somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কান্ডারি অথর্ব
আমি আঁধারে তামাশায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূণ্যতা থেকে শূণ্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙ্গলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে।

চা এবং এক কাপ কফি

০৬ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




কফি হবে?

জী আপা, হবে। একটু বসেন আপা; কফি বানায় দিতেছি। ঈশ ! আপাত বৃষ্টিতে এক্কেবারে ভিজা গেছেন।

হুম !

মামা, দাও দেখি; আমাকেও এক কাপ কফি বানিয়ে দাও।

মামা, আপনে কফি খাইবেন ! আপনেত মামা কোন সময় কফি চান না ! আপনেত দেহি রোজ চাই খান। আইজকা আবার কি মনে কইরা কফি খাইবেন ?

হুম ! চাত রোজই খাই। আজকে এই রাতের বেলা বৃষ্টিতে কফি খেলে মনে হয় ভাল লাগবে; তাই খাব। দাও আমাকেও এক কাপ কফি বানিয়ে দাও।

মোস্তফা মামা খুব মনোযোগ দিয়ে দুই কাপ কফি বানালো। এমন মনোযোগ দিয়ে মামাকে কখনও চা বানাতেও দেখি নাই যতটা মনোযোগ দিয়ে আজকে কফি বানাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন বিশেষ কোন উপলক্ষে কফি খাওয়ার আয়োজন চলছে খুব নিখুঁত ভাবে। কফি বানানোতে একটু ভুল হয়ে গেলেই সর্বনাশ হবে। পুরো আয়োজনটাই বৃথা হয়ে যাবে।

মামা ঠোঁট বাঁকা করে একটা ঠাট্টা স্বরূপ হাসি দিয়ে আমার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিল। মেয়েটাও কফির কাপ হাতে নিয়ে দোকানের বেঞ্চটাতে এসে তার ভেজা শরীর নিয়েই আমার পাশে বসল। আমার মধ্যে মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমি যেন ঠিক সেদিনের সেই সন্ধ্যার অনুভূতি টের পেলাম। আমার কাছে মনে হলো আমি যেন আমার নিঃশ্বাস ভরে শিলা আপার শরীরের সেই ভেজা ঘ্রাণ পাচ্ছি। সেইসে চেনা পরিচিত কণ্ঠ, সেই চেনা পরিচিত শরীরের অদ্ভুত মাদকতাময় ঘ্রাণ !

আমি তখন সদ্য ঢাকা শহরে এসেছি। কথায় আছে পড়াশোনা করে যে, গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। সেই গাড়ি ঘোড়া যেন উন্নতমানের হয় সেই আশায় ঢাকায় এলাম। ঢাকায় এসে ঘোড়ায় চড়া না হলেও দোতালা বাসে ঠিকই চড়া হলো। তবে আজ অবধি মনের ভেতর একটা আফসোস রয়ে গেছে। পড়াশোনা শেষ করেছি সেই কবেই। নিজের কোন গাড়ি না হলেও; এখনও সেই দোতালা বাসেই চড়তে হয়। যাই হোক, ঢাকার একটা নামীদামী স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হয়ে গেলাম। গ্রামের মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়ান দূরন্ত একটা ছেলে আমি শহরে এসে গোবেচারা হয়ে গেলাম। আমার বড় ভাই তখন একটা ওষুধ কোম্পানিতে সেলস রিপ্রেসেন্টেটিভ হিসেবে চাকরী করেন। উঠেছি বড় ভাইয়ের সাথে একটা মেসে। মেসের এক রুমে আমি আর আমার ভাই থাকি। বড় ভাই সারাদিন কাজে বাইরে থাকেন। সেই ভোর বেলায় বের হয়ে যেতেন; ফিরতেন অনেক রাত করে। আমি মাঝে স্কুল শেষ করে মেসে ফিরে একাকীত্বের মাঝে ডুবে যেতাম। আমার বই পড়ার অভ্যাসটা মূলত সেই সময়েই গড়ে উঠে। বাড়ি থেকে যে টাকা পাঠাত তা দিয়ে গাদা গাদা গল্প, উপন্যাস আর কবিতার বই কিনে শুধু পড়তাম। সময়গুলো খুব ভাল কেটে যেত। পাঠ্যপুস্তক না পড়লেও গল্প, উপন্যাস আর কবিতার বইগুলো প্রায় সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো।

আমাদের মেসে কয়েক ঘর পেছনেই ছিলো শিলা আপার ঘর। শিলা আপার ঘরের সাথেই ছিলো রান্না ঘরটা। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব চায়ের তেষ্টা পেত। তাই চা বানাতে গেলেই শিলা আপার ঘরের সামনে দিয়েই যেতে হতো। প্রতিবারই যাওয়া-আসার সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও জানালা দিয়ে আপার ঘরের দিকে একবার উঁকি দিয়ে দেখতাম। শিলা আপা একটা গার্মেন্টসে চাকরী করেন। কিন্তু তাকে বেশির ভাগ সময়ে ঘরেই দেখতাম। আবার মাঝে মাঝে একদম লাপাত্তা। দুই তিন দিন পর তিনি ফিরে আসতেন। সকালে গার্মেন্টসে যেতেন ফিরে আসতেন বিকালের আগেই। আবার মাঝে মাঝে বিকালে বের হতেন; ফিরতেন অনেক রাত করে। মাঝে মাঝেত বিকালে বের হয়ে ফিরতেন পরদিন সকালে। আমি তার চাকরীর কোন হিসাবই মেলাতে পারতাম না। এ আবার কেমন চাকরী ? কোন গার্মেন্টসের সময়সূচী আবার এমন হয় নাকি ?

একদিন শিলা আপা আমাকে ডেকে বললেন, এই ছেলে তুমি এই বয়সেই এত চা খাও কেন? এত চা খাওয়া ভাল না।

আমি বললাম, আপা একা একা থাকি। সময় কাটেনা। তাই বই পড়ি। আর বই পড়লে খুব চায়ের তেষ্টা পায়।

কেন তোমার কোন বন্ধু নেই ?

আছে আপা। কিন্তু স্কুলে শেষে ওদের আর কাউকে পাইনা। গ্রামে যখন ছিলাম তখন, যখন খুশি সবাইকে খেলার জন্য পেতাম। কিন্তু এখানে সবাইকে সব সময় পাওয়া যায় না। তাছাড়া কারও বাসাও চিনি না আমি।

আচ্ছা আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু বলে; আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন শিলা আপা। আর শোন এখন থেকে চা খেতে মন চাইলে আমাকে বলবে; আমি তোমাকে চা বানিয়ে দেব।

আমি আপার প্রস্তাবে খুব খুশি মনে রাজী হয়ে মাথা নাড়ালাম।

এরপর থেকে শিলা আপার সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। আপা প্রায়ই আমাকে এটা সেটা কিনে দিতেন। মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে রিক্সা করে ঘুরতে বের হতেন। ঢাকা শহরে এসে প্রথম চিড়িয়াখানায় যাওয়া হয় শিলা আপার সাথেই। একদিন আপা আমাকে মোহাম্মদপুর বিহারী পট্টীতে নিয়ে গেলেন চাপ-পরটা খাওয়ানোর জন্য। তারপর বেশ কয়েকবারই যাওয়া হয় সেখানে তার সাথে। চাপ-পরটা খাওয়ার পর আপা এক খিলি পান মুখে দিতেন। আমাকেও একটা দিতেন। দুজনে পান মুখে দিয়ে মুখ লাল করে আবার রিক্সা করে ফিরতাম।

আপা পান মুখে নিয়ে চিবাতে চিবাতে আমাকে একবার বললেন, বুঝলে পানের সাথে আমাদের জীবনের একটা মিল আছে। আমরা যেমন পান চিবিয়ে চিবিয়ে রস বের করে মুখ লাল করে পানের পিক ফেলি, তেমনই সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা পানের মত ঠিক এভাবেই আমাদের মত মেয়ে মানুষদেরকে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে রস বের করে দিয়ে নিজেদের মুখ লাল করে পিক করে ফেলে দেয়।

আমি সেই সময় এই কথার মর্ম বুঝতে না পারলেও; এখন বুঝি কতটা আত্মগ্লানি আর ঘৃণা ছিলো শিলা আপার সেই কথার মাঝে।

শিলা আপা যখন পান চিবাত তখন তার মুখের দিকে তাকালে মনে হতো রূপকথার কোন পরী আকাশ থেকে নেমে এসে রিক্সায় আমার পাশে বসে আছে। আমি মুগ্ধ হয়ে আপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোয় শিলা আপার গায়ের শ্যামলা রঙের সাথে মিশে অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরি হতো। আমার কিশোর মনে অদ্ভুত এক আকর্ষণ কাজ করত। সেটা অবশ্যই প্রেম নয়। কারণ শিলা আপাকে বড় বোনের মতই খুব শ্রদ্ধা করতাম। তারপরেও আপার প্রতি কেন যেন খুব টান অনুভব করতাম। মনের ভেতর অদ্ভুত একটা ভাললাগা কাজ করত।

একদিন সন্ধ্যার কাহিনী। প্রচন্ড রকম বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি মেসের করিডোরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। করিডোরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি বৃষ্টিতে কাক ভেজা ভিজে শিলা আপা কোথা থেকে যেন হেটে হেটে ফিরছেন। মেসের করিডোরটা এমন সরু ছিলো যে একজন দাঁড়ালে দ্বিতীয় কাউকে পাশ দিয়ে হেটে যেতে হলে কিছুটা কসরৎ করে যেতে হতো। আমি দাঁড়িয়ে থাকাতে শিলা আপাকেও সেই কসরৎটুকু কষ্ট করে করতে হলো। তাই আপা আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার ভেজা শরীরের স্পর্শ পেয়ে আমার পুরো শরীরে যেন তীব্র একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। এর আগেও তার পাশে গায়ে গা মিলিয়ে বসেছি বহুবার কিন্তু কখনও কোন কিছুই অনুভূত হয়নি। কিন্তু এই অনুভূতির কোন সংজ্ঞা নেই।

আমি আমার ঘরে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর আবারও ছুটে গেলাম করিডোরে বৃষ্টি দেখব বলে। মনের ভেতর বৃষ্টিতে ভেজার অদম্য একটা ইচ্ছা কাজ করতে শুরু করল। করিডোরে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি কাপড় শুঁখানোর দড়িতে শিলা আপা তার গায়ে পরনের ভেজা কাপড়গুলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন ভাবে কাপড়গুলো ছড়িয়ে দিয়েছে যার কারনে জানালাটা পুরোটাই ঢেকে গেছে। আমি একপাশ ধরে কাপড়গুলো সরিয়ে দিতেই বেগুনী রঙের লেইসের কাজ করা একটা ব্রা বের হয়ে এলো কাপড়ের ভাঁজ থেকে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছি। বাতাসের কারনে আমার মুখে বারবার ভেজা কাপড়গুলো এসে বাড়ী খাচ্ছে। বারবার আমার দৃষ্টি গিয়ে পরতে লাগল ব্রায়ের উপর। হঠাৎ কি মনে করে যেন ব্রাটা হাতে ধরে দেখতে লাগলাম।

এমন সময় আচমকা পেছন থেকে এসে শিলা আপা আমার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আপা আমার হাত ধরে টেনে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। আপার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাহসটা পর্যন্ত হচ্ছিলো না। আমি লজ্জায় মাথা নত করে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিলা আপার চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু হলো। মুহূর্তের মধ্যেই সেই চোখ পানের পিকের মতো লাল রঙ ধারন করল। এবার আপা অঝরে কাঁদতে লাগলেন। আমাদের দুজনের মুখে কোন কথা নেই। শিলা আপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আর আমি বোকার মত মাথা নত করে চুপচাপ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপা কান্না জড়ানো কণ্ঠেই আমাকে বললেন, যাও, তোমার ঘরে চলে যাও। আমি ঘরে ফিরে এসে লাইট নিভিয়ে বিছানায় একপাশ হয়ে শুয়ে পরলাম।

রাতের বেলা ভাই যখন ফিরে জানতে চাইল শরীর খারাপ কিনা ? ভাত কেন খাবো না? আমি ভাইকে শুধু বললাম, না ভাই কাল খুব সকালে স্কুলে যেতে হবে তাই আমি আগেই খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পরেছি। তুমি খেয়ে নাও।

যখন ঘুম থেকে উঠি ততক্ষণে অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। ভাইয়া সেই ভোরে উঠেই কাজে চলে গেছেন। চা খেতে খুব ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু আপার ঘরের সামনে দিয়ে রান্না ঘরে যাওয়ার মত সাহস হচ্ছিলো না। বিছানায় কিছুক্ষণ ধরে বসে রইলাম। তারপর অনেক ভেবে ধীর পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগুলাম। শিলা আপার ঘরে বড় একটা তালা ঝুলছে। বুকের ভেতর খুব কষ্ট লাগছিলো। চা বানাতে বানাতে কেঁদেই ফেললাম। এমন সময় মেসের মালিক এসে তালা খুলে শিলা আপার ঘরে ঢুকলেন। আমিও তার পেছনে ঘরে ঢুঁকে দেখি পুরো ঘর ফাঁকা। শিলা আপা খুব ভোরেই ঘরের সব মালপত্র নিয়ে মেস ছেড়ে চলে গেছেন। এখন বাড়ি ওয়ালা এসেছেন ঘরের ভেতর ইলেক্ট্রিক সুইচ আর দেয়ালের রঙ ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরখ করতে।

আমার কাছে মনে হলো খুব আপন কেউ যখন এভাবে চলে যায়, তখন দেয়ালের মতই মনের ভেতরের রঙও জায়গায় জায়গায় উঠে যায়। মনের ঘরের দেয়ালেও কোথাও কোথাও গাড়ো কালো রঙের দাগ বসে যায়। তারপর আর কোনদিন শিলা আপার সাথে আমার দেখা হয়নি। কোন যোগাযোগ হয়নি। হয়ত কোন ঠিকানা রাখা হয়নি কিংবা আমরা দুজনেই কেউ আর কারও সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি বলেই সবটাই নিছক স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।

প্রতিদিন রাতের বেলা চা খাওয়ার জন্য মোস্তফা মামার টং দোকানে এসে বসি। অফিসের কাজ শেষে বিকালে বের হয়েও বাড়ি ফিরতে যানজটের কারনে প্রতিদিনই অনেক দেরী হয়। তা প্রায় প্রতিদিনই জীবন থেকে নষ্ট হয়ে যায় তিন-চার ঘন্টা সময় শুধুমাত্র যানজটের কারণেই। এরপর বাড়ি ফিরে গোসল সেরে ভাত খেয়ে রাতের বেলা কিছুটা সময় বসি মামার দোকানে চা খেতে। চা খাওয়ার ফাঁকে মামার সাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেই। এতে করে সারাদিনের ক্লান্তি কিছুটা লাঘব হয়। এই শহরে মন খুলে কথা বলার জন্য রয়েছে একমাত্র আমার এই মোস্তফা মামাই। আমি যখন কলেজে পড়ি সেই সময়েই আমার বড় ভাই দুবাই চলে যায়। দুবাইতে তখন প্রচুর লোক নেয়া হচ্ছিলো। আমার ভাইও সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন ছিলেন। তারপর থেকে আমাকে একাই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে এই শহরে।

কিছুদিন ধরে রাতের বেলা মামার দোকানের সামনে একটা মোটর বাইকে এসে থামে। বাইকে বসে থেকেই একটা লোক; একটা মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে যায়। মামার দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটা মোটর বাইকে করে চলে যায়। তারপর মেয়েটা বাকীটা পথ হেটে হেটেই সামনের গলিতে চলে যায়। আমি এক দৃষ্টিতে মেয়েটার সেই চলার দিকে তাকিয়ে থাকি।

আজও ঠিক প্রতিদিনের মত মোস্তফা মামার টং দোকানে বসেছি চা খাওয়ার জন্য। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমাদের দেশে আজকাল অবশ্য বৃষ্টি আসে কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই। দেখা যায় প্রচন্ড রোদ; এই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শেষে রোদের তীব্রতা বাড়তে শুরু করে দেয়। রাতের বেলাতেও আবহাওয়ার একই রকম চিত্র !

যথারীতি দোকানের সামনে বাইক এসে থামল। বাইক থেকে নেমে আজকে প্রথমবারের মত মেয়েটা দোকানের ভেতর এসে দাঁড়াল। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার অবস্থা। বাইকের লোকটাকে বিদায় দিয়ে মেয়েটা মোস্তফা মামার কাছে এক কাপ কফির অর্ডার দিলো। কফি খাওয়া শেষ করে মেয়েটা যখন চলে যাচ্ছিলো পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে কি যেন ভাবল। কিছু একটা বলতে যেয়েও যেন থেমে গিয়ে আবার হাটা শুরু করল। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি মেয়েটার সেই চলার দিকে।

মামার ডাকে চৈতন্য ফিরে পেলাম। মামার কাছেই জানতে পারলাম মেয়েটা সামনের গলিতে রহমান চাচার বাড়িতে ভাঁড়া এসেছে। মাস কয়েক হলো রহমান চাচার চিলে কোঠাতে উঠেছে। এই শহরে ব্যাচেলরদের অন্য বাড়ি ভাঁড়া পাওয়া খুব কষ্টের। তাও আবার যদি কোন মেয়ে হয় তাহলে লোকে সন্দেহর চোখে দেখে। সহজে বাড়ি ভাঁড়া দিতে চায়না। কিন্তু রহমান চাচা বেশ দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। তাই মেয়েটার একাকীত্ব বিবেচনা করে ব্যাচেলর হিসেবেই মেয়েটাকে তার চিলে কোঠাটা ভাঁড়ায় দিয়েছেন। মেয়েটা নাকি কী এক এনজিওতে চাকরী করে।

মাঝ বয়সী একটা মেয়ে। মেয়ে না বলে মহিলাও বলা যেতে পারে। কিন্তু চেহারায় এখনও রূপ লাবণ্য বজায় আছে। বয়সের তুলনায় শরীরের গঠনও বেশ আকর্ষণীয়। মামা রসিকতা করে বলেন, কি মামা আপনার পক্ষ থাইকা ঘটকালী করুম কিনা খালি আওয়াজ দেন। চাকরী করেন। এইভাবে আর কতদিন নিজের ভাত নিজেই রান্না কইরা খাইবেন। এইবার বিয়া কইরা আমারে মুক্তি দেন। রাতের বেলায় ঘরে বইসা বউয়ের হাতের চা খাওয়ার একটা ব্যাবস্থা করেন। দেখবেন আমার হাতের কনডেন্স মিল্কের চায়ের চাইতে বউয়ের হাতের রঙ চাও অমৃত মনে হইব।

মামা তোমার কি মাথা নষ্ট হইছে? মহিলার বয়স আমার চেয়ে কত বেশি হবে তুমি বোঝ ?

আরে মামা রাখেন আপনার এইসব বয়স ফয়স! বয়সে কি আসে যায় ? মনের সুখই আসল সুখ। বয়সে ছোট মাইয়া বিয়া করলেই যে খুব সুখী হইবেন তার কোন গ্যারান্টি আছে ? তাছাড়া এই মেয়েটা দেখতে শুনতে এক্কেবারে খারাপ না। হুনেন মামা চাক্কুত ধার থাকলেই পোস দেওন যায়না। আর আপনিও যেমনে ফ্যাল ফ্যাল কইরা হের দিকে চাইয়া থাকেন, তাতে কইরা আমার মনে হয়; আপনে হের প্রেমে পরছেন !

ধুর মামা মজা নিওনাত! আমি মোটেই কোন প্রেমে টেমে পরিনি। আমি তাকিয়ে থাকি অন্য একটা কারণে। আমার কাছে মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগে। মেয়েটাকে দেখলে আমার এক বড় আপার কথা খুব মনে পড়ে। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় ইনিই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া শিলা আপা। তার চেহারার সাথে অবিকল একটা মিল খুঁজে পাই। সাহস হচ্ছেনা; নাহলে ডাক দিয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করতে খুব ইচ্ছা করে, ইনি কী সত্যিই আমার সেই শিলা আপা কিনা ?

তো মামা ডরের কি আছে ? একদিন ডাক দিয়া জিগায়া ফেলান। মনের ভেতর কোন রকমের সন্দেহ রাখন ঠিক না। এই যেমন ধরেন আমি যেদিন সন্দেহ করি আজকে বৃষ্টি হইব, চায়ের লিকার বেশি কইরা বসাই; কিন্তু সেইদিন বৃষ্টি না হইলে আমার কেটলি কেটলি চা লস হয়। তাই এইসব সন্দেহ না কইরা জিগায়া পরিষ্কার হওন ভাল। আর না পারলে আমারে বলেন; আমি হের নাম জিগাই।

না, না থাক মামা শুধু শুধু ঝামেলা কইরনাত। শেষে দেখা যাবে মান সন্মান নিয়ে টানাটানি লাগবে। অনেক রাত হইছে এখন বাসায় যাই। সিগারেট দাও। এর মধ্যে বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে আর রাতের জন্য কয়েকটা সিগারেট নিয়ে বাসায় চলে এলাম।

সারারাত ধরে কিছুতেই ঘুম আসছেনা। চোখ বন্ধ করলেই শিলা আপার মুখ ভেসে উঠছে। দোকানে যাকে দেখি, কে এই মেয়ে ? একবার কথা বলে কি মনের সন্দেহটা দূর করে নিব ? অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধ্যান্ত নিলাম ভোর বেলাতেই মেয়েটার বাসায় যেয়ে মনের সব সন্দেহ দূর করে নেব। তাছাড়া অফিসেও যেতে হবে। অফিস থেকে ফিরতে সেই রাত হবে। আর মেয়েটাও অনেক রাত করে ফিরে। এত রাতে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হবেনা।

দরজাটা ভেতর থেকে খোলাই ছিলো। দরজায় হালকা করে টোকা দিতেই ভেতর থেকে মেয়েটা আওয়াজ দিলো, কে ?

বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠল ! কি পরিচয় দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

দরজার সামনে মেয়েটি এসে দাঁড়াল।

জী, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি এই এলাকাতেই থাকি। আপনাদের সামনের গলির শেষ মাথায় যে চারতলা বাড়িটি; আমি ওখানেই ভাঁড়া থাকি।

ও আচ্ছা ! কিন্তু আমার কাছে কেন এসেছেন ? আপনাকে কি ইদ্রিস ভাই পাঠিয়েছেন ?

জী, জী আমাকে ইদ্রিস ভাই পাঠিয়েছেন। এই মিথ্যাটুকু আমাকে অকপটে বলতে হলো। আসলে এ ছাড়া আর কোন অজুহাত পেলাম না। মেয়েটা যখন নিজ থেকেই একটা পথ দেখিয়ে দিল তখন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম আর কি।

আসুন ভেতরে আসুন। কিন্তু আপনারত দুপুরে আসার কথা ছিলো।

জী, কিন্তু ভাবলাম ভোরেই আসি। আপনার কোন আপত্তি থাকলে না হয় এখন চলে যাই।

না, না আমার আবার আপত্তি কিসের।

জী !

না, কিছু না। বসুন। আপনাকে কিন্তু আমি রোজই দেখি বসে থাকেন মোড়ের টং দোকানটায়। অথচ আশ্চর্য দেখুন ইদ্রিস ভাই সেই আপনাকেই আজকে পাঠিয়েছেন।

জী।

কফি খাবেন?

আমিত আসলে কফি খাই না। এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। তাছাড়া এখনত আর বৃষ্টিও হচ্ছেনা।

সরি ! চাত দিতে পারছিনা। কফি খান ? খুব বেশি যদি সমস্যা মনে না করেন। আমার হাতের এক কাপ কফি খেয়েই দেখুন। আর কখনও চা খেতে চাইবেন না। সব সময় শুধু আমার হাতের এক কাপ কফির প্রতি আপনার মন পড়ে রইবে।

আচ্ছা দিন তাহলে এক কাপ কফিই খাই।

জানেন আমার এক আপা ছিলেন; আমাকে ঠিক এভাবে আপনার মত করেই চা বানিয়ে খাওয়াতেন। আমি আজও পর্যন্ত আপার হাতের সেই এক কাপ চা খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকি।

এখন কোথায় আপনার আপা ?

জানি না। তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কিছুই জানিনা।

কেন ?

এটা আমার দুর্ভাগ্য কিংবা আমার অপরাধের এক রকমের শাস্তি বলতে পারেন। থাক বাদ দিন সেসব কথা। এই যে দেখুন আপনার নামটাই কিন্তু জানা হলো না?

কেন ইদ্রিস ভাই আপনাকে আমার ঠিকানা দিয়েছে কিন্তু নাম বলে দেয়নি?

জী, না মানে বলেছিলেন; দুঃখিত কিন্তু আমিই ভুলে গেছি।

আমার নাম জেনে কি করবেন ? যে জন্য এসেছেন তাতে আমার নাম জানাটা খুব বেশি কী জরুরী কিছু ?

জী !

মেয়েটা আমার গা ঘেঁষে বসে তার একটা হাত রাখল আমার উরুর উপর।

আমি এক লাফ দিয়ে উঠে পরলাম। আরে, আরে কি করছেন ?

বুঝেছি; এই প্রথম না ? লজ্জা পাচ্ছেন ? বলেই মেয়েটা হেসে উঠল।

আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে মেয়েটার ঘর থেকে দ্রুত বেড়িয়ে এলাম। রাস্তায় নেমে একটা সিগারেট ধরালাম।

রাতের বেলা মোস্তফা মামার দোকানে বসে আছি। এই লন মামা আপনার চা। মামার কি মনডা খারাপ ?

কই নাত !

তাইলে এমন মুখ শুকনা কইরা আছেন যে ?

কিছুনা মামা। এই অফিসের কত ঝামেলা থাকেনা; সেইসব নিয়েই একটু ভাবছিলাম আরকী! মামা আজকে আর চা খাব না। আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দাও।

মামা আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।

আমার জন্য দুঃসংবাদ ?

হ, মামা। ওই মেয়েত আজকে চইলা গেছে।

আমি ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলাম, মানে ?

আরে মামা ঐযে ওই মেয়েটা আছেনা; যে রোজ রাতে আমার দোকানের সামনে হোন্ডায় কইরা আইসা নামে। উনি আজকে বিকাল বেলায় উনার ঘরের সব মালপত্র নিয়া একটা ভ্যানে কইরা চইলা গেছে।

মুহূর্তের মধ্যে আমার সব চিন্তাশক্তি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মামার কোন কথাই আর আমার কানে আসছে না। আমার চারদিকটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিছুতেই চোখের পানি আর আঁটকে রাখতে পারলাম না। আমার শুধুই শিলা আপার কথা মনে হতে থাকল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১:৪০
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×