somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কান্ডারি অথর্ব
আমি আঁধারে তামাশায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূণ্যতা থেকে শূণ্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙ্গলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।

ছিটমহলঃ ছিটের মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভরা জীবন কাহিনী

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




অবস্থানগত পরিচয়ে তারা বাংলাদেশের মানুষ। থাকতে হয় ভারতের ভেতর। ওরা ভারতের মানুষ। বসবাস বাংলাদেশের ভেতর। কিন্তু বাস্তবে এরা দেশহীন, নাগরিকত্বহীন। এদের পরিচয় ‘ছিটের মানুষ’। আবদ্ধ জীবনযাপনের কষ্ট, যাতায়াত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার কষ্ট, নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতার কষ্ট—সব মিলে দীর্ঘশ্বাসে ভরা জীবন তাদের। কাঁটাতারের কোনো বেড়া নেই। খুঁটি কিংবা সীমানা পিলার খুঁজতে চাইলেও লাভ নেই। দেখা মিলবে না কোনোটারই। তার পরও মানুষগুলো চারদিক থেকে বন্দী। চাইলেই যখন-তখন যেভাবে খুশি বের হওয়ার উপায় নেই। রাস্তা বলতে কোথাও জমির আল ধরে চলা। আবার জলাভূমি থাকলে তার ওপর তৈরি হয়েছে বাঁশের সাঁকো। ভূমি থাকলেও দেশের ওপর অধিকার নেই। বাংলাদেশ ও ভারতে এ ধরনের ১৬২টি ভূখণ্ড রয়েছে, যার মধ্যে ভারতের ১১১টি ভূখণ্ড বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ভূখণ্ড রয়েছে ভারতে। ছুটে যাওয়া বলেই হয়তো এসব ভূখণ্ড পরিচিত ছিটমহল নামে। আর ‘ছিটের মানুষ’ নামে পরিচিত ছিটমহলের অধিবাসী।



পেছনের ইতিহাস

সাতচল্লিশের দেশভাগের পরেই শুরু ছিটমহল আখ্যানের। মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও তাদের কোনো দেশ নেই, পরিচয় নেই। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় ছিটের লোকজনের ভাষা ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কোনো অমিল নেই। ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশের ‘ছিটের মানুষে’র ছবিটা একই। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো যোগাযোগ নেই, সম্পর্কও নেই। এসব লোকজন পূজা এলে উৎসবে মাতে। কিন্তু বাইরে গেলেই লোকজন তাদের ডাকে ছিটের লোক। এই পরিচয় শুনে স্বভাবতই নিজেদের গুটিয়ে নেয় এসব মানুষ। বাংলাদেশ যেমন এদের নাগরিকত্ব দেয়নি, দেয়নি ভারতও। পড়াশুনা, জীবিকা—সবকিছুর জন্যই ছিটমহলের লোকজনকে নির্ভর করতে হয় ‘অন্য দেশের’ ওপর। তার পরও তাদের অবস্থা ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’। ব্রিটিশ শাসকদের খেয়ালখুশির বলি দেশহীন ও পরিচয়হীন এসব মানুষ। দেশভাগের দুই যুগ পরে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশক পরও দুঃখ ঘোচেনি দেশহীন এসব মানুষের।

কুচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কুচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হচ্ছে ছিটমহল।



সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টবেটন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র।

কোনো রকম সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথাযথভাবে হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। আর উত্তারিকার সূত্রেই উপমহাদেশের বিভক্তির পর এই সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছে দুই দেশ।

১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন চক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি।

এরপর সাতচল্লিশের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদা আলাদাভাবে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা দেয় গরমিল। পরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৮ সালে সই হওয়া নেহেরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়।



মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি

১৯৭৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে স্থল-সীমানা নির্ধারণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তিটি দুই দেশের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, আন্তরিক মনোভাব ও পারস্পরিক বিশ্বাস, আর সবার ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী—এ দুজন মহান রাষ্ট্রনায়কের শান্তি ও সম্প্রীতির অন্তর্দৃষ্টির প্রতীক। এই দুটি জাতির ওপর ঐতিহাসিকভাবে বর্তানো কিছু প্রলম্বিত এবং জ্বালাতনকারী (vexing) সমস্যার মীমাংসা করাই ছিল এই সমন্বিত চুক্তির অভিপ্রায়। সংশ্লিষ্ট সবাই এটা কবুল করেছেন যে, দুই দেশের মধ্যকার সুদীর্ঘ সীমান্তে জারি থাকা ছোট-বড় নানা অস্থিরতার কারণ নির্মূল করার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য কর্তব্য হলো শুধু কাগজে-কলমে নয়, মনেপ্রাণে এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। চুক্তির নানা ধাপ বাস্তবায়নের জন্য যে কিছু সময় দরকার, সেটা দুই নেতা জানতেন এবং সেই অনুযায়ী বাস্তবানুগ সময়সীমাও তাঁরা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সরকারপক্ষ এবং যাঁরা বিষয়টির কর্তৃত্বে ছিলেন, তাঁরা এ বিষয়ে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হন। তাঁরা তাঁদের ওপর ন্যস্ত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তাঁরা সত্যের অপলাপ এবং কালক্ষেপণ করেছেন, আর যেটা করা আবশ্যক ছিল, সেটা করেননি। ফলে সীমান্তের বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেওয়া হয় এবং কালক্রমে সমস্যাটি আরও জটিল হয়ে উঠতে থাকে।

একটু যদি পেছন ফিরে তাকাই তাহলে এ বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার বেশির ভাগই অতি পুরোনো, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া ভারতের স্বাধীনতা ও বিভক্তির সময় এসব সমস্যা শুরু হয়েছে। ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের (অর্থাৎ ৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ) জরিপ-আমিনরা প্রথম দিন থেকেই আন্তর্জাতিক সীমানা চিহ্নিত ও অঙ্কিত করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁদের চেষ্টা ছিল যথাসাধ্য স্যার সিরিল র্যা ডক্লিফের আঁকা রেখা এবং লিখিত বিবরণ মেনে চলা, কিন্তু শিগগির তাঁরা এমন ভিন্নতার মুখোমুখি হলেন, যাকে মেলানো একেবারে অসম্ভব। এই সূত্র ধরেই এলো ব্যাগি রোয়েদাদ (২৬ জানুয়ারি ১৯৫০), আর তার সঙ্গে এল রাশি রাশি রাজনৈতিক আর আইনি ব্যাপার—যার পরিণাম আগে থাকতে আঁচ করা হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আর পাকিস্তানের ফিরোজ খান নুন প্রথম সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করলেন ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। পূর্বাঞ্চলে ১৯৫৮ সালের চুক্তির মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়গুলোর সঙ্গে প্রধানত তিনটি লক্ষ্য অর্জনের কথা ভাবা হয়েছিল। প্রথমত, সীমান্তের বিভিন্ন সেক্টরে সীমানা নির্ধারণে যেসব অসংগতি বিঘ্ন সৃষ্টি করছে, সেগুলোর নিষ্পত্তি করা। সেই সঙ্গে দক্ষিণ বেরুবাড়ির ১২ নম্বর ইউনিয়নের সমস্যার সমাধান। এই ইউনিয়নটি স্যার র্যা ডক্লিফের অঙ্কিত রেখা অনুসারে ভারতের ভাগে পড়ে, আর তাঁর লিখিত বিবরণ অনুসারে পড়ে পাকিস্তানের ভাগে। কোথাও এ রকম অসংগতি দেখা দিলে সীমান্তের লিখিত বিবরণকেই মান্য ধরা হবে এ রকম কথা ছিল। কিন্তু এই ইউনিয়নের অধিবাসীদের সিংহভাগ অমুসলিম হওয়ায় তারা পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিরোধিতা করে। এভাবেই পেরিয়ে যায় এক দশকেরও বেশি সময়; কিন্তু এই ইস্যুটির নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়ন ভারতের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গেই যুক্ত থেকে যায়। ভারতের সরকার পাকিস্তানের কাছে এর মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেনি। আর পাকিস্তানের সরকারও এটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৫৮ সালের চুক্তিতে স্থির হয়, ইউনিয়নটিকে মোটামুটি সমানভাবে দুই ভাগ করে ফেলতে হবে। দক্ষিণের অর্ধেক আরও দুটি ছিটমহলের সঙ্গে—পাবে পাকিস্তান, আর উত্তরের অর্ধেক ভারতের অন্তর্ভুক্ত থেকে যাবে। দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল, তথাকথিত ছিটমহল সমস্যার মীমাংসা করা। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ছিটমহল ছিল ১১৩টি, আর ভারতের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিটমহল ছিল ৫৩টি। এই চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, ছিটমহলগুলো যে দেশের মধ্যে পড়েছে, সেই দেশেরই অঙ্গীভূত হবে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ভারতীয় ছিটমহল আছে, সেগুলো পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে যাবে, আর ভারতে যেসব পূর্ব পাকিস্তানের ছিটমহল আছে, সেগুলো পাবে ভারত। ফলে যে বাড়তি জায়গা পেয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান, সে জন্য ভারত কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। তৃতীয়ত, সীমান্তের সীমানা নির্ধারণের পর সেই অনুযায়ী ভূখণ্ড বিনিময় করা হবে। সীমান্ত চিহ্নিত করার ফলে যেসব ভূখণ্ড অন্যায্যভাবে কোনো দেশের অধিকারে আছে (যেটার অর্থ হলো, অপদখলীয় এলাকা) বলে জানা যাবে, সেগুলো ন্যায্যত যে দেশের অধিকারে থাকা উচিত, সেই দেশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
তা সত্ত্বেও ১৯৫৮ সালে স্বাক্ষরিত নেহরু-নুন চুক্তির সেসব দিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না, যে দিকগুলোতে ছিটমহলগুলোর পারস্পরিক বিনিময় এবং দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশ ভারত কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরের মতো বিষয়গুলো ছিল। এর কারণ ছিল ভারতীয় নাগরিকদের রুজু করা মামলা। এই মামলায় দক্ষিণ বেরুবাড়ির গোটা ইউনিয়নটি দাবি করা হয়, কারণ এটা ভারতীয় সংবিধান বলবৎ হওয়ার সময়কাল থেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ, এবং কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যেসব ছিটমহল আছে, সেগুলোও ভারতের অংশ। সে কারণেই ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাগ এবং ছিটমহলগুলোর কোনোটিই কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। যথাসময় মামলাটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। কোর্ট রায় দেন রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া থেকে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়নের দক্ষিণ অর্ধেক বাদ দিতে হলে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলগুলো চুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে বিনিময় করতে গেলে ভারতের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সেই অনুযায়ী ১৯৬০ সালে ভারতের সংবিধান সংশোধন করা হয় (নবম সংশোধনী)। তা সত্ত্বেও আবশ্যকীয় বিনিময় কার্যকর হয়নি। কেন হয়নি, সেটা আবার অন্য কাহিনি; সম্ভবত বিধির বিধান। তাই অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্তের কারণে অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে সঙ্গে এই তিনটি অমীমাংসিত সমস্যা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। দুই, প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এসব সমস্যাগুলোকে সর্বোচ্চ দ্রুততার সঙ্গে সমাধানে মনোযোগী হন, কারণ তাঁরা জানতেন যে একটি পরিচ্ছন্নভাবে চিত্রিত সীমান্ত এবং এটির অলঙ্ঘনেয়তার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দুই দেশের মধ্যকার স্থায়ী এবং শক্তিশালী বন্ধুত্বের জন্য অপরিহার্য। এটি নিয়ে তাই কর্ম পর্যায়ে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পর্যায়ে এবং চূড়ান্তভাবে একেবারে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে, ব্যাপকভাবে গতানুগতিক বিষয়গুলোর ওপর দেন-দরবার চলতে থাকে। অবশেষে ১৬ মে ১৯৭৪ নয়াদিল্লিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার স্থল-সীমানা নির্ধারণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে চুক্তিস্বাক্ষর করেন। এই স্থল-সীমানা চুক্তি ১৯৭৪ দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে সীমান্তের মূলত ১৩টি সেক্টরে থাকা অনির্ধারিত এলাকাগুলোতে সীমানা চিহ্নিত করার জন্য এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো, যেমন ছিটমহল বিনিময় এবং অপদখলীয় এলাকা বিনিময়, যথাযথ দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের জন্য, দুই দেশের জরিপ কর্তৃপক্ষকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশনা দেয়। সেই সঙ্গে আদালতে নিষ্পত্তিযোগ্য এবং রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল দক্ষিণ বেরুবাড়ি ১২ নম্বর ইউনিয়ন ইস্যুটির প্রায়োগিক এবং সুবিবেচনাপ্রসূত সমাধান দেয়। এই ইউনিয়নটি ১৯৫৮ সালে স্বাক্ষরিত নেহরু-নুন চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল র্যা ডক্লিফ অঙ্কিত সীমান্তরেখা অনুসরণ করে ভারতেরই অন্তর্ভুক্ত থেকে গেছে।

যে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির কথা এতক্ষণ ধরে বলা হলো সে কারণে, এবং ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল-সীমানা চুক্তির বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি না ঘটার ফলে ইতিমধ্যেই দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে অনেক দূর পর্যন্ত মাশুল দিতে হয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন চোখে পড়েছে। তাই দুই সরকারকেই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

১৯৭৪ সালের স্থল-সীমান্ত চুক্তির ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আরও বেশি বিলম্ব এবং অকারণ উত্তেজনা পরিহার করে, চুক্তি অনুযায়ী বিনিময়ের কাজটি সম্পন্ন করতে দুই বন্ধুপ্রতিম সরকারের জন্য এখনো খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। দুই পক্ষই তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে এটা স্পষ্টভাবে প্রতিপাদন করেছে যে তারা কার্যত এই চুক্তিটিকে অনুমোদন করে এবং এই চুক্তির আওতাধীন সুবিধাগুলো তারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই ভোগ করেছে। শুধু চুক্তির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়নি বা এজন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালন করা হয়নি। এখন দুই দেশের জন্য জরুরি কর্তব্য হলো অনতিবিলম্বে তাদের নিজ নিজ প্রতিনিধিদের ১৯৭৪ সালের স্থল-সীমানা চুক্তির অনুসমর্থনের দলিলে স্বাক্ষর করার ক্ষমতা প্রদান করা এবং একটি নির্ধারিত দিনে এই দলিল বিনিময় করা—যা ভূতাপেক্ষভাবে এই চুক্তিকে বলবৎ করবে এবং এই চুক্তির আওতায় নির্ধারিত সীমানাকে আইনি মোড়ক প্রদান করবে। একইভাবে তিন বিঘার কাছে বাংলাদেশকে দেওয়া করিডোরের চিরস্থায়ী ইজারা দেওয়ার বিষয়টিকেও দেবে আইনি মোড়ক।

ছিটমহল

১৯৪৭ সালে রেডক্লিফের মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব ছিটমহলের। এক দেশের ভূখণ্ডে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। উদ্ভব হয় এক মানবিক সমস্যার।

১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তিতে বলা আছে, ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন যেখানে থাকতে চাইবে, সেখানেই তাদের থাকতে দেওয়া হবে।

১৬২ টি ছিটমহল আছে দুই প্রতিবেশী দেশে। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে।

৫১০০০ জনসংখ্যা রয়েছে এসব ছিটমহলে। সাম্প্রতিক জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার। বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ১৪ হাজার।

২৪২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দুই দেশের ছিটমহল। তার মধ্যে ভারতের ১৭ হাজার ১৫৮ একর। বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১১০ একর।

বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর। ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন সাত হাজার ১১০ একর।
ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বেশির ভাগই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এসব ছিটমহলের ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারিতে চারটি।

ছিটমহল মানে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের ভেতের ভারতীয় ভূখণ্ড। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল।
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। ৪৭টি কুচবিহার এবং চারটি জলপাইগুড়ি জেলায়।

ভারতের ভেতরে বাংলাদেশ

ব্রিটিশ আমলে সৃষ্টি ভারত ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ছিটমহলের বিনিময়ের দাবি উঠেছে। ছিটমহলবাসী চান, তাঁরা যে দেশের ভূখণ্ডে বসবাস করছেন সেই দেশের নাগরিকত্ব। অন্য দেশে ‘পরগাছা’ হিসেবে থাকতে চান না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলেছেন। এ জন্য পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছে।



কী এক দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন ভারতের ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী। একটি স্বাধীন দেশের ভেতরে ছোট ছোট দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি দেশের ভূখণ্ড, অভূতপূর্ব দৃশ্যই বটে। বিচ্ছিন্ন এসব ভূখণ্ডই হচ্ছে ছিটমহল।পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার থেকে দিনহাটা মহকুমার নাজিরহাটের মশালডাঙ্গায়; এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি ছিটমহল। অন্তত ২১টি ছোট ছোট ছিটমহলের অবস্থান। এই ছিটমহলকে বলা হয় গুচ্ছ ছিটমহল। লোকসংখ্যা এখন ৩ হাজার ৮০০। মশালডাঙ্গা থেকে কাছেই বাংলাদেশ সীমান্ত, দীঘরটারি। ওপারে কুড়িগ্রাম।

তাঁরা আর পরগাছা হয়ে দুঃসহ জীবনযাপনের ইতি টানতে চান। নাগরিকত্ব চান। অধিকার চান সুস্থভাবে বাঁচার। তাঁরা ভারতীয় ভূখণ্ডেই থাকতে চান। সেই ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক দুই দেশ।

কী তাঁদের পরিচয়? তারা জানেনা তারা বাংলাদেশের নাগরিক। অথচ কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার তাঁদের খোঁজও নেয় না। কোনো সাহায্য পায় না তারা। তারা তো ভারতের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পড়ে আছে। বেঁচে আছে ভারতের করুণা, দয়া আর সাহায্য নিয়ে। অথচ ভারত সরকারও তাঁদের মেনে নেয়নি তাদের দেশের নাগরিক হিসাবে। দেয়নি রেশন কার্ডও। দৈহিক শ্রম আর চাষাবাদ করে বেঁচে আছে তারা বংশ পরম্পরায়। নেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করার জন্য কোনো স্কুল-কলেজ। নেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল। চারদিকে ভারতীয় ভূখণ্ড বাংলাদেশের নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণপত্র নেই। নেই পাসপোর্ট। কীভাবে পার হবে সীমান্ত? সীমান্ত এখান থেকে দূরে। ইচ্ছে করলেই তো আর সীমান্ত পার হওয়া যায় না। জীবনযন্ত্রণার একই ছবি পূর্ব মশালডাঙ্গায়ও। ভারতের ভেতরে বাস করায় এখানকার মানুষজন এখন সত্যিই তাঁদের যেমন সাহায্য করে, তেমনই আবার অবজ্ঞাও করতে দ্বিধা করে না। তবু এই অবজ্ঞা আর ওদের ভালোবাসার আঁচলের মধ্যে থেকে তারা বেঁচে আছে। অনেক ছোট ছোট ছিটমহল রয়েছে এখানে। উত্তর মশালডাঙ্গায় একটি ছিট মহল আছে মাত্র ৮২ বিঘা জমি নিয়ে। কামাথ শেওভাগুড়িতে রয়েছে ২৬ বিঘা এবং মধ্যসিট মশালডাঙ্গায় রয়েছে আরও একটি ৩৬ বিঘা জমির ছিটমহল।এসব ছোট ছোট ছিটমহলবাসী কীভাবে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বাঁচবে?’
মা-বোনদের সন্তান ভূমিষ্ঠ করানোর জন্যও তারা মিথ্যে ভারতীয় ঠিকানা ও নাম দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায় তাঁদের গর্ভবতী মা-বোনদের। আদালতেও তাঁদের ঠাঁই নেই। তারা এখনো বেঁচে আছে এখানকার মানুষজন এবং পঞ্চায়েতের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে।চাষাবাদ আর শ্রম নির্ভর কাজ করে এখানকার মানুষের জীবন চলে। উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য তাঁরা বিক্রি করেন ভারতীয় বাজারে। এখান থেকেই আবার কেনেন ভারতীয় পণ্য।



ছিটমহলের লোকজনের অভিযোগ দুঃসহ এই যন্ত্রণা নিয়ে এখনো বংশপরম্পরায় তাঁরা বেঁচে আছেন বাংলাদেশের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। তাঁরা সর্বহারা চিরসাথী সংঘ নামের ক্লাবের মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়ের আন্দোলনে নেমেছেন।

ভারতীয় ভূখণ্ডে রয়েছে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল। এই ছিটমহলের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হলেও কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কোচবিহার ছিল রাজাশাসিত পৃথক রাজ্য। ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহারের রাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারকে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভারত স্বাধীন হলেও ছিটমহলের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে থাকে। বারবার এই ছিটমহলবাসীর নানা সমস্যার কথা তোলা হলেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে কোনো যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়নি। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তি করলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ছিটমহলবাসীর মুক্তির একমাত্র পথ ছিটমহল বিনিময়—এই স্লোগান তুলে ছিটমহল বিনিময়ের প্রথম দাবি তোলেন দিনহাটার সাবেক বিধায়ক প্রয়াত দীপক সেনগুপ্ত। তিনিই ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি। ২০০০ সাল থেকে এই দাবির সমর্থনে গড়ে তোলেন তীব্র আন্দোলন। দীপক সেনগুপ্ত ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ফরোয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক ছিলেন কোচবিহারের সিতাই কেন্দ্রের। এরপর এই আন্দোলনের হাল ধরেন অন্য নেতাদের সঙ্গে দীপক সেনগুপ্তের ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তিনি এখন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। যদিও এই ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা কমল গুহও। তিনিও ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার দিনহাটা কেন্দ্রের ফরোয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক। তাঁর ছেলে উদয়ন গুহ এবার বিধানসভার বিধায়ক হয়েছেন ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী হিসেবে। ছিটমহল সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ ছিটমহল বিনিময়। এটা না হলে ছিটমহলবাসীর বাঁচার কোনো পথ খোলা থাকবে না। কারণ, ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া জীবন অতিবাহিত করতে পারবে না।

বাংলাদেশের ভেতরে ভারত


‘কম হলেও ছিটের জমির কিছু দাম আছে। কিন্তু ছিটের মানুষের কোনো দামই নেই।’



বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ছোট গারালজোড়ার অবকাঠামোর চিত্র সর্বত্রই একই—হাঁটাচলার রাস্তা নেই। শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সময়েও কপালে জোটে না সরকারি সহযোগিতা। উল্টো পদে পদে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

সীমান্তের বেশির ভাগ জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করে রেখেছে ভারত। সেখানে অস্ত্র হাতে টহল দেয় বিএসএফ। কিন্তু বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহলগুলোতে কোনো সীমানাপ্রাচীর বা পাহারা নেই। আশপাশের বাংলাদেশি ও ছিটমহলবাসী ভারতীয় নাগরিকদের ভাষা, গায়ের রং ও ধর্মীয় বিশ্বাস প্রায় অভিন্ন। এসব ছিটমহল থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের দিনহাটা থানা ও ৪৫-৫০ কিলোমিটার দূরে কোচবিহার জেলা সদর।
এক ছিটের পেটে আরেক ছিট: বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ। যেমন কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ার ছড়া। দাশিয়ার ছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল।
কুড়িগ্রাম জেলায় ভারতের ১৮টি ছিটমহল আছে। বড় গারালজোড়ার ছিটমহলে বসবাস করে ১০টি পরিবার। এর আয়তন ৩৫ দশমিক ২৪ একর। এ ছাড়া ছোট গারালজোড়া ১৭ দশমিক ৭৮ একর ও কালামাটির আয়তন ২১ একর।এই উপজেলায় ভারতের ১০টি ছিটমহল আছে। লোকগণনা অনুযায়ী, এই ১০টিতে ২৬২টি পরিবারে এক হাজার ১৬৯ জন বাস করে।
ছিটমহলের মানুষ কৃষিনির্ভর। অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর। উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশের হাটবাজারেই তাঁরা বেচাকেনা করেন।

ওপারে মজুরি বেশি। কিন্তু তাঁদের প্রায়ই ফিরিয়ে দেয় বিএসএফ। নিজের দেশে ঢুকতে তাঁদেরকে নির্ভর করতে হয় বিএসএফের করুণার ওপর।
কালামাটি ছিটমহলে চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। জমির আইল ধরে যাতায়াত করেন মানুষ। একই চিত্র বড় ও ছোট গারালজোড়া ছিটমহলেও।
নেই চিকিৎসার ন্যূনতম সুবিধা। বেশির ভাগ মায়ের সন্তান প্রসব হয় গ্রাম্য দাইদের হাতে। অবস্থা জটিল হলে পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশের হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হন।

শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ছিটমহলের বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের সঙ্গেও বিয়েশাদির সম্পর্ক গড়ছেন। হাতেগোনা দু-চারজন খুঁজে পাওয়া যায়, যাঁরা একসময় ভারতের কোনো এলাকায় বিয়েশাদি করেছেন।

স্বাধীনভাবে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচাসহ অনেক মৌলিক অধিকার নেই ছিটমহলে। এই অবস্থার অবসান চান তাঁরা। আত্মীয়তা, যোগাযোগব্যবস্থা ও ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি কারণে বড় একটা অংশ বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকতে চান।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল


দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সব বাসিন্দার একটাই চিন্তা—যে করেই হোক, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার আগে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। তা না হলে যে ‘গেট ফেইল’। গেট ফেইলের বৃত্তে বন্দী এখানকার ১৫ হাজার মানুষের জীবন।

দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতার ডানে-বাঁয়ে ভারত। সামনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড। তবে তা কয়েক কদম হাঁটা পথের এক টুকরো ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে বিচ্ছিন্ন। এই পথটুকু কেড়ে নিয়েছে ছিটমহলের মানুষের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা। আর এই হাঁটা পথটাই হচ্ছে তিনবিঘা করিডর। বাংলাদেশ থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যেতে ভারতের তিনবিঘা করিডর পেরোতে হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তিনবিঘা করিডরের গেট খুলে দেয় সকাল সাড়ে ছয়টায়। গেট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। মাঝখানের এই ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের বাইরের কাজ সারতে হয়।



দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে ঢুকতেই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবির) নিরাপত্তা চৌকি। এরপর তিনবিঘা করিডর। এরপর আবার বিজিবির চৌকি। মাঝখানের তিনবিঘা করিডর ভেদ করে চলে গেছে ভারতীয় সড়ক। সড়ক ও করিডরের নিয়ন্ত্রণ করে বিএসএফ। এই সড়কেই বিএসএফের গেট।

ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের যে ৫১টি ছিটমহল আছে, এর মধ্যে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাই বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা। বাকি সবই বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে এক থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ১৯৯২ সালের ২৬ জুন ভারত তিনবিঘা করিডর খুলে দিলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার বাসিন্দারা বাংলাদেশে যাতায়াতের সুযোগ পায়। এর আগে লোকজন ভারতে গেলেও বাংলাদেশে আসত বিএসএফের নজর এড়িয়ে। প্রথম দিকে তিনবিঘা করিডরের গেট দিনে এক ঘণ্টা পর পর বিরতি দিয়ে ছয় ঘণ্টা খোলা থাকত। এখন থাকে একটানা ১২ ঘণ্টা।

২৪ ঘণ্টা গেট খোলা রাখার দাবি: দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা দুটি ছিটমহল নিয়ে একটি ইউনিয়ন। প্রায় ১৫ হাজার জনগোষ্ঠীর এই ইউনিয়নে স্কুল থাকলেও কোনো কলেজ নেই। ছোট্ট একটা বাজার আছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের দেখা মেলে না। তাই চিকিৎসার জন্য এখানকার লোকজনকে ছুটতে হয় পাটগ্রাম উপজেলা সদর ও লালমনিরহাটে।

বাসিন্দাদের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিকাজ ও গবাদিপশু পালন। পাটগ্রামে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে। ছিটমহলের বাসিন্দারা গবাদিপশু বিক্রি করে ওই হাটে। বিএসএফ হাটবারে ১০টির বেশি গবাদিপশু নিতে দেয় না। তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ঠিক করেন, কার কার গবাদিপশু বেচার অনুমতি দেওয়া হবে।

তাঁরা তাঁদের সন্তানদের ভুয়া ভারতীয় ঠিকানা ব্যবহার করে ভারতের স্কুলে ভর্তি করান। তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র নেই। তাই বাঁচার জন্য ভুয়া ভারতীয় প্রমাণপত্র তৈরি করতে হয়। এভাবেই চলছে এঁদের পরগাছার মতো জীবন।
কিন্তু অন্য দেশে ‘পরগাছা’ হিসেবে থাকতে চান না ভারতের ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা। তাঁরা দাবি তুলেছেন ছিটমহল বিনিময়ের, যার মাধ্যমে তাঁরা হয়ে যাবেন ভারতের নাগরিক।

নীলফামারী জেলার ছিটমহল


নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নে ভারতীয় ছিটমহল জিগাবাড়ী।নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে ডিমলা উপজেলায় অবস্থিত চারটি ভারতীয় ছিটমহলের। ছিটমহলের বেশির ভাগ মানুষ গরিব। প্রায় সবাই কৃষিশ্রমিক। ডিমলার সবগুলো ছিটমহলের প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় সবাই বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় নাম তুলেছেন। এখানে মাত্র আটটি পরিবারের বাস। চলাচলের জন্য কোনো রাস্তা নেই। তাঁরা জমির আল বেয়ে হাঁটেন। ভোটার তালিকা করার সময় তাঁরা খাসজমিতে এসে ভোটার হয়েছেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বাংলাদেশ সরকারের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে ছিটমহলবাসী।



ছিটমহলের কোনো মামলা নেওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ বাংলাদেশ পুলিশের নেই। তাই সেখানে কোনো সমস্যা হলে স্থানীয়ভাবে সমাধান করা হয়।

নীলফামারীর একমাত্র ডিমলা উপজেলায় ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। এই চারটি ছিটমহলে মোট জমির পরিমাণ ৯৩ একর। সর্বশেষ জনগণনা অনুসারে চারটি ছিটমহলে মোট ১১৯টি পরিবার বাস করে। জনসংখ্যা ৪৯৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৫৮ ও মহিলা ২৪৮ জন।

লালমনিরহাটের ছিটমহল


লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে আট-নয় কিলোমিটার দক্ষিণে জোংড়া ইউনিয়ন। ভেতরে পুরোটাই পাকা রাস্তা। এ ইউনিয়নের মধ্যেই রয়েছে ভারতের ভূখণ্ড, ছিটমহল।



ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতের নাগরিক। তারা ‘নিজ দেশে পরবাসী’র মতো বঞ্চনার জীবন কাটাচ্ছে। নিজ দেশে ঢুকতে গিয়ে তাদের অনেককে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে কারাভোগও করতে হয়েছে।

তাঁরা ‘ভারতীয় নাগরিক’ ও ‘ছিটের’ বাসিন্দা, এই পরিচয় ঘোচাতে চান। বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হতে চান।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় ৫৫টি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। ভারত সরকার কোনো দিন তাঁদের খোঁজ নেয়নি। বাংলাদেশই তাঁদের শেষ ঠিকানা। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা বাংলাদেশি হতে চান।

ছিটমহলের জমি কেনাবেচার দলিল বাংলাদেশে হয় না। পাটগ্রামের ছিটমহলগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার মেকলীগঞ্জ ও মাথাভাঙ্গা মহকুমার অধীন।

আশির দশকে কিছু লোক ভারতে গিয়ে জমির দলিল নিবন্ধন করাত। গত এক যুগের মধ্যে আর কোনো দলিল নিবন্ধন হয়নি। এখন জমি বেচাকেনা হয় স্ট্যাম্পে টিপসই করে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে স্ট্যাম্প এনে জমি কেনাবেচা হতো। এখন ভারত থেকে স্ট্যাম্পও আনা যায় না। বাংলাদেশি স্ট্যাম্পেই কেনাবেচা হচ্ছে।বাংলাদেশি ভূখণ্ডে যে জমির দাম বিঘাপ্রতি দেড় লাখ টাকা, পাশেই ছিটমহলের জমি বিঘাপ্রতি দাম হয় এক লাখ টাকা।

পঞ্চগড় জেলার ছিটমহল

পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা, হাফিজাবাদ ও অমরখানা ইউনিয়নের মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গারাতি ছিটমহল। ১৩৫০.৫০ একরের এই ছিটমহলের লোকসংখ্যা এক হাজার ৯২৭। এর মধ্যে পুরুষ ৯৯২ ও নারী ৯৩৫ জন। ৩৭০টি পরিবারের ৪৫টিই ভূমিহীন।এর মধ্যে সদর উপজেলায় গারাতি ও শিঙ্গিমারী, দেবীগঞ্জ উপজেলায় নাটকটোকা, বেহুলাডাঙ্গা, বালাপাড়া খাসবাড়ী, কোটভাজনী, দহলা খাগড়াবাড়ী এবং বোদা উপজেলায় পুঁটিমারী, নাজিরগঞ্জ, দৈখাতা, শালবাড়ী এবং কাজলদীঘি ছিটমহল বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় পড়েছে। এসব ছিটমহলে জমির পরিমাণ ৬১৯০.৭৮ একর, পরিবারের সংখ্যা ৩৯৮৭টি, ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ২৮০টি। জনগণনার তথ্য অনুযায়ী লোকসংখ্যা ১৮ হাজার ৮৯১। এর মধ্যে পুরুষ নয় হাজার ৭৯১ এবং নারী নয় হাজার ১০০ জন।



কৃষিনির্ভর এই ছিটমহলের লোকজন ধান, পাট, আখ, গমসহ সব ধরনের ফসলের আবাদ করে। সড়কগুলো কাঁচা, খানাখন্দকে ভরা। স্কুল, হাটবাজার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। তবে বাংলাদেশের ভেতরে চলাচলে তাদের কোনো বাধা নেই।
ছিটমহলের শিশুদের অধিকাংশই লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আর যারা লেখাপড়া করে, তারা মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে স্কুলে ভর্তি হয়। যাঁরা সামর্থ্যবান, তাঁরা বাংলাদেশি এলাকায় বাড়ি তৈরি করে সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করছেন।

তারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবাধে চলাচল করলেও তাদের পরিচয় ভারতীয়। কিন্তু চাইলেই ভারতে যেতে পারে না তারা। তাদের জন্য নেই কোনো আইন-আদালত কিংবা বিচারব্যবস্থা। মৌলিক সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নিরাপত্তাহীনতা ছিটমহলবাসীর নিত্য সঙ্গী।

সাদা কাগজে টিপসই দিয়ে জমি কেনাবেচা করতে হয়। কারণ, জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে তাদের ভারতের হলদিবাড়িতে যেতে হয়, কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা এখানকার মানুষের নেই।

আধুনিকতা থেকে বহু দূরে; বিদ্যুৎ না থাকায় এই ছিটমহলের লোকজনের বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই। পাকা ঘরবাড়ি নেই বললেই চলে। সবই শণের ঘর। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই।
অসুখে-বিসুখে সেবা দিতে নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রসূতি মায়েদের দুর্ভোগ বেশি।

চিকিৎসার জন্য ভরসা গ্রাম্য করিরাজ।ছিটমহলের ছেলেমেয়েরা আগে বাংলাদেশের স্কুলে লেখাপড়া করত। জন্মনিবন্ধন সনদ চালুর পর এই সুযোগও হারাতে হচ্ছে। তারা যে ফসল উৎপাদন করে, তা বাংলাদেশেই বিক্রি করে। অথচ তাঁদের সার, বীজ, কীটনাশক দেওয়া হয় না। ছিটমহলে জন্মটাই হলো পাপ। দাম নাই, পরিচয় নাই।



সীমান্তের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত এক চুক্তিতে সই করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভূমি হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তির তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন কোথায় থাকতে চান, সে ব্যাপারে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ভূমি বিনিময় হলে বাড়তি ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা।

ভারতের অবস্থান পরিবর্তন

দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যৌথ সীমান্ত কার্যদল (জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ-জেবিডব্লিউজি) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক করে ওই কমিটি। গত বছরের নভেম্বরে দুই পক্ষ দিল্লিতে সর্বশেষ বৈঠক করে ১৯৭৪ সালের চুক্তির আলোকে বিষয়গুলো সুরাহার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রসঙ্গত, এবারকার বৈঠকের আগে প্রতিবারই ভারত আলাদা-আলাদাভাবে সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো সুরাহার ব্যাপারে অটল থাকে। এ ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা, চুয়াত্তরের চুক্তির অনুসমর্থন, ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর—এই ধারাবাহিকতায় বিষয়গুলো সমাধান করা হবে। ২০০৭ সালে ছিটমহল ও অপদখলীয় জমিগুলোতে যৌথ সফরের পর বাংলাদেশও ধাপে ধাপে বিষয়গুলো সুরাহার প্রস্তাব দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তালিকায় ক্রমানুসারে ছিল: ছিটমহল বিনিময় এবং চুয়াত্তরের চুক্তির অন্য বিষয়গুলো। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, ধাপে ধাপে নয়, তারা সমন্বিতভাবে বিষয়গুলো সমাধান করতে চায়। ভারতের এই প্রস্তাব তাদের দীর্ঘদিনের অবস্থান থেকে সরে আসা।

২০০৭ সালে ভারত সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে সুরাহার পক্ষে মত দেওয়ায় আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন ছিটমহলবাসী। ছিটমহল বিনিময়ের অংশ হিসেবে জনগণনা শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা ছিটমহল বিনিময়ের।

ভারত বিভাগের এতকাল পরও দুই দেশের এই ছিটমহলের সমস্যার সমাধান হয়নি। নেহেরু-নুন, ইন্দিরা-মুজিব এবং নরসীমা রাও-খালেদা জিয়া ছিটমহল সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিলেও সেই উদ্যোগ বা চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি।

(তথ্য ও ছবি সংগৃহীত)

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:০৭
৪৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×