somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয়ে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবের কবলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি। কিন্তু যখন এই মৌলিক চাহিদার উপর কালো মেঘ এসে ছেয়ে যায় তখন একটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের চেয়ে বড় আর কোন বিষয় থাকেনা। দৃশ্যমান ব্যবস্থার পেছনে যখন কোন অদৃশ্য ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ পাওয়া যায় তখন সাধারন মানুষের উপর এর কিছু দায় এসে বর্তায়। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের নাপাক জোট দ্রবীভূত থাকে। এই অদৃশ্য ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়াই রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রথম দায়িত্ব। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তার ব্যতিক্রম নয়। এই ব্যবস্থা এতটাই সূক্ষ্ম ভাবে কাজ করে যে, অধিকাংশ মানুষ এর বহুদূরপ্রসারিত ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে পায় না।

২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ জিপিএ-৫ পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমবার জিপিএ-৫ পেয়েছিলো মাত্র ২০ জন শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিলো ৩৮.৪৩ শতাংশ। ২০০৪ সালে ছিলো ৪৭.৭৪ শতাংশ, ২০০৫ সালে ছিলো ৫৯.১৬ শতাংশ, ২০০৬ সালে গড় পাসের হার ছিলো ৬৫.৬৫ শতাংশ। কিন্তু ২০০৮ সালে এসে এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার দাঁড়ায় ৭৬.১৯ শতাংশ। যা পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০০৯ সালে গড় পাশের হার ছিলো ৭২.৭৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ছিলো ৭৪.২৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিলো ৭৫.০৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ছিলো ৭৮.৬৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ছিলো ৭৪.৩০ শতাংশ এবং সবশেষে ২০১৪ সালে এসে এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাশের হার দাঁড়ায় ৭৮.৩৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট ও সমমানের পরীক্ষায় মোট জিপিএ-৫ পায় ৭০ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী। মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৪ জন। মোট ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২ হাজার ৩৫২টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ঠিক একই ভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও গড় পাশের হার ২০০৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সাল নাগাদ এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পাওয়া দেখে মনে হতে পারে যে, বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান অনেক উন্নত হয়েছে। মেধার বিকাশ ঘটেছে ইর্শণীয় পর্যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৫৫ শতাংশ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী উত্তীর্ণই হতে পারেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পাওয়া বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর পায়নি। স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে ক, খ ও গ ইউনিটে জিপিএ-৫ পাওয়া ৪৪ হাজার ৬৪২ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলো। এর মধ্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ১৯ হাজার ৮৬৮ জন বা প্রায় ৪৫ শতাংশ। বাকি ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণই হতে পারেনি। ২০১০ ও ২০১১ সালে এই অনুত্তীর্ণের হার ছিলো যথাক্রমে ৫২ ও ৫৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বরই পায়নি। তাহলে শিক্ষার মান বেড়ে মেধার বিকাশ হয়েছে বলাটা অযৌক্তিক।

তাহলে এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়; মেধা শূণ্য এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে কিভাবে? কিভাবেই বা পাশের হার এত বেড়েছে? শিক্ষার মান সত্যি কি আদৌ বেড়েছে? মেধার বিকাশ আসলে বর্তমানে কোন পর্যায় এসে দাঁড়িয়েছে?

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন বিষয়ের খাতা দেওয়ার সময় শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে শিক্ষকদের লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয় যেন উদারভাবে নম্বর দেওয়া হয়। নির্দেশনায় এমন কথাও বলা থাকে যে, শিক্ষার্থী ভুলশুদ্ধ যাই লিখুক না কেন, তাকে নম্বর দিতেই হবে। আর নম্বর দিতে হবে বাড়িয়ে বাড়িয়ে। যে শিক্ষার্থী পাস নম্বর পাওয়ার যোগ্য নয়, তাঁকে পাস নম্বর বা তার অধিক নম্বর দিতে হবে। আর বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দেওয়ার ফলে যে শিক্ষার্থী ৫০ নম্বর পাওয়ার যোগ্য, সে পেয়ে যায় ৬০, ৬৫, ৭০ বা তার অধিক। নম্বর দেওয়ার বেলায় উদার নীতিমালা অনুসরণ করার ফলে কৃত্রিমভাবে মেধার বিকাশ ঘটে। যার ফলস্বরূপ উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। কিন্তু বাস্তবে এইসব জিপিএ-৫ গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বা বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণই হতে পারে না। এর ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা ও মানের প্রতিফলন হয় না। এতে করে অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু এর জন্য মেধা শূণ্য শিক্ষার্থীদের আসলে দোষ দেয়া চলেনা।



মানুষের জন্য সমাজে মাথা উঁচু করে; মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোটা গৌরবের। যে মানুষের মেরুদন্ড ভেঙে যায় তার জন্য অসহায়ত্বের সীমা থাকেনা। শিক্ষা একটি জাতির জন্য মেরুদন্ড স্বরূপ। সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা দেখে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে বারবার; যে এই জাতি যেন ভবিষ্যতে সোজা হয়ে মাথা উঁচু করে গৌরব নিয়ে দাঁড়াতে না পারে সেই আয়োজন চলছে ঘটা করেই। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন বেহাল দশার উন্নয়নের জন্য সরকারের স্বদিচ্ছাই যথেষ্ট হওয়ার কথা! মূলত শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে আশঙ্কাজনক অধঃপতন হয়েছে, তার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাটাই দায়ী। স্কুল কলেজ থেকে যথাযথ শিক্ষা না দেওয়া, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয়ে পড়াশোনা কমে যাওয়া, স্বল্প পরিশ্রমে সফল হওয়ার প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীলতা, বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দিয়ে কৃত্রিমভাবে মেধার বিকাশ ঘটানো; এসব কিছুর সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে শিক্ষার মান না বেড়ে বরং শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসা। যার ফলস্বরূপ দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব গ্রাস করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে।

জেএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা!

খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা অলকা বিশ্বাস বিষয়টিকে তুচ্ছ ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়ে; দম্ভোক্তি প্রকাশ করে বলেন যে এ ধরনের কাজ সব শিক্ষকই করে থাকেন। খাতাগুলো তিনিই শিক্ষার্থীদের দিয়েছেন বলে সগর্বে স্বীকারও করেন। [সূত্রঃ যায়যায়দিন]



এই যখন দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের অবস্থা; তখন একবার নজর দেয়া যাক প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে; সেই প্রশ্নপত্রেই পরীক্ষা সংঘটিত হওয়ার দিকে। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই পরীক্ষা নিয়ে আমরা আজ উদ্বিগ্ন। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বিসিএস পরীক্ষার। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার। মেডিক্যাল ভর্তি এবং ডাক্তার হওয়ার চূড়ান্ত পরীক্ষার। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষার। এসএসসি পরীক্ষার, এইচএসসি পরীক্ষার। প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কামিল পরীক্ষার। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের প্রাকনিবন্ধন পরীক্ষার। অধিকাংশ পরীক্ষার্থীরা এই প্রশ্ন না পেলেও ত্রিশ থেকে চল্লিশ ভাগ শিক্ষার্থীর হাতে হাতে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পাওয়া গেছে দেশের অর্ধেক পরীক্ষা কেন্দ্রে। যারা প্রশ্ন পরীক্ষার আগে পায়নি, তারা মিছিলও করেছে। সমাবেশ করেছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। মহানগরীর সিংহভাগ এলাকায় পরীক্ষার আগের দিন রাতে প্রশ্ন চলে গেছে স্কুলে স্কুলে। পৌঁছে গেছে ভাগ্যবান শিক্ষার্থীদের হাতে। অভিভাবকরাও মহাখুশি।

প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার চেয়ে; সবচেয়ে দুঃখজনক হলো শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যখন ফাঁসকৃত প্রশ্ন তাদের হাতে তুলে দিয়ে; নিজেরাই তাদের জীবন নষ্ট করছে।



যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে কঠিন তদারকির কথা, নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ; এমনকি ফেসবুকের উপর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারী করা হচ্ছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে কোন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা হয়ে থাকে সরকারী ছাপা খানা থেকে, যা কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে চক্র এমন অসাধু কাজে লিপ্ত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে খুব সহজেই দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া গেলেও নেয়া হচ্ছেনা কেন; সেটাই এখানে মূল ভবিতব্য বিষয়! সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত করার ঘোষণা এবং জড়িতদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার প্রশাসনিক হুমকিও এসেছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। এমন একটি পরীক্ষাও বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত হয়নি, যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। সর্বশেষ এবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অন্যান্য শ্রেণীর চেয়ে সবচেয়ে বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই সমাপনী পরীক্ষার চূড়ান্ত ব্যবস্থাটি গ্রহণ করা হয়েছিলো ২০০৩ সালের শিক্ষাবর্ষে। যা এই সরকারের আমলে এসে চূড়ান্ত পর্যায় রুপ পেলো পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে ফাঁস হয়ে যাওয়া পরীক্ষাগুলোর কোনো ফলাফল বন্ধ থাকেনি এবং দুই একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ছাপা হলেও কোনো ধরনের শাস্তির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। দেশের মানুষ আজ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, শিক্ষাব্যবস্থায় তারা আমূল পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু বাস্তবিক চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানে পরীক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই পৌঁছে যাচ্ছে। সরকারের সকল তদন্তই অর্থহীন। কোনো তদন্তের কোনো কিছুই দেশের মানুষ জানতে পারছেনা। মূলত প্রশ্ন যেখানে ছাপা হয় এবং যেখান থেকে বিতরণ করা হয় সেখানেই প্রশ্ন ফাঁসের মূল আস্তানা। এ দুটির সঙ্গেই সরকার এবং সরকারি কর্মকর্তারা সামগ্রিকভাবে জড়িত। অথচ পরিতাপের বিষয় তদন্ত হয় ফেসবুক নিয়ে।

তাহলে কি এই ক্ষেত্রে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে না? বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মেধার বিকাশের বদলে মেধা শূণ্য হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। চলছে মেধাহীন, মেরুদন্ডহীন জাতি তৈরি করার গভীর ষড়যন্ত্র।



এখানে, ২০০১-২০০৬ সালের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এই সময়টাকে স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এই সময়টাতে বাজারের প্রচলিত নোট বই এবং কোচিং সেন্টারগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছিলো; এমনকি শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছিলো। এমনকি নেয়া হয়েছিলো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। নোট বই এবং কোচিং সেন্টারগুলো মূলত অর্থের বিনিময়ে দুর্বল মেধার জন্য অন্যতম অণুঘটক হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে ভালো যে বিষয়টি ছিলো; নকল করার কথা দূরে থাক নকলের নাম শুনলেই মানুষ যমের চেয়ে বেশী ভীত হয়ে উঠত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে নোট বই এবং কোচিং সেন্টারে বাজার পুনরায় সয়লাব হয়ে গেছে। এমনকি শিক্ষকরা ক্লাসের চেয়ে বেশি ব্যাস্ত হয়ে গেছেন বাসায় পড়ানো নিয়ে। শুধু তাই নয় বাসায় গিয়ে না পড়লে, শিক্ষকের দেয়া নোট না লিখলে কোন কোন ক্ষেত্রে বিনা কারণে পরীক্ষায় ফেল পর্যন্ত করিয়ে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে শুধু নকল কেন! প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটাও হয়ে দাঁড়িয়েছে সংস্কৃতির অংশ।



ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় নকল করতে না দেওয়ায়; পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ২৩২ নং কক্ষে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদেরকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দিয়ে ভাংচুর চালায়। [সূত্রঃ দৈনিক কালেরকণ্ঠ]

প্রায় সবকটি ধর্মেই লটারীকে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সেই হারাম লটারীই যখন হয়ে উঠে মেধার প্রধান মানদণ্ড তখন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার বিকল্প কিছু থাকেনা। শিক্ষাক্ষেত্রে জীবনের প্রথম শুরুটাই যদি হয় লটারী দিয়ে, তাহলে ভবিষ্যতে একটা শিশু বড় হয়ে শিক্ষার যে আলো ছড়াবে সেটা কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটাই ভবিতব্য বিষয়!

এখানে প্রকৃত মেধার তাহলে আর মূল্যটা রইল কোথায়?

কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন শিশুদের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে স্কুলে ভর্তি হতে হতো। সেই সময়টাই ভালো ছিলো। প্রকৃত মেধার বিকাশ হতো। যে শিশু এক থেকে দশের নামতা থেকে শুরু করে বাংলা ইংরেজীতে ট্রান্সলেশন পর্যন্ত করতে পারে, টেন্স, আর্টিকেল এমনকি সাধারন জ্ঞানের অনেক কিছুই জানে, জানে পচুর ভোকাবিলুরী; অথচ সেই তাকেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য হেরে যেতে হয় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী একজনের কাছে। তাহলে যে শিশুটি লটারী নামক জুয়া খেলায় হেরে গেল; সে যদি বলে বসে কেন আমাকে এত পড়াশোনা করালে তারচেয়ে ঘরে বসে বসে টিভিতে ডোরেমন কার্টুন দেখতাম তাই ভাল ছিলো! তখন আর সেই সন্তানের কাছে আসলে জবাব দেবার কিছু থাকেনা।

মূলত সব অভিভাবকের স্বপ্নই থাকে তার সন্তানকে ভালো একটি স্কুলে পড়ানোর জন্য। শিক্ষার পরিবেশ একটি শিশুর মেধার বিকাশ এবং বেড়ে উঠার জন্য অন্যতম অণুঘটক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই লটারী প্রথার জন্য দেখা যায় অধিকাংশ মেধাবী শিশু জীবনের শুরুতেই হোঁচট খায়। অবশেষে ভালো একটি স্কুলে পড়তে না পেরে; গিয়ে ভর্তি হয় এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে মেধার বিকাশের বদলে মেধা ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। তবে যাদের টাকার অভাব নেই তারা মোটা অংকের ডোনেশন দিয়ে ভর্তি করানোর সুযোগ পায়। কিন্তু তার সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। অধিকাংশের ক্ষেত্রে হেরে যেতে হয় লটারী নামক জুয়া খেলায়।



স্থানীয় মন্ত্রীরা সাধারণত তার এলাকার স্কুলের সভাপতি হয়ে থাকেন। সরেজমিনে ঘুরে জানা যায় যে অভিযোগ আছে; এমন অনেক মন্ত্রী আছেন যারা তাকে শুধু মাত্র ভোট দেয়ার শর্তে তার নিজস্ব কোঠায় কিছু নিয়োগপত্র প্রদান করে থাকেন। আর যারা তার এলাকার নন তাদের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ডোনেশন নেয়া হয়ে থাকে। এই কাজের ক্ষেত্রে মন্ত্রী সরাসরি জড়িত না থাকলেও মন্ত্রীর কিছু সহচারীরা জড়িত থাকে। এমনকি স্কুলের প্রধানশিক্ষক থেকে শুরু করে অভিভাবক প্রতিনিধিরাও পর্যন্ত জড়িত থাকেন কোন কোন ক্ষেত্রে।



রাজধানী ঢাকার নামকরা স্কুলগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে; কোন কোন স্কুলে লটারীর আগে গণহারে সবার কাছে ভর্তি ফর্ম বিক্রি করা হচ্ছে। এইক্ষেত্রে ভর্তি ফর্ম বিক্রি করা হয় চড়া মূল্যে যা বছরের ভর্তির সময়টাতে আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে নেয়া হয় ভর্তি ফি বাবদ আরও চড়া মূল্য। এই নিয়ে অভিভাবকদের কয়েকদফায় আন্দোলন পর্যন্ত করতে হয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। বরং সাংবাদিক এবং অভিভাবকদের সাথে মন্ত্রীদের হাতাহাতির অপ্রীতিকর ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে দেখা গেছে। কোন কোন স্কুলে লটারীর আগে ভর্তি ফর্ম বিক্রি করা হয় শিশুর মেধা যাচাই করে। উদাহরণ স্বরূপ শিশুকে লিখতে দেয়া হয় তার নিজের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, ফোন নাম্বার, স্থায়ী ঠিকানা, অস্থায়ী ঠিকানা একবার বাংলায়, আরেকবার ইংরেজীতে। যারা পারছে শুধু মাত্র তাদেরকেই ভর্তি ফর্ম দেয়া হচ্ছে। তারপর সেখান থেকে লটারীর মাধ্যমে বাছাই করে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়। কিছু স্কুলে আবার ভর্তি ফর্ম সবাইকে দেয়া হলেও জমা নেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র যেসব শিশু নিজেদের ফর্ম নিজেরাই পূর্ণ করতে পারছে শুধু মাত্র তাদেরকেই। তারপর লটারীর মাধ্যমে ঘোষণা করা হচ্ছে চূড়ান্ত ফল। এখন প্রশ্ন হলো, যদি এভাবে মেধা যাচাই করাই হয় তাহলে কেন আবার লটারী প্রথা? এখন যে বাচ্চাটা জীবনের প্রারম্ভেই লটারী নামক জুয়া খেলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে; সেই যদি বড় হয়ে চাকরী ক্ষেত্রে লটারী চায়, বিয়ের জন্য পাত্রপাত্রী চায় লটারীর মাধ্যমে তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবেনা।



বর্তমানে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতির নামে চলছে হত্যাকান্ড। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের কথা উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে। অথচ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে অত্যন্ত গৌরবময় ইতিহাস। অভিযোগ আছে, এইসব ছাত্ররাই শিক্ষাক্ষেত্রে নানা দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। আর হবেইনা বা কেন, যাদের গোড়াতেই গলদ দিয়ে শুরু তারাইত সেবিবে রাম রাজত্বের লঙ্কা কান্ড। আর যাদের ছত্রছায়ায় লালিত পালিত হচ্ছে বাবা-মায়ের দুঃস্বপ্ন, মায়ের আঁচল কান্নায় ভিজে যাচ্ছে আদরের সন্তান হারানোর শোঁকে; সেই তারাই রয়ে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে ভদ্রতার নাম ধরে।



অতএব, আমাদের নিজেদের স্বার্থেই, দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেই আমাদের সচেতন হতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে মেধাশূণ্য, মেরুদন্ডহীন জাতি হিসেবে পরিণত হওয়ারা সুগভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই জেগে উঠার এখনই শেষ সময়।

[ছবি সূত্রঃ গুগল সার্চ ইঞ্জিন]
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৩১
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×