ঘুম থেকে জেগে উঠে আমি ভীষণ রকম চমকে উঠে চঁওকির উপর বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমার সামনে বসে আছে যেন সমুদ্র থেকে উঠে আসা কোন জলপরী। পুরো শরীরটাকে শুধু একটি জামদানী শাড়ি দিয়ে একপেচে ঢেকে রেখেছে কিন্তু সেই বৃথা চেষ্টা যেন তার যৌবনের কাছে ম্লান হয়ে ধরা দিয়েছে একটু পৃথিবীকে মায়ার বাঁধনে জড়াবে বোলে। আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে জানতে চাইলাম আপনি কে ? আর আমি এখানে কিভাবে এলাম ? মেয়েটি আমাকে জানাল তার নাম শ্রাবণী। সে একটি যাত্রা দলের সাথে নর্তকীর কাজ করে। আমি যখন জ্ঞ্যান হারিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পরে ছিলাম তখন তারা আমাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে এসেছে তাদের এই বস্তীতে আর ওদের সেবা শুশ্রূষা পেয়েই আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমি নিজেকে তখনও সামলে নিতে পারছিলাম না আমার এই পরিনতির কথা ভেবে। শ্রাবণী আমার কাছে আমার পরিচয় জানতে চাইল। আমি ভাবলাম যদি আসল পরিচয় তাদের জানিয়ে দেই তবে হয়ত নানা রকম ঝামেলায় পরতে হতে পারে তাই মিথ্যা একটি গল্প বোলে দিলাম যে আমি খুব গরীব কাজের সন্ধানে এখানে এসেছিলাম, আমার কেউ নেই এই পৃথিবীতে, আমি খুব একা। কোথাও কোন কাজ না পেয়ে কয়েকদিন যাবত না খেয়ে থাকার কারনে সেই দিন অজ্ঞ্যান হয়ে পরে ছিলাম ওই বাসস্ট্যান্ডে। মনে হল আমার এই মিথ্যায় কাজ হল। শ্রাবণী আমাকে বলল যে তার মালিককে বোলে আমাকে একটা কাজের ব্যাবস্থা সে করে দিতে পারবে আর আপাতত তার এখানেই আমাকে থাকার জন্য জায়গা করে দিল। আমি নতুন এক জীবনের হাতছানিতে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হলাম।
যাত্রা দলের মালিকের নাম নীরঞ্জন। সবাই তাকে দাদা বলেই ডাকে। খুব ভাল একজন মানুষ। অন্যের দুঃখকে নিজের দুঃখ বোলে মনে করে নিজের সাধ্যের বাইরে কিছু করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। আমাকে আপাতত দাদা তার দলের শিল্পীদের সাথে থেকে অভিনয় শেখার জন্য তাগিদ দিলেন। আমিও ঘুরে ফিরে নিতাই, সুমা, সোহাগ, রমেশ, যূথী আরও যারা ছিলেন এই মুহূর্তে অনেকের নাম মনে পরছেনা তাদের সাথে তাদেরই একজন হয়ে মিশে গেলাম। ভালই অভিনয় শেখা হয়েছিল এইসব গুণী যাত্রা শিল্পীদের কাছ থেকে। এইখানে বোলে রাখা দরকার যে তাদের কাছে আমি সেই দিন আমার নাম বলেছিলাম অথর্ব। ওহ ! আমিত সেই যাত্রা দলের নামই বলতে ভুলে গেছি সেই যাত্রা দলের নাম ছিল “ভবের রঙ্গলীলা যাত্রা গোষ্ঠী” আজ সেই যাত্রা দলের কি অবস্থা কিংবা আদৌ সেই দল টিকে আছে কিনা আমার জানা নেই। কারন এই ঘটনা আজ হতে প্রায় এক যুগেরও বেশী আগের ঘটনা। আমি আর তাদের কোন ঠিকানা রাখিনি কোনরকম পরে আর যোগাযোগ করা হয়নি। শ্রাবণীর কথা মাঝে মাঝে মনে পরে খুব কিন্তু কেমন আছে জানিনা। দোয়া করি যেখানেই যেভাবেই থাকুক আল্লাহ যেন তাকে ভাল রাখে। শ্রাবণীর সাথে আমার যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত আমি অবশ্য তাকে কোন রকম প্রশ্রয় দেয়নি কোন অবস্থাতেই। এই জন্য হয়ত শ্রাবণীর মনে অনেক ক্ষোভ ছিল কিন্তু আমি আজো তার কাছে কৃতজ্ঞ এবং ঋণী শুধু ক্ষমা চাই যে আমি তার ঋণ শোধের জন্য তার প্রেমের ডাকে সারা না দিয়ে তাদের সবার কাছ থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলাম।
রেশমি আমার চিঠি পেয়েও তার অভিমান নিয়ে যখন অবিচল থেকেছে আমি তখন পাগল প্রায়। এরপর আমি বহুবার অনেক রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছি তার অভিমানের জানালা খুলে ভালোবাসার স্বর্গ গড়তে কিন্তু কখন যে আমি নিজেই নড়কের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলাম নিজেও টের পাইনি। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাস বাকি অথচ আমি টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করার জন্য স্কুল থেকে বোলে দেয়া হল যে আমাকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করতে দেয়া হবেনা। আর যদি আমি পরীক্ষা দিতে চাই তবে আমার বাবাকে বন্ড দিতে হবে স্কুলের কাছে যে ছেলের পরীক্ষায় পাসের সকল দ্বায় হবে আমার বাবার। আমার বাবাও প্রচণ্ড একরোখা মানুষ তিনিও সেই বন্ড দিতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং আমাকে বাসায় প্রচণ্ড রকম উত্তম মধ্যম দিলেন। সাথে আমার মাও অংশ নিলেন। ডাল ঘুটনি পুরোটাই আমার পিঠে ভাঙ্গলেন। আমার বাবা আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিলেন। আমার কেবলই মনে হল বেঁচে থাকার আর কোন অর্থ নেই। আমাকে হয় আত্মহত্যা করতে হবে নতুবা ঘর ছেড়ে পালাতে হবে। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না, এভাবে বেঁচে থাকতে নেই। তাই ঠিক করে ফেললাম আত্মহত্যা করব না বরং আমি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাব অনেক দূরে যেখানে আমাকে কেউ আর কোন দিন খুঁজে পাবেনা।
সারা রাত ধরে নিজের ঘরে নিজেই চোর হয়ে গেলাম সেই রাতের জন্য। বাবার মানিব্যাগ থেকে যাই পেলাম সব টাকা চুরি করে নিলাম। তারপর আলমিরার চাবি খুজলাম কিন্তু অনেক খোঁজার পরেও যখন চাবি আর পেলাম না তখন আশা ছেড়ে দিয়ে বাবার মানিব্যাগ থেকে যা পেলাম তাই নিয়ে ভোর বেলায় ঘর থেকে বেড়িয়ে পরলাম। আমি যখন বের হচ্ছি তখন ফজরের আযান ভেসে আসছিল আমার কানে মসজিদ থেকে। ভাবলাম এই বুঝি আমার নতুন জীবন সার্থক হবে। আল্লাহ আমার সাথেই আছেন। আমি শুধু একবার পেছনে ফিরে তাকালাম আর বললাম বিদায় আমার পরিবার আর বিদায় রেশমি তুমি সুখে থেক দোয়া করি তুমি তোমার প্রিয় কাউকে যেন খুঁজে পাও আর তাকে নিয়ে সুখি হতে পার। আজ ভাবি আল্লাহ আমার সেদিনের সেই দোয়া সত্যি কবুল করেছিলেন। রেশমি সত্যি আজ তার প্রিয় ভালোবাসার মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছে।
আমি ঢাকা থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে এলাম। সেখানে চার-পাঁচ দিন থাকার পরই আমার পকেটের টাকা শেষ হয়ে যাওয়াতে বেশ বিপাকে পরতে হল। একবার ভেবে ছিলাম ঢাকাতে ফিরে যাই কিন্তু সেটাও টাকার অভাবে সম্ভবপর মনে হল না। আবার ভেতরে একধরনের অভিমান কাজ করছিল যে আমি আর কখনই ঢাকায় ফিরে যাব না। কে আছে আমার সেখানে ! তারপর প্রায় তিনদিন সম্পূর্ণ না খেয়ে এদিক সেদিক একটা কাজের সন্ধান করে অবশেষে কোথাও কোন কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে পরলাম। যেখানেই যাই সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। আমি আর না পেরে ভাবলাম না অনেক হয়েছে এবার বাড়ি ফিরে গিয়ে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে সুবোধ বালকের মত জীবন যাপন শুরু করব। যাই বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে দেখি বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসের ড্রাইভারকে যদি মানাতে পারি তবে আমার হয়ত ঢাকায় ফেরা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌছতেই যেন আমার চারিদিক সাদা হয়ে গেল আমি চোখে সাদা আলো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলামনা। শুধু মনে হলে এই বুঝি আমি স্বর্গে পৌঁছে গেছি তারপর আমার কাছে সবই শুধু বিস্মৃতি হয়ে আছে।
(চলবে .........)
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান - ২য় পর্ব
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান - ১ম পর্ব
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




