somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

A Short Film About Killing 1988 - Krzysztof Kieslowski

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি এর আগের লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম যে, ১৯৯০-এর কোলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দুটো ছবি সবচে’ বেশি প্রশংসিত হয়, তার মধ্যে একটি ছিল ’থিও অ্যাঞ্জিওপুলাস’-এর ’ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ ছবিটি, এবং অন্যটি ’ক্রিস্তফ কিওলস্কির’ ’আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’, এবং দুটো ছবি সম্পর্কেই ছিল জনাব সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। সত্যি বলতে, দুটো ছবিই আমি দেখেছি ওনার প্রশংসার উচ্ছ্বাস দেখে এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি, ’বার্গম্যানের’ পর দ্বিতীয়বার কোন পরিচালকের শুধুমাত্র একটি ছবি দেখে তার সবগুলো ছবি সংগ্রহ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই, ’ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ ও ’আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’, দুটো ছবিই মুক্তি পায় একই বছরে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে, এবং দুটো ছবিই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবে অর্জন করে নেয় একাধিক পুরস্কার। যদিও নির্মাণশৈলীর দিক থেকে প্রথম ছবিটির জন্যই আমার পক্ষপাত বেশি, কিন্তু গতানুগতিক ধারার বাইরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের ছবি সম্পর্কে বলতে বললে, আমি নিঃসঙ্কোচে দ্বিতীয় ছবিটির কথাই বলব।

১৯৮৮সালের অক্টোবরে মুক্তি পাওয়া ১ ঘন্টা ২৪ মিনিটের এই পোলিশ ছবিতে নির্মাণশৈলীর তেমন কোন অভূতপূর্ব নিদর্শন চোখে না পড়লেও, নিজে একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই, এমন ব্যতিক্রমী চিত্রনাট্যের ছবি আমি এর আগে দেখিনি। বিশেষ করে চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচে’ দীর্ঘ সময় ধরে দেখানো একটা হত্যাকান্ডের নির্মমতা দেখে যেমন শিউরে উঠেছি, তেমনি হত্যকান্ডের শেষে এসে হয়েছি বিমূঢ়। শুধু যে তাই, তাও নয়, হয়ত এটিই একমাত্র ছবি, যেটা দেখে হত্যাকারীর প্রতি দর্শকের তেমন কোন ঘৃণা তৈরী হয়না, বরং ছবির শেষে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করলে সেটা যেন তাদের কাছে অনেক বেশি নির্মম মনে হয়। এটাই আমার কাছে ছবির সবচে’ উল্লেখযোগ্য দিক, যে আমি হত্যাকারীকে শেষ পর্যন্ত পারছি না ঘৃণা করতে, বরং তার জন্য একটা মায়া তৈরী হচ্ছে আপনা-আপনি, এবং শেষ পর্যন্ত ভুলে যেতে বাধ্য হচ্ছি, এ সেই যুবক যে একজন অপরিচিত ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কোন কারণ ছাড়াই নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

ছবি শুরু হয়, একটা প্লেটে কয়েকটা মরা আরশোলা, জলে ডুবে থাকা মৃত ইঁদুর, আর গলায় ফাঁস-লাগানো ঝুলতে থাকা বেড়াল। এরপর এক বালতি জলসহ এক ব্যক্তির ঘর থেকে বেরিয়ে আসা, এবং ঠিক তার পরপরই দেখতে পাই, রাস্তার ধারে রাখা ডিসপ্লের কাচে ’জ্যাক’ নামে ২০ বছর বয়সী একটি যুবকের মুখ, যাকে দেখে একাধারে দুঃখী, শান্ত ও খাপছাড়া মনে হয়। সে সারা শহর উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু, কারো সাথেই তাকে পরিচিতির আলাপে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় না। জ্যাকের এই উদ্ভ্রান্ত ঘুরে-বেড়ানোর সাথে সাথে আমার এও দেখতে পাই, পিটার নামের আদর্শবাদী একজন নতুন আইনজীবিকে, যে কিনা ইন্টারভিউ বোর্ডে পরীক্ষকের করা নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, এবং সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও, যে সারাদিন গাড়িতে যাত্রী না নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়।

কিওলস্কির ছবির এই একটা দিক আমাকে বিস্মিত করে, যে শুধুমাত্র তিনজন চরিত্র নিয়েও এমন চমৎকার ছবি বানানো যায়। কিন্তু যখন ওনার ’এ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ’ দেখি, তখন শুধু তিন চরিত্রই নয়, বরং ছোট্ট একটা পরিসরেও যে এমন অনবদ্য চলচ্চিত্র তৈরি করা যেতে পারে, বিশ্বাস করতে বাধ্য হই। যা হোক একসময় জ্যাক উক্ত ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে, এবং ড্রাইভারকে শহর ছেড়ে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে যাবার পথে, পেছন থেকে গলায় দড়ি বেঁধে তাকে হত্যা করতে শুরু করে। ছবিতে দুটো হত্যা দৃশ্য দেখানো হয়, যার প্রথমটি হল এটি। দীর্ঘ সাতমিনিট ধরে দেখানো চলচ্চিত্র-ইতিহাসের এই দীর্ঘতম হত্যাদৃশ্য দেখতে দেখতে আমি যে প্রচন্ড শিউরে উঠেছি তা নয়, বরং হত্যাকালীন হত্যাকারীর শান্ত মুখ ও নির্মমতা আমাকে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে নিক্ষেপ করে, এবং সেই ঘোরটা আচমকা কেটে যায়, যখন হত্যা সম্পন্ন হয়েছে মনে করে জ্যাক, ট্যাক্সি-ড্রাইভারটিকে জলে ফেলার জন্য টেনে আনতে গিয়ে দেখে, যে এখনও সে মরেনি। তখন কিছু দিয়ে তাকে পুনরায় আঘাত করার জন্য আশেপাশে কিছু খুঁজতে খুঁজতে একটা বড় পাথরখন্ড পেয়ে সেটা নিয়ে এসে তার বুকের উপরে বসে মাথায় আঘাত করার মুহূর্তে, যে ক্ষোভ ও আক্রোশে কেঁদে উঠে পাথর দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে, মূলতঃ জ্যাকের সেই কান্না আমাকে তার প্রাপ্য ঘৃণা থেকে সরিয়ে এনে, অন্য কোন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, আর সেই প্রশ্নের উত্তর পাই ছবির শেষে, যেখানে জ্যাকের ফাঁসি কার্যকর হবার পূর্বে পিটার নামক সেই আদর্শবাদী আইনজীবি, যে চেষ্টা করেছিল তাকে সম্ভাব্য মৃত্যু থেকে বাঁচাতে, তার সাথে কথোপকথনে।

সেখানে সে জানিয়েছিল তার জীবনের মর্মান্তিক এক ঘটনার কথা, কীভাবে তার ছোট বোন গাড়িচাপা পড়ে মারা যায়, যাকে সে সবচে’ বেশি ভালবাসত। যা সে ভুলতে পারেনি কখনও, এবং একটা গোপন যন্ত্রণার ভার বয়ে বেড়িয়েছে এতবছর। শুধু যে তাই, তাও নয়, বরং সে এও বলেছিল, সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর শুধুমাত্র তখন সে বাস্তবে ফিরে আসে, যখন ফাঁসির রায় ঘোষণার পর তাকে ভ্যানে তোলা হচ্ছিল এবং উপর থেকে পিটার তাকে উচ্চস্বরে ডেকেছিল ’জ্যাক’ বলে। জ্যাক তার শেষ ইচ্ছেটাও জানিয়েছিল পিটারকে, যেন তাকে কবর দেয়া হয় তার বাবা ও বোনের পাশে। পিটারের সাথে কথোপকথন শেষে তাকে ফাঁসি দেয়ার জন্য নিয়ে আসা হয়, এবং পাঁচ মিনিট ধরে দেখানো পরের এই ফাঁসিদৃশ্য, পূর্বের সাতমিনিটের হত্যাদৃশ্যর নির্মমতাকেও ছাপিয়ে গেছে। প্রথম হত্যাদৃশ্যটি সংঘটিত হয়েছিল ট্যাক্সির পেছনে, আর পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রকর্তৃক পরবর্তী হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় আমাদের নাকের ডগায়।

যদিও ছবির নাম শুনেই অনুমান করে নেয়া যায় ছবিটির বিষয়বস্তু কী, কিন্তু ছবিটি না দেখলে কিছুতেই বোঝা যাবেনা, একটা পুরো ছবি কীভাবে একটা হত্যাকান্ডের অসামান্য প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। ছবিতে আলোর প্রয়োগ, বিশেষত পুরো ছবি জুড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব, চিত্রায়ণ, শব্দ, পটভূমি, সব কিছু মিলিয়ে কিওলস্কি একটা অস্বাভাবিক হত্যাদৃশ্য দেখার চরম অভিজ্ঞতায় নিয়ে গেছেন দর্শকদের, যেটা শেষ হয় হত্যাকারীকে হত্যার মাধ্যমে, ঝুলন্ত লাশের পা থেকে প্লাস্টিকের পাত্রে তরল মলের চুঁইয়ে পড়ার টপ টপ শব্দে। দীর্ঘ ৮৪ মিনিটের স্তব্ধতা কাটিয়ে আমি কিওলস্কির নিজস্ব মন্তব্য আরেকবার ভাবি, "It's wrong no matter why you kill, no matter whom you kill and no matter who does the killing... Inflicting death is probably the highest form of violence imaginable; capital punishment is an infliction of death", আর এও ভাবি মৃত্যুপূর্ব পিটারের সাথে কথোপকথনে জ্যাকের বলা শেষ বাক্য, ”যদি সেই মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটত, সম্ভবত আমি এখানে আসতাম না।’’


সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:৫৩
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয় দিবসের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়ে । সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ২০২৫, ১৬ই ডিসেম্বর।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১৯




দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রানের এক সাগর রক্তের বিনিময়। দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম হারানো। লক্ষ শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত‍্যু। এক কোটি মানুষের বাস্তুহারা জিবন। লক্ষ কোটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×