকি পুরুষ শাসিত সমাজের ফল! তারা যাই করুক, ভুল হলেই পুরুষ শাসিত সমাজের ফল!) তাছাড়া নারীর যৌবন, অর্থাৎ ক্যাপিটাল বা সম্পদকে জিইয়ে না রাখলে পুরুষ এক সময় নারীর রহস্যময়ী-আবেদনময়ী আচরণ ভুলে নারীর প্রতি বিতৃষ্ণায় ভুগবে। সুতরাং অস্তিত্বের সংকট মোকাবেলা করার জন্যই, পুরুষের আসক্তি বৃদ্ধি করার জন্য নারী বরাবরই চেষ্টা করে আসছে, কারণ তার প্রকৃতি প্রকৃতপক্ষেই দুর্বল ও পুরুষনির্ভর।
নারীর গঠন খুবই ভঙ্গুর-
কারণ যে নারীকে আঠারোতে লাগে কুঠারের মতো ধাঁর। সে নারী কুড়িতেই হয়ে উঠে একান্ত বুড়ির মতো ভার।
এতো চটজলদি যে রূপের উথান, ততো চটজলদি সেই রূপের পতন কি নিতান্ত দুঃখজনক নয়? নিতান্ত ভঙ্গুর নয় কি নারীর দেহপল্লব?
পুরুষ সহজে উপরে উঠেনা, আর একবার উপরে উঠতে পারলে সহজে নামে না। সে তুলনায় পুরুষরা শক্তিমত্তা বাদ দিলেও প্রাকৃতিকগতভাবে এগিয়ে।
মজার ব্যাপার হলো এরমধ্যে নারীর আয়ু হয়ে থাকে পুরুষের চেয়ে বেশী, পক্ষান্তরে পুরুষের আয়ু নারীর চেয়ে কম।
এতো বৈচিত্র্য এই দুই লিঙ্গে, আবার এতো নির্ভরশীলতা একে অপরের প্রতি- তবুও কেনো এদের একজনকে অন্যের প্রতি প্রাধান্য দেয়া? এ কি সমাজে হইহট্টগোল বাঁধানোর চেষ্টা করা দু’পক্ষের মধ্যে? যারা বলছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা নারী তীব্রভাবে শোষিত হচ্ছে, তারা কি জানে যে তারা নিজেরাও শোষিত হচ্ছে ঘরে বা বাইরে, নারী কিংবা পুরুষের দ্বারা? শোষিত তো সবাই হচ্ছে- দুর্বল সবল কতৃক শোসিত হওয়ার এ ধারা তো নতুন নয়। সভ্যতার শুরু থেকে চলছে এ ধারা। যার পরিপ্রেক্ষিতে নারী হয়েছে ভোগের সামগ্রী, আর পুরুষ হয়েছে সেবার দাস। আবার সেই নারীও কখনো কখনো রানীর কাতারে গিয়ে করেছে পুরুষকে শোষণ। সবই সবল কতৃক দুর্বলকে।
হুমায়ুন আজাদ সাহেবের মতে, “নারী মুক্তি চায় পুরুষের অধীনতা থেকে, বিয়ে থেকে নয়। তবে বিয়ে যে করতেই হবে, মাংসকে সুখী করতে বিয়ে যে বিকল্পহীন উপায়, তাও নয়। বিয়ে একটি প্রথা মাত্র।”
নারী স্বাধীনতার স্বাদ মানে হচ্ছে পুরুষের কথা না মেনে বেরিয়ে আসা। আর বিয়ে থেকে দূরে থাকার মাধ্যমেই পুরুষের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব। অপরদিকে, পুরুষ যদিও স্বাধীন, তথাপি সে তার স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ নারীর উপর নিতে চায় বলে পরিবার-সমাজ প্রভৃতি প্রথা এখনো পৃথিবীতে বিদ্যমান। যদি কেউ কাউকে আপন না ভেবে, অধীন না ভেবে, শুধুমাত্র নিজের সুপার পাওয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তবে এই জগৎ সংসারে সংসার ধর্ম পালন আস্তে আস্তে হ্রাস পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। নারী বুদ্ধিজীবীদের মতে, নারীর ঘর ঝাড়ু দেয়া, বাচ্চা পালন করা, স্বামীর সেবা করা, এবং বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করতে চাওয়া কোনো জীবন নয়। এগুলো হচ্ছে বন্দিত্বের দীর্ঘকালীন প্রভাব। যদি তাই হয়, তবে যেসব পুরুষরা জীবনে বড় হবার চেষ্টা করছে শুধুমাত্র একজন নারীর সাথে সংসার ধর্ম পালন করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য, তারাও কি জীবন নামক হিসাবে বন্দিত্বের মধ্যে থাকবে বুদ্ধিজীবীদের হিসাব অনুযায়ী?
পৃথিবীর একটি চরমতম সত্য নিয়ম হচ্ছে, একদল কর্মী কাজ করবে, অন্যদল সেই কর্মীদের খাদ্য ও সেবা যোগান দিবে। সবাই কাজ করলে কর্মী হয়তো বাড়বে, কিন্তু কর্মীদের খাদ্য ও সেবার অভাবে কাজের মধ্যে সৃজনশীলতা আসবে না।
মানুষ গোঁয়ার-গোবিন্দ হলেই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যেতে চায়। এখন যদি বলা হয়, পুরুষদের বাচ্চা ধারণ করতে হবে এবং নারীদের বাচ্চার জন্য স্পার্ম নিংড়ে বের করতে হবে, কারণ নারীদের বাচ্চা ধারণ করতে দিয়েই তাকে অবলা করা হয়েছে- তবে ব্যাপারটা কেমন হয়?
জাফর ইকবালের একটি সাইন্স ফিকশন উপন্যাসে শক্তিশালী নারী সমাজের কথা আছে। সেখানে পুরুষরা নীরব ও দুর্বল। সেই উপন্যাসে যদিও নারীরা বাচ্চা প্রসব করে, তবে তারাই সংসারের নেত্রী এবং পুরুষের কাজ ঘর দেখাশোনা, রান্নাবান্না করা। এখন প্রাকৃতিক সিস্টমের হিসেব বাদ দিয়ে, সেই উপন্যাসের সমাজের পুরুষ যদি বলে আমি রান্না করবো না। আমি নারীর সাথে চাকরি করবো এবং ব্যবসা করবো, তবে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যই বা থাকে কোথায়, আর ভালোবাসামূলক ভাগাভাগিই বা থাকে কোথায়?
তখন বলতে হয় সেই বুদ্ধিজীবীদের মতো- কোনো সংসার ধর্ম পালনের প্রয়োজন নেই। বিয়ে-থিয়ে বাদ। ভালো লাগে তো বিছানা শেয়ার করা যাবে সর্বোচ্চ। তারপর তুমি তোমার পথে, আমি আমার পথে। চূড়ান্ত বিপদে কিন্তু নারীরাই পড়বে তবে। কারণ এমন ব্যবস্থার সাথে জঙ্গলের ব্যবস্থার কোনো পার্থক্য নেই। জঙ্গলে বাবা কোনো দায়িত্ব নেয় না। মায়েরাই সমস্ত জগতের হিংস্রতা থেকে নিজের উদরজাতকে রক্ষার প্রাণানিপাত চেষ্টা করে থাকে।
তারচেয়ে ভালো সমাজে বিয়ে প্রথার মাধ্যমে মাংস ও আত্মা উভয়ই সুখে থাকুক, উভয়ে উভয়ের পরিপূরক হোক।
আরাফাত নিলয়
ব্লগার, কলামিস্ট, লেখক
আলোচিত ব্লগ
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর
বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছবির গল্প, গল্পের ছবি
সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!
কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন