somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিন্নর

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এটা সুউচ্চ হিমালয়ের শীতল মেরু অঞ্চল৷ বৃষ্টি হয় না বললেই চলে৷ দু’পাশের অবিন্যস্ত সারি সারি শৃঙ্গের ধার বেয়ে নেমে এসেছে শুধু পাথর আর পাথর৷ চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলাখণ্ড ও ঝুরঝুরে মাটির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে পথ৷ নিচে গভীর খাদ, বয়ে চলেছে স্পিতি নদী৷ অদূরে পাহাড়ের ঢালে খচিত আছে বৌদ্ধ মন্ত্র ‘ওম মণি পদ্মে হুং’৷ আর তারই পাশে মুদ্রিত অক্ষরের মতো উন্নত শৃঙ্গের জানু বেষ্টন করে রয়েছে শিশুদের আঁকা ছবির মতো সমতল ছাদ, চৌকো দেওয়াল উজ্জ্বল বর্ণযুক্ত কতগুলো কুটির নিয়ে তৈরি টাবো গ্রাম৷ গ্রামের নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে নীল আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত ধ্বজাধারী একটি সৌধ ১০২০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মঠ, টাবো মনাস্ট্রি৷


অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ৷ এইসময় তিব্বত ঘেঁষা হিমাচল প্রদেশের এই সীমান্তবর্তী জেলা লাহুল ও স্পিতির ভয়ংকর সৌন্দর্য উপভোগ করার সাধপূরণ করা দুরুহ৷ তবে অনুকূল আবহাওয়া এবং পৃথিবীব্যাপী উষ্ণায়নের প্রভাবে পাথুরে পথ তখনও বরফ পড়ে উঁচু জিপের পক্ষে অনতিক্রম্য হয়ে ওঠেনি৷ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চললাম ঈপ্সিত লক্ষ্যে৷ কিন্নর জেলার শেষ গ্রাম কল্পা থেকে নাকো হয়ে আমাদের গন্তব্য কাজা৷ সেখানে রাত্রিবাসের পর কুনজুম পাস অতিক্রম করে চন্দ্রতাল দেখে একই দিনে ফিরব মানালি৷ পুরো পথটাই দুর্গম ও রোমাঞ্চকর৷ এক জায়গায় পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ধস নেমে৷ ‘বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন মিলিটারি’-র সাহায্যে ডিনামাইট ফাটিয়ে হারিয়ে যাওয়া একচিলতে মেঠোপথের অনুসন্ধান করছে৷ নাকো থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ ৮ ঘণ্টায় অতিক্রম করে যখন টাবো পৌঁছলাম, তখন সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে৷


একসময় এই অঞ্চলটি পশ্চিম তিব্বতি রাজবংশ পুরুং গুগে-র অধীনে ছিল৷ তারও আগে এখানে ঝাং ঝুংরা রাজত্ব করত৷ পুরং গুগ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ই-শেশ-ও’দ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ লামা৷ তিনি ও তাঁর দুই পুত্র মিলে ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মহাযান বৌদ্ধ শাখার অন্তর্গত বজ্রযান সংঘের মত-অবলম্বনে টাবোর এই ধর্মচর্চা কেন্দ্রটি স্থাপন করেন৷ মন্দিরের স্থাপত্যে গ্রিক ও বৌদ্ধ কলার মিলন চোখে পড়ে৷ নান্দনিক সুষমায় মণ্ডিত এর শিল্প গবেষকদের কাছে এক ঐতিহাসিক সন্দর্ভ৷ সংস্কৃত, পালি ও তিব্বতি ভাষায় রচিত বহু প্রাচীন পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি মন্দিরের সংগ্রহশালায় রক্ষিত৷
টাবো গ্রাম বাঁদিকে ফেলে আরও ৩০ কিলোমিটার বন্ধুর পথ পেরিয়ে তবে কাজা৷ ৫০০ মিটার উঠলাম৷ অপেক্ষাকৃত চওড়া এই অধিত্যকায় স্পিতি নদী পলি জমে বিভক্ত হয়েছে একাধিক স্রোতে৷ কাজা পৌঁছতে দিন ফুরল, আকাশে তখন লক্ষ্মীপূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে৷ রুপোলি জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয়েছে পুরো উপত্যকা৷ সে এক অনন্য নৈসর্গিক শোভা৷


কাজা থেকে রওনা হলাম ভোরের আলো ফোটার আগেই৷ আজ আমাদের পাড়ি দিতে হবে ২২০ কিলোমটার পথ, পুরোটাই খাড়া৷ পাহাড়ের জীর্ণ ঢাল, বড়-ছোট পাথর আর তার ওপর আছড়ে পড়া জলপ্রপাতের বেগবতী স্রোতের মধ্য দিয়ে৷ অনতিদূরে আর একটি প্রাচীন গুম্ফা, মনাস্ট্রি৷ সেটি ছুঁয়ে পথ গিয়ে মিশেছে কুনজুমের দিকে৷ এই বৌদ্ধ বিহারের সংলগ্ন পাহাড়ের আনাচে-কানাচে অ্যামোনাইট এবং বেলেমনাইট জীবাশ্মের সন্ধান মেলে৷ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে হিমাচলের কাংড়া জেলার ডেপুটি কমিশনার ফিলিপ হেনরি এগরটন এই অঞ্চলটি ঘুরে দেখেন৷ তার মুদ্রিত ডায়রি ‘জার্নাল অফ এ ট্যুর স্পিতি’ হল এই অঞ্চলের প্রথম ফোটোগ্রাফি ডকুমেন্ট৷
কুনজমের পথে আর একটু এগিয়ে ভারত-তিববত সীমান্তে ছোট্ট গ্রাম গিঁউ৷ এখানে মিলিটারি ছাউনি আছে৷ গ্রামবাসীর এক নিরালা কুটিরে প্রাতরাশ সারলাম আলুর পরোটা আর ঘন দুধওয়ালা চা-সহযোগে৷ এই অঞ্চলের এথনিক পানীয়, খেলে নেশা হয়৷ যখন কুনজুম পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় দশটা৷ আপাদমস্তক মোটা জ্যাকেট ঢেকে গাড়ি থেকে নামলাম৷ মনে হল, পৃথিবীর শিখরে উঠে এসেছি৷ প্রচণ্ড হিমেল হাওয়া যেন সূচ ফোটাচ্ছে গালে আর কপালে৷ স্পিতি ও লাহুলের মধ্যে সংযোগকারী মাউন্টেন পাস এই কুনজুম৷


প্রান্তর পেরিয়ে ওপারে পাহাড়ের ঢালে এসে পড়তেই দেখা দিল গভীর খাদে চন্দ্র নদীর শীর্ণ জলরেখা৷ এখান থেকে ১২ কিমি বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে চন্দ্রতাল (হ্রদ) তীরবর্তী গাড়ি রাখার জায়গা৷ সেখানে থেকে পায়ে হেঁটে আরও দেড় কিমি পথ গেলে হ্রদের নীল জল স্পর্শ করা যাবে৷ হ্রদে পৌঁছনোর প্রায় ৩ কিমি আগে পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নাব্য ঢালে কতগুলো প্রাইভেট টেন্ট রয়েছে৷ পূর্ণিমার রাতটা এখানে কাটালে চাঁদের আলো মাখা হ্রদের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা যায়৷
বেলা সাড়ে এগারোটায় আমরা হ্রদের কিনারায় এসে পৌঁছলাম৷ দুই পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত গভীর খাদ ভরাট হয়ে এই প্রাকৃতিক হ্রদের সৃষ্টি কয়েক মিলিয়ন বছর আগে৷ একটু দূর থেকে দেখলে আলোকরশ্মির ছটার কারণে জলের যে নীল রংটা বোধ হয়, কাছ থেকে দেখলে সেই জল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও সবুজ৷ হ্রদের অন্য প্রান্তটি পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গিয়েছে৷ সেখানে থেকেই একটা জলধারা চন্দ্র নদী লাহুল উপত্যকায় গিয়ে ভাগা নদীর সঙ্গে মিশেছে৷ কথিত আছে, মহাভারতের পাণ্ডবেরা এই হ্রদের তীরে দিন কাটিয়েছিলেন৷ রামভক্ত হনুমান এই হ্রদের জলপান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন৷


চন্দ্রতাল থেকে বাতাল হয়ে গ্রামফু পর্যন্ত পথ অত্যন্ত রূঢ়৷ এবড়ো-খেবড়ো পাথর আর পিচ্ছিল জলস্রোত অতিক্রম করে গ্রামফু পৌঁছলাম সন্ধে ছটায়৷ সেখান থেকে রোটাং পাস অতিক্রম করে৷
কীভাবে যাবেন:
শিমলা থেকে টাটা সুমো জাতীয় উঁচু জিপ ভাড়া করুন দশদিনের জন্য৷ প্রথমে যান সারাহান, সেখান থেকে কল্পা, তারপর নাকো, কাজা হয়ে মানালি৷
কোথায় থাকবেন:
সারাহান আর কল্পায় থাকুন দু’রাত করে এইচপিটিডিসি-র হোটেলে৷
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×