আমি প্রায় একমাস সেই যাত্রা দলের সাথে ছিলাম। অন্যান্য যাত্রা দলে কি ঘটে জানা নেই তবে এখানে দেখেছি শিল্পী - কলাকুশলীদের জীবনযাত্রার জন্য কতটা ত্যাগ, কতটা বেঁচে থাকার তাগিদে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে হয়। একদিকে যেমন রয়েছে সমাজের মানুষদের অবজ্ঞা অন্যদিকে সঠিক মূল্যায়নের অভাব কিংবা সঠিক পারিশ্রমিকের অভাব তাদের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে অমানবিক। হয়ত এই কারনে তাদের অনেক কেই আমি বেছে নিতে দেখেছি অনৈতিক পথ বিশেষ করে নারী শিল্পীদের বেলায় অনেকটা জোড় করেই মূল্য দিতে হয় তাদের নারী হবার।
আমার সকল প্রকার মাদক দ্রব্য যেমনঃ গাঁজা, মদ, হেরোইন, ফেন্সিডিল ইত্যাদির সাথে পরিচয় হয় এই যাত্রা দলের সাথে। আমি দেখতাম এইসব মাদকদ্রব্য নারী অথবা পুরুষ সবাই খুব অনায়াসেই সেবন করত। যেন তাদের সব দুঃখ কষ্টের একমাত্র পরিত্রান রয়েছে তাতে। আমাকে প্রথম যূথী এগুলো সেবনের জন্য অনুপ্রেরনা দেয়। আমিও যূথীর সাথে থেকে ভালই রপ্ত করে ফেলি মাদকদ্রব্য সেবনের মহিমা। খুব বিরক্ত লাগত যে কিছু মেয়ে ছিল তাদের ন্যাকামি ছিল চরম মাত্রায়। কথা বলতে বলতে গায়ের উপর হেলে পরা অথবা কথার মাঝে গাঁয়ে চিমটি কাঁটা। উফ চরম অসহ্যকর ছিল সেইসব ন্যাকামি। একদিন আমার এইধরনের ন্যাকামির প্রতি অনীহা দেখে শ্রাবণী বাকি মেয়েদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল। তারপর থেকে দেখতাম কোন মেয়ে আমার কাছে আর ভিড়ত না। বেশ ভাল হয়েছিলো সেদিনের ঘটনায়। শ্রাবণী অবশ্য একদিন নিষেধ করেছিলো যেন আমি যূথী মেয়েটির সাথে না মিশি কারন ওর চরিত্রে নাকি দোষ আছে। আমি অবশ্য তেমন দোষ খুঁজে পাইনি এক মাদকদ্রব্য সেবন ছাড়া। এমন মাদকদ্রব্য যেমন দেখেছি দাদাকে নিতে, সোহাগ, নিতাই কে নিতে তেমনি দেখেছি শ্রাবণীও মাদকদ্রব্য সেবন করছে। সবাইত মাদক দ্রব্য সেবন করছে তাতে করে যূথীর চরিত্র কি করে খারাপ হয়েগেল সেটা অবশ্য বুঝেছি এক রাতে। দেখলাম মাঝরাতে প্রায় নগ্ন হয়ে কোথা থেকে যেন ফিরছে যূথী তাও আবার সম্পূর্ণ মাতাল অবস্থায়। আমার আর সেই রাতে তার চরিত্র নিয়ে বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু এখানেই আমি ভুল করেছিলাম কারন যূথীকে সেই রাতে তার নারী হবার মূল্য দিতে হয়েছিলো বস্তীর মালিকের কাছে। এর সবই দাদা অবশ্য জানতেন কিন্তু তিনি নিরুপায় ছিলেন তার দলের মঙ্গলের স্বার্থে। নাহলে এখান থেকে আপাতত উচ্ছেদ হলে হঠাত করেই তাদের পথে নামতে হবে। এমনিতেই তখন তেমন কাজ হাতে ছিলনা। আমাকে শ্রাবণী কেন যূথী সম্পর্কে খারাপ ধারনা দিয়েছিলো সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় একরাতে আমি অতিমাত্রায় গাঁজা খেয়ে ঘরে ধুঁকতেই শ্রাবণী আমাকে কেঁদে কেঁদে বলল, “তুমি আবার যূথীর সাথে বসে গাঁজা খেয়েছ, কেন আমার সাথে ঘরে বসে গাঁজা ক্ষেতে তোমার আপত্তি কোথায় ? আরে আমিত তোমাকে আমার ঘরে আশ্রয় দিয়েছি নাকি ওই যূথী দিয়েছে । আজ যূথী তোমার আপন হয়ে গেলো আর আমি তোমার কেউ না ! আমার ভালোবাসায় কি অপূর্ণতা রয়ে গেছে” আমি বললাম, “দেখ শ্রাবণী আমি আজ মোটেও যূথীর সাথে বসিনি। আজ আমাকে নিতাই গাঁজা সেবন করিয়েছে” কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি কেন তুমি বোঝনা” আমি শুধু মনে মনে কাঁদলাম হায়রে ভালোবাসা যার জন্য আজ আমার এই দশা সেত আমাকে সেই দিন এভাবে জড়িয়ে ধরে বললনা এই কথা আর যার কাছে এই কথা আশাও করিনা সেই কিনা বলে আমায় ভালোবাসে আর আমি কেন বুঝিনা ! এই কি তোমার নীতি হে আমার ভাগ্যবিধাতা !
যাত্রা
-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন, সেইত সেই অচেনা ভূবনের কোন গোধূলী বেলা;
অচেনা পথে আশাহত কিশোরের ফেরারি পথ চলা।
পরিচয়হীন নামনাজানা ব্যাথাতুর সেত,
ছোটেনি কভু কোন নষ্ট নারীর মোহে।
অশালীন ধরণীর পথে – পথে
যাযাবর সে ঘাম ঝরা দেহে,
চলেছে বিজয়ের রাজমুকুট পেতে।
তবু, অবিরাম দীপ্তিমান
কিশোরের যাত্রার যত জ্বালা –
যাত্রা ।।
আঁধার রাতে সবই যেন তার প্রেমে পূর্ণিমার চাঁদ;
ক্ষয়ে যাওয়া নক্ষত্রেরা যেন তার হৃদয়ের স্বাদ।
ঠিকানা বিহীন কলিযুগে একাকী সেত,
পায়নি কভু কোন পরমা নারীর প্রেম।
একটাই ঠিকানা তার যেতে – যেতে
মৃত্যুর পরে পরপারের অখণ্ড দীনে,
যেখানে সে জীবনের শেষ মুকুট পাবে।
তবু, অবিরাম দীপ্তিমান
কিশোরের যাত্রার যত জ্বালা –
যাত্রা ।।
মানুষ, সেইত সেই অচেনা কিশোরের একমাত্র পরিচয়;
অচেনা পথে আশাহত কিশোরের তবু অবিরাম হৃদয়ের ক্ষয়।
তবু, অবিরাম দীপ্তিমান
কিশোরের যাত্রার যত জ্বালা –
যাত্রা ।।
এর কিছুদিন পর আমাদের যাত্রাদল কুমিল্লায় একটি যাত্রাপালা করার ডাক পেল। আমরা তিন – চার দিনের জন্য কুমিল্লা এলাম যাত্রাপালা করতে। আমি তখনও যাত্রায় অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমাকে দাদা শুধু কাজ দিলেন পোশাক মাস্টার হিসেবে সকলের পোশাক পরিধানের তদারকি করার জন্য। আমিও আপন মনে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আমার কাজ শেষ করলাম। যাত্রাপালা শুরু হল সন্ধ্যায়। দুটি নাটক শেষ হতেই শুরু হল নাচের পর্ব। আমি শুধু সেই রাতে চোখ বন্ধ করে কাঁদছিলাম নাচের নামে অশ্লীলতা দেখে। শুধু মনে হতে লাগল আমার পায়ের নীচ থেকে যেন কেউ মাটি কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মাটির অতল গহীনে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার সামনে পুরো অর্ধনগ্ন হয়ে গেল শ্রাবণী তার মাতাল করে দেয়া নাচ নাচতে নাচতে। আর দর্শকদের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে কুরুচিকর অশ্লীল ইঙ্গিতসূচক সব হাস্য ধ্বনি। আমি সেই রাতেই সেখান থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে এলাম।
বাড়িতে ফিরে এসে দেখি পুরো বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। আমার বাবা – মা দুজনেই বিছানায় শয্যায় পরে আছেন অসুস্থ নির্বাক হয়ে। আমাকে কাছে পেয়ে যেন বকাঝকা করা ভুলে গিয়ে স্বর্গ হাতে ফিরে পেলেন। দুজনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলেন। আমি আমার কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। তাদের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে বললাম, “আমি সুবোধ ছেলের মত এখন থেকে পড়াশোনা করে তাদের মুখ সমাজের মানুষের কাছে উজ্জ্বল করব, আমি তাদের মনের মতন একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়ে দেখাব” তারাও আমার সব ভুল ক্ষমা করে দিলেন। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর মাত্র একমাসের মতন বাকি ছিল। বাবার স্কুলে যেয়ে বন্ড দিতে হলনা। হেডমাস্টার সাহেবের মতিভ্রম হবার কারনে যারাই আমার মতন টেস্ট পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি সবাইকে তিনি পরীক্ষা দেবার সুযোগ করে দিলেন গ্রেস দিয়ে পাস করিয়ে। আমিও এই একমাসের জন্য সব কিছু ভুলে গিয়ে শুধু পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলাম। আর ভাবলাম যদি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারি তবেই রেশমির কাছে যেয়ে আমার প্রেমের অধিকার আদায় করব। এর আগে আমি এখন রেশমিকে নিয়েও ভাব্বনা । আমার ভাবনায় এখন শুধুই আমার বাবা – মা ও তাদের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি। যাই হোক আমি এই একমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঠিকই সাতটি লেটার নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্টারমার্ক নিয়ে পাস করলাম হয়ত আর কিছু নাম্বার বেশী পেলে স্ট্যান্ড করতে পারতাম নাকি ! এটা অবশ্য আমার স্কুলের হেডমাস্টারের কথা। তিনি আমার এহেন রেজাল্ট দেখে এতই হতবাক হলেন যে শেষে নিজেই মিষ্টি কিনে এনে আমাকে মিষ্টিমুখ করালেন। আমি সেইদিন শুধু আমার বাবা – মায়ের চোখে যে পরিতৃপ্তি দেখতে পেয়েছিলাম মনে হয়েছিলো পৃথিবীর আসল ভালোবাসার মহিমা এখানেই গাঁথা রয়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি আসক্তি প্রেমের টান হয়ত সৃষ্টির আদি থেকেই বিধায় আমি আবারো সেই আদিম পথে পা বাড়ালাম।
যে নিয়তি হৃদয়ের আঁধারে
------------------------------------------------------------
তার চোখে সেই মায়া আছে,
যত ব্যথা আমার স্মৃতির পাতালে।
তার ঠোঁটে সেই হাসি আছে,
যত ব্যথা আমার হাসির আড়ালে।
পথের ধূলিতে মিশে যায়
আমাদের সকল পায়ের চিহ্ন;
তবু বেঁচে আছি এক স্বপ্নিল আঁধারে।
এই রাতের আকাশে সেই জোছনা আছে,
যত বাসর পৃথিবীর নিয়তির ভূমিতে।
এই জীবনের নিশ্বাসে সেই অনুশোচনা আছে,
যত বিষাদ জীবনের নিশ্বাসের ভীতিতে।
কবরের মাটিতে মিশে যায়
আমাদের সকল দেহের চিহ্ন;
তবু বেঁচে আছি এক নিখিল আঁধারে।
কিন্তু বুঝলাম এই অথর্ব যেদিকেই যায় কান্নাও তার সকল অশ্রু শুকিয়ে ফেলে। আমাকে রেশমির এক বান্ধবী জানাল যে রেশমি নাকি তার মনের মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছে। খুব সুখেই তার দিনরাত যাপিত হচ্ছে সেই যুবকের সাথে। আর আমি এই বেচারা কান্ডারী শেষ পর্যন্ত কিনা অথর্বই থেকে গেলাম। তারপর আমার কলেজ জীবনের দুটি বছর বলতে গেলে কেটেছে নেশার নড়কের ঘরে বন্দী অবস্থায় কিন্তু বাবা – মায়ের অগাধ ভালোবাসার টানে পড়াশোনায় ঠিকই মন দিয়েছিলাম কিন্তু ইন্টার পরীক্ষা চলাকালীন সময় তিনটি পরীক্ষার পর শরীরে বাসা বাঁধল টাইফয়েড এর মরন নাশক ব্যাধি। আমি প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেলাম। সবাই আমাকে বাকি পরীক্ষাগুলো চালিয়ে যেতে বারণ করেছিলো কিন্তু মনের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারনে আমি পরীক্ষা দেয়া চালিয়ে গেলাম কিন্তু রেজাল্ট তেমন ভাল করতে না পারলেও সেকেন্ড ডিভিশনে কোন রকম পাস করতে পেরেছিলাম। যেন একটি যুদ্ধ জয় করলাম মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে। কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়ের একমাত্র প্রান রেশমি।
(চলবে...............)
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান - ১ম পর্ব
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান - ২য় পর্ব
কান্ডারী অথর্ব ও রেশমির প্রেমের উপাখ্যান - ৩ য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




