আমার দুর্ভাগ্য যে আমি ’কার্লোস সাওরার’ তিনটির বেশি ছবি দেখতে পারিনি, আর সৌভাগ্য এই, ’ট্যাংগো’ ছবিটা আমার সংগ্রহে আছে, এবং সেটা কয়েকবার দেখেছি। আমার এরকম আফসোস এর আগে শুধুমাত্র একবারই হয়েছিল, ’আলেকজান্ডার পেত্রোভিক’-এর ’স্কাপলজাসি পেরজা’ দেখার পর, ওনার দ্বিতীয় কোন ছবি সংগ্রহ করতে না পারায়। সত্যি বলতে কি, জীবনে প্রথমবার ছবি নিয়ে লিখতে আমি বাধ্য হই ’স্কাপলজাসি পেরজা’ ছবিটি দেখার পরই। আপনারা হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন, আমার প্রায় সব লেখাতেই ছবি নিয়ে একটা উচ্ছ্বসিত ভাব প্রকট হয়ে পড়ে, ফলে আপনাদের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে, আমার দেখা সবগুলো ছবিই কি উৎকৃষ্ট? অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের ছবি কি আমি দেখি না? অবশ্যই দেখি, তবে যখন আমি শুধুমাত্র নিজের গরজেই লিখছি, তখন ছবি দেখা বা লেখা বিষয়ে আমার নিজস্ব পছন্দকেই গুরুত্ব দিই, এবং যে ছবি দেখার পর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হই, কেবলমাত্র সেই ছবি নিয়েই লিখতে বসি। যেমনটি হয়েছিল, ’স্কাপলজাসি পেরজা’ দেখার পর।
স্প্যানিশ পরিচালক কার্লোস সাওরা ইতিমধ্যেই স্বল্প ও পূর্ণ-দৈর্ঘ্য মিলিয়ে চল্লিশটির উপর ছবি পরিচালনা করেছেন, এবং গোল্ডেন পাম্, বাফটাসহ আশিটির উপরে বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন, যার মধ্যে ২০০৭-এ পর্তুগীজের ফ্যাদো সংগীতের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ”ফ্যাদোস” ছবিটি ছিল বহুল আলোচিত। যদিও পুরো ছবিটি এখনও আমি দেখে উঠতে পারিনি, কারণ ইন্টারনেটে তন্ন্ তন্ন করে খুঁজেও এর ইংরেজি সাবটাইটেল পাইনি । তারপরও অংশত দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম, এবং সেই মুগ্ধতা অক্ষুন্ন ছিল ’ট্যাংগো’ দেখার পরেও, কিংবা বলা যায় বেড়ে গেছে।
’ট্যাংগো’ মূলতঃ একটি সিম্বলিক ডিটেলের ছবি, যেখানে যা কিছু দেখাতে বা বলতে চাওয়া হয়েছে তার সব কিছুই নাচের মাধ্যমে, এবং কোনরূপ আউটডোর শুটিং ছাড়াই, শুধুমাত্র ইনডোর সেটেও যে এত চমৎকার ছবি বানানো যায়, বিশ্বাস হয় না। ছবিটির যে বিষয়ে দর্শক মুগ্ধ না হয়ে পারেনা, তা হল রঙ-এর ব্যবহার। নাচের সাথে সাথে ব্যবহৃত বর্ণিল ও উজ্জ্বল রঙ এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে ছবিটিতে। আমার দেখা এটিই প্রথম ছবি, যেখানে কড়া রংয়ের এত বিপুল ও বৈচিত্র্যময় ব্যবহার করা হয়েছে। ওনার ’ফ্যাদোস’ ও ’গোইয়া’-তেও অনুরূপ রঙ-এর ব্যবহার দেখা যায়। ছবিতে রঙ-এর ব্যবহার নিয়ে সত্যজিত রায়ের সুচিন্তিত মতামত পড়ে, এবং কার্লোস সাওরার ট্যাংগো দেখার পর মানতে বাধ্য হয়েছি যে, রঙ-ও হয়ে উঠতে পারে চলচ্চিত্রের অনবদ্য একটি ভাষা, যদি তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৮সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১১৫মিনিটের এই ছবিটি শুরু হয় ’মারিও’ নামের একজন চিত্রপরিচালককে দিয়ে, যে টেবিলে বসে তার চিত্রনাট্যের পাতা ওল্টাচ্ছে, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে চমৎকার একটি ব্রাজিলিয়ান গান। এরপর ইনডোর সেটে দেখা যায় একজোড়া নারী-পুরুষের চমৎকার নাচের দৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মুখোমুখি হই নাটকীয়তার, চলতে থাকা নাচের পেছনে ব্যবহৃত সাদা স্ক্রিনে দেখতে পাই কারও ছায়া। ছায়াটি পেছন থেকে সামনে আসে, এবং নৃত্যরত নারী-পুরুষকে খুব কাছ থেকে দেখতে থাকে। একসময় তার চোখে-মুখে আক্রোশ ফুটে ওঠে, এবং ছুরি দিয়ে নৃত্যরত নারীটিকে একের পর এক আঘাত করে খুন করে।
আসলে এটা ছিল মারিওর স্মৃতিচারণ, যার মধ্যে প্রেম ও প্রতিহিংসা নাচের মাধ্যমে দৃশ্যায়িত হয়েছে। ছবিতে মারিও একজন পরিচালক, যে ’ট্যাংগো’ নামে একটি ছবি বানাতে চায়, যেখানে তুলে ধরা হবে আজেন্টিনার রাজনৈতিক ইতিহাসের কালো একটা অধ্যায়। যদিও ছবিতে আমরা ছবি বানানো নিয়ে পরিচালকের নানাবিধ চিন্তা-ভাবনা, ছেড়ে যাওয়া স্ত্রীর প্রতি তার ভালবাসা, অসমবয়সী নতুন প্রেম, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি দেখতে পাই, কিন্তু ছবিটির মূল বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে, নাচের মত একটা শিল্পের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার মিলিটারি অত্যাচারের একটা বাস্তবিক রূপরেখা তুলে ধরা।
ট্যাংগো মূলত এমন একটি ছবি, যেখানে একাধারে প্রেম, প্রতারণা, প্রতিশোধ, নাচ, সঙ্গীত, সৃষ্টিশীলতা, এরকম অনেককিছুর মিশেল থাকলেও, ছবিটির মূল থিম থেকে আমরা কখনোই সরে যেতে পারিনা। বিশেষ কোন ক্লাইম্যাক্স ও নাটকীয়তা ছাড়াই পুরো ছবি এগুতে থাকে শুধুমাত্র ট্যাংগো নাচের বিভিন্ন কলাকৌশল, অনুশীলন ও সঙ্গীত নিয়ে নানারকম দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। পুরো ছবি জুড়েই আমরা দেখতে পাই ট্যাংগো নাচের চমৎকার প্রদর্শন, এবং তাকে নিয়ে চিত্র ও নৃত্যপরিচালকের নানারূপ ভাবনা ও সম্পূর্ণ নতুন কিছু দর্শকের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। এক্ষেত্রে নাচের ব্যাকগ্রাউন্ডে স্লাইড হিসেবে ’গোইয়ার’ আঁকা পেন্টিংস ব্যবহারের ভাবনা আমার কাছে ছবির উল্লেখযোগ্য একটা দিক ব’লে মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে কার্লোস সাওরার ’ট্যাংগো’ উপভোগ্য একটি ছবি। যদিও বর্ণিল ও উগ্র রঙ-এ যারা অভ্যস্ত নয়, তাদের কাছে ছবিটি ততটা আকর্ষণীয় নাও মনে হতে পারে, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে ট্যাংগো নাচ নিয়ে এত চমৎকার ডিটেলের ছবি খুব কম পেয়েছে বিশ্ব চলচ্চিত্র।
আলোচিত ব্লগ
রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা
বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।