somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কান্ডারি অথর্ব
আমি আঁধারে তামাশায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূণ্যতা থেকে শূণ্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙ্গলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।

প্রিয় এবং অপ্রিয় বর্ণনা

১০ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য স্মরণযোগ্য। বাংলাদেশ রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারা সুনির্দিষ্ট হয়েছে তার জন্মলগ্ন থেকেই। এর স্বতন্ত্র প্রকৃতি রয়েছে। রয়েছে এর নিজস্ব সুর-ছন্দ। এর নিজস্ব বাণী। নিজস্ব ব্যঞ্জনা। এ ধারণার বিপরীতে গেলে তা দুর্যোগকবলিত হতে বাধ্য। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার সরব উচ্চারণ তারই প্রতিফলন। এ সুর আত্মপ্রত্যয়ের। এ বাণী জাতীয়তাবাদের। এ ব্যঞ্জনা আত্মনির্ভরশীলতার।

তিনজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে ৭ নভেম্বরের অধ্যায়। ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। সশস্ত্র বাহিনী বঙ্গভবন ছাড়া প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফের পদ থেকে পদচ্যুত এবং বন্দি করা হয়। খালেদ নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সামরিক বাহিনীরপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ পদত্যাগ করলে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দান করেন। মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেন। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সামরিক শাসন জারি করেন তিনি। মেজর হাফিজের মাধ্যমে ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী মেজরদের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া করেন। স্থির হয়, তখনো বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী মেজররা ৪ নভেম্বর নিরাপদে দেশত্যাগ করবেন। অস্ত্রশস্ত্র তখন ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসবে। ৪ নভেম্বর মেজররা দেশত্যাগ করলেন বটে, কিন্তু ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর। খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তাঁর এ অভ্যুত্থান কিন্তু ছিল অত্যন্ত স্বল্পকাল স্থায়ী। মাত্র চার দিনের মাথায় ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবে খালেদ মোশাররফের সব পরিকল্পনার অবসান ঘটে। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের গভীরতায় তিনি হন হকচকিত। ঢাকা ত্যাগ করার সময় শেরেবাংলা নগরের উপকণ্ঠে বিপ্লবী সৈনিকদের দ্বারা তিনি হন নিহত। পরবর্তী পর্যায়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেন। খালেদ মোশাররফ একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। ২ নম্বর সেক্টরে তাঁরই নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাঁর নামের আদ্যাক্ষর ধারণ করেই কে ফোর্স (K-Force) সংগঠিত। তাঁর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে কেন গেলেন? অভ্যুত্থানে তাঁর লক্ষ্য কী ছিল? তিনি কী পেতে চেয়েছিলেন?

ওই সব প্রশ্নের উত্তর একেকজন বিশ্লেষক একেকভাবে দিয়েছেন। কেউ বলেন, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল এক ধরনের পাল্টা-অভ্যুত্থান। শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি এবং তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রবর্তিত করার লক্ষ্যেই এটির আয়োজন। খালেদ, শাফায়াত উভয়েই ছিলেন মুজিবভক্ত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এমনকি তাঁদের কোনো কোনো নিকটাত্মীয় শেখ মুজিবের একদলীয় ব্যবস্থা, বাকশালের সদস্য ছিলেন। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই অভ্যুত্থানের পরে যে মিছিল সংগঠিত হয় তার কিছু কিছু স্লোগানে শেখ মুজিবকে 'জাতির পিতা' হিসেবে স্বীকৃতি এবং ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ছিল। কেউ বা বলে, একজন প্রফেশনাল সৈনিক হিসেবে ১৫ আগস্ট মেজরদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে তিনি ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হন এবং এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদ সোপান, প্রত্যক্ষ নির্দেশসূত্র এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। তখনো আটটি ট্যাংক এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মেজররা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন। সেনাবাহিনী ছিল দ্বিধাবিভক্ত। এক অংশ বঙ্গভবনে, অন্য অংশ ক্যান্টনমেন্টে অসহায়, দায়িত্বহীন, অকর্মণ্য যেন। তাই তিনি সামরিক বাহিনীকে শৃঙ্খলার ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে তাঁর হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন।

কারো কারো মতে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল প্রতিনিয়ত অতি সঙ্গোপনে তথ্য সংগ্রহকারী ভারতীয় 'র' (RAW)-এর সহযোগিতায় ভারতপন্থী এক অভ্যুত্থান। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ভারতের জন্য শুধু মারাত্মক ছিল না, তা ছিল ভয়ংকর রূপে অপমানসূচকও। বিশেষ করে খন্দকার মোশতাকের পাকিস্তানপন্থী, প্রো-চায়নিজ এবং আমেরিকাঘেঁষা নীতির জন্য। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের মৃত্যুতে ভারত শুধু যে এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে হারায় তা-ই নয়, এরপর বাংলাদেশে ভারতঘেঁষা কোনো কিছুর অবশিষ্ট ছিল না। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে যেভাবে চিত্রিত করে এবং ভারতের বিভিন্ন অংশে ভারতীয় জনগণের যে আনন্দ-উল্লাস পরিলক্ষিত হয়, তা এ মতবাদকে সমর্থন করে। বাংলাদেশের কোনো কোনো পত্রপত্রিকায়ও এর আভাস মেলে। Bangladesh Times পত্রিকার ৮ নভেম্বরের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, '৩ নভেম্বরের পাল্টা-অভ্যুত্থানে বিদেশি হস্তক্ষেপের আভাস রয়েছে।'
বিশ্লেষকদের এসব যুক্তির কোনো কোনোটি খণ্ডনযোগ্য। আওয়ামী লীগের প্রতি খালেদ মোশাররফের দুর্বলতা হয়তো ছিল। তিনি হয়তো বা মুজিবভক্তও ছিলেন। কিন্তু ১৯৭২-৭৫ আমলের আওয়ামী লীগ শাসনকে, বিশেষ করে বাকশালকে পুনরুদ্ধারের কোনো সংকল্প তাঁর ছিল না। আওয়ামী লীগ শাসন পুনঃপ্রবর্তনের কোনো লক্ষ্য থাকলে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করতেন না। ভেঙে দিতেন না জাতীয় সংসদ। সামরিক শাসন জারিরও কোনো চিন্তাভাবনা করতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মিছিলটি সংগঠিত হয় এবং মিছিল থেকে যে স্লোগান দেওয়া হয় তাতেও তিনি খুশি হননি। জানা যায়, ওই মিছিলের পরে তিনি বলেছিলেন, 'আমি শেষ হয়ে গেলাম।' ওই মিছিল সংগঠনের জন্য আওয়ামী লীগ যতটুকু তৎপর ছিল, মণি সিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাপও তেমনি তৎপর ছিল। তেমন হলে খালেদ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতার জীবন রক্ষা করে অবিলম্বে তাঁদের জাতির সামনে আনতে পারতেন। তাও তিনি করেননি। এমনকি চার নেতার মৃত্যুর পর তাঁদের মরদেহ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে তিন জাতীয় নেতার মাজারের পাশে দাফন করার যে প্রস্তাব তিনি পেয়েছিলেন তাতেও রাজি হননি। আওয়ামী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আগ্রহী থাকলে ৩ নভেম্বর অথবা অনতিবিলম্বে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে একটা মন্ত্রিপরিষদও গঠনের উদ্যোগ নিতে পারতেন। এগুলোর কোনোটির দিকেই তিনি যাননি।

আমার মনে হয়েছে, খালেদের ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল একটা 'ভেটো ক্যু' বা 'প্রি-এম্পটিভ ক্যু' (Veto or Preemtive Coup)। দুটি কারণে তিনি পূর্বাহ্নেই আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। তখন সামরিক বাহিনীর অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা সামরিক বাহিনীর মৌল নির্দেশ সূত্র ছিন্ন করে শৃঙ্খলাবোধ যে তার প্রাণ তা নিঃশেষ করতে চেয়েছিল বঙ্গভবনে অবস্থানের মাধ্যমে। দ্বিতীয় কারণটি ছিল আরো জরুরি। সেনা ও বিমানবাহিনীর মধ্যে তখন বহুসংখ্যক বিপ্লবী সংস্থা গঠন করে প্রচুরসংখ্যক বিপ্লববাদী সৈনিক প্রস্তুত হচ্ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করতে। তাদের লক্ষ্য ছিল, শ্রেণীহীন সশস্ত্র বাহিনীকে আরো তীক্ষ্নধার করে তার মাধ্যমে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন। এই অবস্থায় খালেদ মোশাররফ সম্ভবত চেয়েছিলেন ক্যুর মাধ্যমে দুই গ্রুপকেই একসঙ্গে নির্মূল করে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে সনাতন সশস্ত্রবাহিনীর আদলে পুনর্গঠন করতে।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁর কথা এ প্রসঙ্গে এসে যায়। তিনি কর্নেল তাহের। একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। কর্নেল তাহের ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। কামালপুরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি পা হারান। মুক্তিযুদ্ধে শৌর্য প্রদর্শনের জন্য তিনি হন বীর উত্তম। তিনি শুধু একজন কৃতী ও দক্ষ সৈনিক ছিলেন না, তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল বৈপ্লবিক। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাই তিনি ভাবতেন, সামরিক বাহিনীকে সৃজনমুখী, উৎপাদনক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে এবং সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের নিমিত্তে এ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে। আর একজন মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল জিয়াউদ্দীনের চিন্তা-ভাবনাও ছিল প্রায় অনুরূপ। কর্নেল তাহের এ লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আন্ডারগ্রাউন্ড শাখা বিপ্লবী শক্তিগুলোর সমন্বয়ে মনোযোগী হন। সেনা ও বিমানবাহিনীতে প্রচুরসংখ্যক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সংগঠিত হয়।

৩ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে কর্নেল তাহের একদিকে ওই অভ্যুত্থানকে ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে তার দুর্বল ভিত্তিকে আরো শিথিল করার দিকে যেমন মনোযোগী হন, তেমনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সৈনিকদের সংগঠিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। ৫ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টগুলো হাজার হাজার লিফলেটে ছেয়ে যায়। সামরিক কর্মকর্তাদের অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানে সাধারণ সৈনিকদের কোনো আগ্রহ নেই, এ যেমন বলা হয়, তেমনি জানিয়ে দেওয়া হয় যে বিপ্লবকে সফল করার জন্য সৈনিকরা যেন তৈরি থাকে। ৬ নভেম্বর রাতে কর্নেল তাহেরের সভাপতিত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় ৭ নভেম্বরের সকাল ৯টায় গুরুত্বপূর্ণ অভ্যুত্থান সার্থক করার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা, সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনার জন্য এক বিপ্লবী সামরিক পরিষদ গঠন করা, সব দলের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান, বাকশাল ব্যতীত অন্যান্য দলের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করা। এভাবে ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন।

জেনারেল জিয়া ছিলেন একজন খ্যাতনামা সৈনিক। ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে কৃতী যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরে তিনি নেতৃত্ব দেন। জেড ফোর্স (Z-Force) তাঁরই পূর্ণ নাম ধারণ করে। বীর উত্তম অভিধায় জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করে। ১৯৭২ সালে তিনি হন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি হন সামরিক বাহিনীর প্রধান। ৩ নভেম্বর রাত ১টায় তাঁকে খালেদ মোশাররফ বন্দি করেন। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে তিনি শুধু মুক্তই হলেন না, তিনি এলেন জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে।

কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা কেন সফল হলো না, তার পর্যালোচনা এ পরিসরে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় জেনারেল জিয়ার সাফল্যের মূলে কোন কোন উপাদান কার্যকর হয়েছিল। শুধু এটুকু বলা প্রয়োজন, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে জেনারেল জিয়া হয়ে ওঠেন জাতীয় আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। ভারতবিরোধী মানসিকতার কেন্দ্রবিন্দু। বাকশালবিরোধী চেতনার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের প্রত্যক্ষ নিদর্শন। জিয়া এই সন্ধিক্ষণে সিপাহি-জনতার সামনে দাঁড়ালেন ত্রাতা হিসেবে। নতুন যুগের পথপ্রদর্শক হিসেবে। বাংলাদেশের অধ্যাত্ম সত্তার রূপকার হিসেবে। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব এ কারণে এ জাতির কাছে এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন।

কর্নেল তাহেরের স্বপ্ন ছিল, সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে তার মাধ্যমে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের পূর্ণ সত্তার বিকাশ সাধন করা। জিয়া চেয়েছেন, জনগণের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিন্ধ্যাচল উল্লঙ্ঘন করতে। পরনির্ভরশীলতার সব বাধা দুমড়ে-মুচড়ে, জাতীয়তাবাদী চেতনার আগুনে সব বৈষম্য ও অনাচার ঝলসে জাতীয় সংহতির মূল সুদৃঢ় করতে। তিনি চেয়েছেন, বাংলাদেশ নিজের ওপর আস্থা রেখে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলাদেশের জনগণ স্বীয় সত্তায় বিশ্বাসী হয়ে মাথা উঁচু করুক সগৌরবে। তখন ভারতবিরোধী মনোভাবের মতো স্থূল প্রবণতা অথবা ভারতের ওপর নির্ভরশীলতার মতো হীনম্মন্যতা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আর ব্যাহত করবে না। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার উত্তরণ এই চেতনারই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অনুরণন।

৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মৌল সূত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিপ্লবী চেতনা দুই ধারায় ছিল প্রবাহিত। এক খাতে ছিল সমাজ পুনর্গঠনের জন্য বিপ্লবী চিন্তাস্রোত। অন্য খাতে প্রবাহিত হয়েছিল ভারতবিরোধী ও ভারতবিদ্বেষী চেতনা। চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতবিরোধী মনোভাব, বিশেষ করে আত্মনির্ভরশীলতার দুর্দমনীয় স্পর্ধাই জয়ী হয় এবং তারই শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন জেনারেল জিয়া। এ দেশের রাজনীতির গতিধারায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর যা ঘটেছিল, বাংলাদেশের রাজনীতির মৌলপ্রকৃতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটলে, ৫০ বছর পরও এমনি অবস্থায় এই সুর ছন্দিত হবে। উচ্চারিত হবে তেমনি বাণী। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই স্রোতের বিপরীতে চললে নিজের বিপদই শুধু ডেকে আনবে তা-ই নয়, সমাজে বিপ্লবের শিখা আবার প্রজ্বলিত করবে।

বঙ্গবন্ধু-সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী রাজনৈতিক দল ছিল ১৯৭২-এর অক্টোবরে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তারা রাজপথে সরকারের বিরোধিতা করা শুরু করে। তাদের আন্দোলন গতি পেয়েছিল, জনজীবনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পেরেছিল; কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তখন জাসদও চিন্তা করেছিল যে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে অবস্থানচ্যুত করা সম্ভব হবে না; অতএব সেনাবাহিনীর কোনো অংশকে যদি বন্ধু হিসেবে পাওয়া যায় তাহলে ভালো। এ মোতাবেক তারা, অর্থাৎ জাসদ সেনাবাহিনীর মধ্যে বন্ধু খোঁজার কাজে লিপ্ত হয়। ইতিমধ্যে কিছুসংখ্যক পাকিস্তান ফেরত এবং কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক তৎকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডের চরম বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশে একটি গোপন সৈনিক সংস্থা গঠন করেছিলেন। ওই গোপন সংস্থাও রাজনৈতিক মিত্রের সন্ধানে ছিল। বিবিধ প্রক্রিয়ায় এবং ঘটনার মাধ্যমে জাসদের সঙ্গে গোপন সৈনিক সংস্থার পরিচয়, বন্ধুত্ব ও সংহতি সৃষ্টি হয়। সেই সময় জাসদের অন্যতম নেতা ছিলেন আ স ম আবদুর রব, মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীর-উত্তম, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ। ১৯৭৪-৭৫ সালে এই রাজনৈতিক শক্তি (জাসদ) এবং সৈনিক শক্তির (গোপন সৈনিক সংস্থা) সমন্বয়ে প্রস্তুতি চলে রাজনৈতিক-সৈনিক বিপ্লবের উদ্দেশ্যে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা এবং ১৯৭৫-এর নভেম্বরের ৩ তারিখের ঘটনা তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। অতএব, এই যুগ্ম শক্তি দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা যদি নিষ্ক্রিয় বসে থাকে তাহলে আবারও কোনো কিছু এমন ঘটে যেতে পারে, যেটা তাদের অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনকে বিঘ্নিত করবে। অতএব, তারা সিদ্ধান্ত নেয় বিপ্লব সাধনের। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দিন ও ক্ষণ ছিল ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা তথা ৭ নভেম্বরের প্রথম মুহূর্ত।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক হোঁচট খায়। কারণ খন্দকার মোশতাক আহমেদ ভারতপন্থী ছিলেন না। সুতরাং ভারতের অনুকূলে সম্পর্ককে পুনঃ স্থাপন করা জরুরি ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেকেই এবং তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটিকে ভারতপন্থী অভ্যুত্থান হিসেবে মূল্যায়িত করে। যেহেতু তৎকালীন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ওই অভ্যুত্থানের সঙ্গে মতপার্থক্যে ছিলেন, তাই ৩ নভেম্বরের অভ্যুথ্যানকারীরা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেছিলেন। এই বন্দি করার ঘটনাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অতি বৃহদাংশের সাধারণ সৈনিকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং এ কারণে তাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ সৈনিকরা বিক্ষুব্ধচিত্তে অপেক্ষা করছিলেন কী নিয়মে আসলে ভারতপন্থী হোক বা না হোক কিন্তু তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে ভারতপন্থী মনে হওয়া খালেদ মোশাররফ বীর-উত্তমের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহকে নস্যাৎ করা যায় এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু জাসদপন্থী গোপন সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মতো সাধারণ সৈনিকরা আনুষ্ঠানকিভাবে সংগঠিত ছিলেন না। এ কারণে ৭ নভেম্বর প্রথম মুহূর্ত থেকেই সব সৈনিককে সাধারণভাবে একটি পাল্লায় বা একই মাপকাঠি দ্বারা মূল্যায়ন করা অসম্ভব ও অবাস্তব।

জাসদ ও গোপন সৈনিক সংস্থার সিদ্ধান্ত ছিল ৭ নভেম্বরের প্রথম মুহূর্তে বিপ্লব শুরু করবে সাধারণভাবে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবস্থিত কোনো না কোনো স্থাপনার ওপর আক্রমণ করত। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত ছিল, যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে সেখানে অফিসারদের হত্যা করা। কারণ অফিসাররা ব্যতিক্রমী কোনো বিপ্লবের পক্ষে নন। জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থার এই সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বসবাসরত সৈনিক ও অন্যদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন ছিল। সেই জন্য ৬ তারিখ সারা দিন বিভিন্ন মাধ্যমে ও ছত্রছায়ায় সেনানিবাসের অভ্যন্তরে লিফলেট বিতরণ করা হয়। কিছু কিছু লিফলেটের শিরোনাম ছিল এ রকম : সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের একটি স্বাভাবিক প্রত্যয় থাকত এই মর্মে যে সৈনিকরা ও অফিসাররা একাত্ম। অতএব কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। রাত ১২টা থেকে ঢাকা সেনানিবাসের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল গুলির আওয়াজে এবং আকাশে প্রজ্বলিত হয় এমন গুলির আলো যেগুলোকে সামরিক পরিভাষায় বলা হয় ট্রেইসার-বুলেট। ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান, মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার নুরুল আনোয়ার প্রমুখ অন্যদের নিয়ে পরামর্শ মোতাবেক চলতে তাৎক্ষণিকভাবে সম্মত হয়। ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে পাকিস্তান আমলের তোফায়েল কলোনি নামে পরিচিত, বাংলাদেশ আমলে শহীদ আজিজ পল্লী নামে পরিচিত, এলাকায় দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ক সপরিবারে বসবাস করতেন। পুরো আজিজ পল্লী এলাকা বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হয়। অধিনায়ক বের হতে পারেননি। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা নিজেদের গাড়ি-ঘোড়াতে করেই সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপ্লবে যোগ দেয়। ইতিমধ্যে মধ্যরাতের কিছু পরেই সৈনিকদের উদ্যোগে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয় এবং তিনি আবার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সূর্যোদয়ের প্রাক্কাল পর্যন্ত আসলে পরিষ্কার ছিল না যে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের শক্তি কতটুকু অবশিষ্ট আছে বা তাদের পরবর্তী লক্ষ্য কী? বাস্তবে যা ঘটেছিল তা হলো সূর্যোদয়ের অব্যবহিত আগেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং অন্য সঙ্গী নেতারা গোপনে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তাঁরা আশ্রয় পেয়েছিলেন; কিন্তু নিরাপত্তা পাননি। আনুমানিক সকাল ৯টায় তাঁদের লাশ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌছায়। ৩ নভেম্বরের কাহিনী এখানেই শেষ। ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ অব্যাহত থাকে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পর পরই দৃশ্যপট বদলে যায়। জাসদপন্থী সৈনিকরা চাচ্ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাক। অন্যপক্ষে সাধারণ সৈনিকরা চাচ্ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাক। জেনারেল জিয়াউর রহমান অন্য শুভাকাঙ্ক্ষী জ্যেষ্ঠ অফিসারদের পরামর্শে এবং সৈনিকদের আগ্রহে, দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির (সংক্ষেপে সেকেন্ড ফিল্ড নামে পরিচিত) অবস্থানে গিয়ে নিজের জন্য একটি অতি সাময়িক কমান্ড হেড কোয়ার্টার সৃষ্টি করেন। ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতের শেষাংশ তথা ৭ নভেম্বর সূর্যোদয়ের এক-দুই ঘণ্টা আগের ঘটনা অনেক ধরনের রহস্যের আড়ালে এখনো আবৃত। যেটা সুনিশ্চিত সেটা হলো জিয়াউর রহমানের প্রতি অনুগামী সৈনিকরা গোপন সৈনিক সংস্থার সৈনিকদের পরাভূত করেন এবং সেনানিবাসে ও ঢাকা মহানগরীতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।

৭ নভেম্বরের বিপ্লবের তাৎপর্য হলো এই যে সাধারণ সৈনিক ও জনগণের একাত্মতার কারণে একটি বামপন্থী রক্তাক্ত বিপ্লবী নাটকের মঞ্চায়ন থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পায়। ৩ নভেম্বরের সেনা বিপ্লবে ভারতপন্থী প্রবণতা দেখা যাওয়ায় সেই প্রবণতাও রুদ্ধ করা হয়। দেশ বাঁচে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হন জনগণের ও সৈনিকদেরদের সম্মিলিত নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৭ নভেম্বর এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান অবিচ্ছেদ্য। এক প্রকার বলতে গেলে ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা রক্ষার পুনঃ নিশ্চিতকরণ দিবস এবং এর মহানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক আহমদ ও লে. কর্নেল আবদুর রশীদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন। খন্দকার মোশতাকের এলাকার একজন বাসিন্দা ও তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠজন ছিলেন রশীদ। ওই সময় মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর সেনাবাহিনীর চাকরি শেষ হয়। এ অবস্থায় সামরিক বাহিনীর নিয়ম অনুসারে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামীপন্থী সেনা কর্মকর্তারা জিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম। তাঁকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ ব্রিগেডের কিছু অফিসার। রংপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদসহ কিছু কর্মকর্তাও খালেদকে সহযোগিতা করেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ষড়যন্ত্রকারীরা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু করেন। তাঁরা জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন এবং তাঁকে অবসরে যেতে বাধ্য করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ নিজেকে সেনাবাহিনীর প্রধান ঘোষণা করেন। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা খালেদ ও অন্য অফিসারদের কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। ৩ নভেম্বরের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সিপাহি-জনতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর বিপ্লব সংঘটিত হয়। সিপাহিরা জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন এবং আবার সেনাবাহিনী ও দেশের শাসনভার গ্রহণের অনুরোধ জানান। তাঁদের অনুরোধে জিয়া সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। উল্লসিত সিপাহিরা ট্যাংক ও গাড়ি নিয়ে শহরে বের হয়ে পড়েন। লাখ লাখ জনতা তাঁদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানায়। এ কারণে ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস আখ্যায়িত করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যদের পক্ষ থেকে ৭ নভেম্বরকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করার দাবি ওঠে।

৭ নভেম্বরের পাঁচ-ছয় মাসের ব্যবধানে সেনাবাহিনীতে একাধিক ক্যু সংঘটিত হয়। কিন্তু মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর সততা, বিচক্ষণতা ও মেধা দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং দেশবাসীর কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এর পেছনের মূল কারণ ১৯৭১ সালে দেশ যখন নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে, তখন রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেননি। ওই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জিয়া। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা নেতা, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, একজন সফল সমরবীর ও সফল সেনাপতি। তাঁর সঙ্গে অন্য কারো তুলনা হয় না।

ওই সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) চেয়েছিল জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে। দেশে গণতন্ত্র কায়েম করা জাসদের লক্ষ্য ছিল না। সেনাবাহিনীতে কর্নেল তাহেরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠলে সিপাহিদের হস্তক্ষেপে জনগণ সমাজতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা থেকে মুক্তি পায়। তাহেরের ফাঁসির ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। স্বাভাবিক নিয়মে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে তাঁর বিচার হয়। কোর্ট মার্শালের চেয়ারম্যান ও বিচারকরা তাহেরকে ফাঁসির আদেশ দেন। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ আবু সায়েম। তিনি কোর্ট মার্শালের সাজা বহাল রাখেন।

আওয়ামী লীগ চেয়েছিল খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে। আর জাসদ চেয়েছিল তাহেরের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে। জাসদ ওই সময় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করেছিল। দুটি দলই পৃথকভাবে ক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি; সিপাহিদের হস্তক্ষেপের কারণে ব্যর্থ হয়। এ জন্যই ৭ নভেম্বরকে তারা ভিন্নভাবে পালন করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:০৭
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×