![]()
পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষই অন্ততপক্ষে তাস খেলা না জানলেও তাস দেখেছেন বা এর নাম শুনেছেন। ৫২ তাসের ৫৩ খেলা রয়েছে। আপনাদের অনেকেই হয়ত ৫৩ খেলার সবগুলোই পারেন। আমি মোটামুটি কয়েকটা পারি। আপনাদের সকলের প্রতি অনুরোধ রইল যারা যে যে তাস খেলার নাম জানেন তা জানান। কারন খেলতে না পারলেও নামতো অন্তত জানতে পারব। ইংল্যান্ডের লীডস শহরের একজন অধিবাসিনী ছিলেন মিসেস হচকিস। এগারো বছর ধরে তিনি পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলেন। কথাবার্তা বলতে না পারলেও জ্ঞান ছিল। এগারো বছর বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি একার্তে তাস খেলতেন। ১৭৯৫ সালে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও তাঁর হাতে ছিল রুহিতনের সাত। হাত থেকে সেই রুহিতনের সাত যখন কিছুতেই আলাদা করা গেল না তখন সেই অবস্থাতেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
মার্কিন ধনকুবেরদের তাস খেলার একটি ভিডিও
তাস খেলা ভয়ংকর নেশা। অথচ শুরুতে অর্থাৎ তাসের জন্মলগ্নে এটা মোটেই আমজনতার খেলা ছিল না। মার্কিন ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট একবার বলেছিলেন, ‘আমি যখন ব্রীজ খেলি, তখন পাশ দিয়ে যদি একজন নগ্ন নারী হেটে যায়, আমি ফিরেও তাকাব না।’ শুধু ওয়ারেন বাফেটই না, আরেক শীর্ষ ধনী বিল গেটসসহ আমেরিকার আরও অনেক শীর্ষপর্যায়ের ব্যাক্তিই আসক্ত ইন্টারন্যাশনাল ব্রীজ নামের একটি তাসের খেলার উপরে। ১৯২৯ সালে ব্রীজ খেলাকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে খুনোখুনির ঘটনাও। পছন্দসইভাবে না খেলার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের স্বামীকেই খুন করে বসেছিলেন মার্টল বেনেট নাম্নী এক মহিলা। বিখ্যাত অভিনেতা ওমর শরিফ তাস খেলার উপরে এতটাই আসক্ত ছিলেন যে তিনি শিকাগো ট্রিবিউনে ব্রীজ নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন এবং পরবর্তীতে ওমর শরিফ ব্রীজ সার্কাস শ্লোগান নিয়ে একবার বিশ্বভ্রমণও করেন। নিউ ইয়র্কের শীর্ষ বিনিয়োগ ব্যাংক বিয়ার স্টার্নের সাবেক প্রধান জিমি সেইন একজন জাতীয় ব্রীজ চ্যাম্পিয়ন। নিক নিকেলের সঙ্গে জুটি বেধে তিনি একবার আয়োজন করেছিলেন 'কর্পোরেট আমেরিকা বনাম কংগ্রেস’ ব্রীজ ম্যাচ। নিক নিকেল আমেরিকার ব্রিজ লিগ অঙ্গনের একজন কিংবদন্তী। কর্পোরেট আমেরিকার পক্ষে সেইন ও নিকেল দলে ভিড়িয়েছিলেন সাবেক সিবিএস নির্বাহী লরেন্স টিচ ও বিয়ার স্টার্নের তৎকালীন সভাপতি অ্যালান গ্রীনবার্গকে। তারা মুখোমুখি হয়েছিলেন কংগ্রেসের টেক্সাস সেন, কেন বেইলি হাচসন,কেন্টাকি, জিম বানিংসহ আরও অনেকের। বরাবরের মতো ব্রীজেও জয় হয়েছিল কর্পোরেট আমেরিকার।
![]()
একবার রাজা জেমস প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন এবং রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জ্যোতির্বেত্তা হ্যালিকে রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ করেন। ডিনারের পর তাস খেলা হয়। তাসগুলি ছিল অ্যাষ্ট্রনমিক্যাল কার্ড। তাসের গায়ে বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জের ছবি আঁকা ছিল। খেলার স্মৃতি হিসাবে রুহিতনের তিরি প্রাসাদে রাখা হয়েছিল। পরে এটি অ্যাষ্ট্রনমার হাসেলকে দেখানো হয়। হাসেল তাসের কিছু জানতেন না। ছবিতে আঁকা তারাগুলি তাঁর মনঃপূত না হওয়ায় তিনি বললেন, ‘Why didn’t the artist make five points to the stars? there is no use upsetting the convention।’
![]()
কিছু ঐতিহাসিক তাস
তাস খেলার আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে প্রায় ছয়শত বছরেরও বেশি সময় আগে পঞ্চদশ শতকে। বিশ্বে প্রথম তাস খেলার প্রচলন ঘটে চীনে। খ্রিস্টীয় নবম শতকের দিকে টাং রাজার রাজত্বকালে অন্তঃপুরবাসী রানীরা তাস খেলে সময় কাটাতেন। তখন খেলার তাস হিসেবে পয়সা ও প্লেট ব্যবহার করা হতো। এ খেলা দ্রুত ভারতবর্ষেও তখন ছড়িয়ে পড়ে এবং খেলার তাস হিসেবে তখন রিং, তলোয়ার, কাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে। তবে ৫২ তাসের খেলা প্রচলন করে প্রাচীন মিশর। তারা এই তাস চারজন মিলে খেলত। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চারজন মিলে যেভাবে তাস খেলা হয়, সেটা মিশর উদ্ভাবন করেছিল খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এই খেলা রাজপরিবার এবং সৈন্য-সামন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে জার্মানির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাসের নামেও আসে পরিবর্তন। ক্ষমতানুযায়ী তাসের নাম দেওয়া হয় রাজা-রানী, জোকার ইত্যাদি। বর্তমানে এই খেলা এত বেশি জনপ্রিয় যে, তা মোবাইল ও কম্পিউটারের ভেতরেও ঢুকে গেছে!
![]()
চীন থেকে যারা গাধার পিঠে করে অথবা হাতিতে করে মালামাল বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেত অথবা বাণিজ্যিক কারণে যারা চীনে আসত তাদের মাধ্যমে তাস খেলা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। মামলুক শাসকরা এ খেলার নাম দিয়েছিল ন্যাব, নাইবি অথবা নাইপ। মামলুকরা বিশেষ করে মিশরে বায়ান্ন তাস দিয়েই এ খেলার প্রচলন রেখেছিল; কিন্তু তাদের তাসের প্রতীকগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। তারা ১-১০নং কার্ডকে কোর্ট কার্ড হিসেবে ধরে কিং কুইন এবং ভিজির চিহ্নিত একটি কার্ডও রাখত। ভিজির রুশ শব্দ, এর অর্থ হল উজির। মামলুক সম্রাটের কোনো এক উজিরের নাম ছিল নাইয়িব। তিনি এ খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন বলে মিশরে ন্যাব, নাইবি অথবা নাইপ নামে এই খেলার প্রসার ঘটেছিল।
![]()
ফ্রান্সের একটি তাস
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপের দেশগুলোতে তাস খেলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে ইউরোপীয় শাসকরা একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কারণ ওই সময় এ খেলাটি বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ব্যাপকভাবে জুয়া হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে; কিন্তু ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের নিষেধাজ্ঞা মোটেই কার্যকর হয়নি। জোহানবার্গের প্রিন্টিং মেশিন আবিষ্কারের ফলে বিপুল পরিমাণের তাস ছাপা হয়ে ইউরোপীয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় শাসকবর্গ এটাকে গ্রহণ করে নেয় সঙ্গে সঙ্গে গামবুলিংও অলিখিতভাবে স্বীকৃত হয়ে যায়। তাসের প্রতীকগুলো হল দৃশ্যমান কিছু ছবি। এতে ইশকাপন, হরতন, রুহিতন এবং চিড়িতন থাকে। এর মধ্যে প্রত্যেকটিরই রাজা, রানি এবং গোলাম আছে এবং এর সঙ্গে নির্দিষ্ট নম্বর মারা প্রত্যেকটি রঙ এবং প্রতীকের কিছু তাস রয়েছে। অবশ্য একই প্রতীক নিয়ে বা তাসগুলোর মান ও নাম একই রকমভাবে; কিন্তু বিশ্বের সব দেশে প্রচলন হয়নি। ইতালিতে রাজা ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ার ডোনা বা রানি এবং অন্য তাসগুলোতে সৈনিক হিসেবে কল্পনা করে তাস খেলা প্রসারের প্রথম দিকে খেলা আরম্ভ হয়, পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে শিকারি। যে রাজহাঁস বা হরিণ শিকার করে এবং রাজহাঁস বা হরিণের ছবি সংবলিত তাসও বায়ান্ন তাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়; কিন্তু তাসের সংখ্যা বায়ান্নই থেকে যায়।
![]()
ফ্রান্সে ১৪৮০ সালে যখন তাস খেলার প্রচলন ঘটে, তখন তাদের তাসগুলো ছিল ইশকাপন, হরতন, রুহিতন এবং চিড়িতন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তরবারিধারী রাজা এবং একচক্ষু রানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন এই খেলা প্রথম প্রবেশ করে তখন এই খেলার মধ্যে তারা নতুন একটি নিয়ম সংযোজন করে, যাকে তারা বলত ট্রয়নকি। বর্তমানে এই শব্দটি থেকে ট্রাম শব্দটি এসেছে।
![]()
তাসের চারটি প্রতীক পঞ্চদশ শতকের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর পরিচয় বহন করে । আবার তাসের ছবিগুলোতে উপস্থাপিত হয়েছে ঐতিহাসিক নানা ব্যক্তিত্বের। প্রথম দিকে তাসের প্যাকেটে ৭৮টি তাস থাকত। কিন্তু এতগুলো তাস নিয়ে খেলা জটিল ও কষ্টকর হয়ে ওঠায় তাসের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। তবে হ্রাসকৃত সংখ্যার মধ্যে যে তাসটি এখনো সগৌরবে টিকে আছে সেটি হলো জোকার। খেলুড়েদের কাছে এই তাসটি সুপার ট্রাম্প কার্ড হিসেবে পরিচিত।
![]()
প্রধান চারটি তাস কিসের প্রতীক বহন করে চলেছে এবার সেটা জানা যাকঃ
-> ডায়মন্ডস হলো ধনী শ্রেণীর প্রতীক। তখনকার সময়ে এরা ছিলো শাসক শ্রেণী। ডায়মন্ডস দিয়ে তাদের ধনদৌলত-ঐশ্বর্য কে বোঝানো হতো।
-> স্পেডসের হলো সৈন্যের প্রতীক । স্পেড শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ স্পাডা থেকে। যার অর্থ তরবারি।
-> হার্টস পাদ্রিদের প্রতীক। আগে প্রতীকটির আকার ছিল পান পাতার মতো। পরে ওটা হার্ট বা হৃৎপিণ্ডের আকার পায়।
-> ক্লাবস বলতে বোঝানো হতো গরিব মানুষদের। ইংরেজি ক্লাবের বাংলা হলো মুগুর। গরিব শ্রেণীর মানুষের মুগুরই সম্বল এরকম একটা অর্থ বহন করে এই তাসটি।
![]()
আদি সুইস তাস
তাসের গায়ের ছবিগুলোরও রয়েছে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাঃ
কিং অব ডায়মন্ডস হলেন জুলিয়াস সিজার এবং কুইন অব ডায়মন্ডস হলেন তার স্ত্রী র্যাচেল। কিং অব স্পেডস হলো ডেভিড, গোলিয়াথের হত্যাকারী। এই তাসের রানী হলেন গ্রিক যুদ্ধ দেবী প্যালাস, যিনি দুই হাতে ধরে আছেন তরবারি ও ফুল। কিং অব হার্টস এর ছবি আঁকা হয়েছে বিখ্যাত রাজা শার্লেমেন এর অনুকরণে যিনি ৮০০ খ্রিস্টাব্দে জয় করেন অর্ধেক ইউরোপ। তার তাসের রানী হলেন বাইবেল উল্ল্যেখিত নায়িকা জুডিথ। যিনি রাজার তরবারির এক আঘাতে এক আসিরিয়ান সেনাপতিকে হত্যা করেছিলেন। কিং অব ক্লাবস হলেন দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, যিনি ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে পৃথিবীর প্রায় পুরোটা দখল করে নিয়েছিলেন। আগের তাসে পৃথিবীর মানচিত্রের গোলক থাকত, পরে তার আলখেল্লায় গোলকটি আঁকা হয়। কুইন অব ক্লাবস হলেন একমাত্র ইংরেজ মহিলা। যিনি আর কেউ নন রানী প্রথম এলিজাবেথ। তার গোলাম হলেন রাউন্ড টেবিলের বিখ্যাত নাইট, স্যার ল্যান্স লট।
![]()
সব চেয়ে সেরা তাস হচ্ছে ইশকাপনের টেক্কা। একে ‘হেড অব দি প্যাক’ বলা হয়। ইংল্যাণ্ডে যখন প্রথম তাস খেলার প্রবর্তন হল তখন তাসের উপর দুর্দান্ত ট্যাক্স বসানো হয়েছিল। তাস প্রস্তুতকারক প্রত্যেক ফার্মকে এক কুড়ি ইশকাপন টেক্কার তাস এক সঙ্গে ছাপা হয় এমন একটি প্লেট তৈরি করে সরকারকে দিতে হত। এই প্লেটের সাহায্যে ইশকাপন টেক্কার সব তাসই সরকারি ছাপাখানা অর্থাৎ সমারসেট হাউসে ছাপা হত। কোম্পানির নিজস্ব নাম ও মার্কা এই তাসের উপর লেখা থাকত। প্রত্যেক কুড়িটি টেক্কার সিটের জন্য তাস ব্যবসায়ীকে দিতে হত এক পাউণ্ড এবং প্রতি একশো জোড়া তাসের জন্য ট্যাক্স লাগত পাঁচ পাউণ্ড। সে যুগে এক প্যাক তাসের দাম ছিল খুব কম করে এক গিনি। ফলে তাস ছিল অত্যন্ত ধনী ব্যাক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরে ব্রিটেনে ট্যাক্স কমে তিন পেন্সে এসে দাঁড়িয়েছিল। ইশকাপনের টেক্কাকে স্প্যাডিলও বলা হত। আলেকজাণ্ডার ডুমা তাঁর লেখায় বলেছেন যে, শিশু নেপোলিয়নের ভাগ্য গণনার সময় কর্সিকার ডাইনি বুড়ি কড়াইতে যে ঐন্দ্রজালিক পাঁচন জ্বাল দিয়েছিল তার অন্যতম উপাদান ছিল স্প্যাডিল।
![]()
Ace হচ্ছে টেক্কা। এই শব্দটি এসেছে ল্যাটিন AS কথা থেকে যার অর্থ একক। হরতনের টেক্কার আরেকটি নাম হচ্ছে Latimar’s Card। বিশপ ল্যাটিমার গির্জার বেদীতে বসে তাসের প্যাক হাতে দিয়ে ধর্ম বিষয়ক উপদেশ বা Sermon প্রচার করতেন। ল্যাটিমার বলতেন, ‘Let us play at Triumph'। Triumph থেকে Trump কথাটা এসেছে। আবার এই হরতনের টেক্কা হচ্ছে ঐশ্বরিক এককত্বের প্রতীক। কারণ, বিশপের বক্তৃতার মর্মার্থ ছিল, ঈশ্বরের কাছে সবটা সমর্পণ করতে পারলেই মানুষের আত্মার মুক্তি ঘটে।
(তথ্য সংগ্রহে উইকিপিডিয়া ও তাস সম্পর্কিত কিছু আর্টিকেল)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



