somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Three Monkeys 2008 - Nuri Bilge Ceylan

২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তুর্কি চলচ্চিত্রের সাথে আমার পরিচয় ঘটে বছরখানেক আগে, ইলমাজ গুনের ’ইয়োল’ ছবিটির মাধ্যমে। তার আগে তুর্কির কোন ছবি দেখেছি বলে মনে পড়েনা। মূলতঃ ইয়োল দেখার পরই, তুর্কি চলচ্চিত্রের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ তৈরী হয়, এবং চেষ্টা করতে থাকি তাদের সমসায়িক কাজগুলো সংগ্রহ করতে। ফলস্বরুপ, গত সপ্তাহে একসাথে পেয়ে যাই বেশ কয়েকটা তুর্কি ছবি, এবং প্রত্যাশাকে বহুগুণ ছাড়িয়ে আমার পরিচয় হয়ে গেল এমন একজন পরিচালকের সাথে, যিনি কেবল আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতই নন, বরং ভালমানের ছবি বানানোর জন্য ইউরোপিয়ান জুরি এ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন অরেঞ্জ, গোল্ডেন বার্লিন বিয়ার, গোল্ডেন পাম, কানস ফিল্ম ফেস্টিভাল ইত্যাদি সহ জিতে নিয়েছেন চল্লিশটির মত পুরস্কার। ১৯৫৯ সালে তুর্কির ইস্তাবুলে জন্মগ্রহন করা ’নুরী বিলগ্ ছেলান’ নামে সেই পরিচালকের আলোচ্য ছবিটি দেখার পর মনে হয়েছে, যে কেউ-ই এই একটিমাত্র ছবি দেখেই ওনার ভক্ত হয়ে যেতে পারে।

ছবিটি দেখা শেষ হওয়ার পরপরই আমার ইচ্ছে হয়েছিল সেটি নিয়ে লিখতে। বিশেষ করে ছবির শেষে এসে এতটাই মগ্ন হয়েছিলাম যে, ছবি শেষ হয়ে যাবার পরও বুঝতে পারিনি, শেষ হয়ে গেছে। হয়ত ছবিটির প্রথম অর্ধাংশের চেয়ে, দ্বিতীয় অর্ধাংশের মানসিক দ্বন্দ্ব ও নাটকীয়তার চমৎকার পরিবেশন এজন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যেখানে পরিচালক দর্শকদের সম্ভাব্যকে অনুমান করতে বাধ্য করছেন, কিন্তু প্রতিবারই সেটা না ঘটে, ঘটছে অন্য। ফলে দর্শকদের মধ্যে সামনে এগিয়ে যাবার আগ্রহ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে, আর তা এমন এক জায়গায় এসে থেমে যায়, যেখান তারা মগ্নতার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনা চট করে।

২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ’থ্রি মাংকিস্’ নামে ১০৯ মিনিটের এই ছবিটি দেখার সময় আমার বার বার মনে হয়েছে কিওলস্কির কথা। বিশেষ করে এর পরিচালনা ও চিত্রনাট্যের বিন্যাস, যেখানে অপ্রয়োজনীয় ডিটেলস্গুলো খুব চমৎকারভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চিত্রনাট্য থেকে এই যে মেদবহুল অংশ বাদ দেয়া, এটা সবচে’ ভাল করতে দেখেছি কিওলস্কিকে, আর দেখলাম ছেলানকে। যেমন, ছবির শুরুর দুর্ঘটনা, যেটাকে কেন্দ্র করেই কাহিনীর বিস্তার, সেটার আগে বা পরে কিছুই না দেখিয়ে, শুধু দেখানো হয় রাস্তার উপর থেমে থাকা গাড়ি ও একটি লাশ। কিংবা, মধ্যরাতে ঘরের দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনার পর আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেদের আবিষ্কার করি পুলিশ স্টেশনে। এমনকি, ছবির একমাত্র শিশু চরিত্রের উপস্থিতি টের পেলেও, তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনা, শুধু এটুকু ছাড়া, যে সে মৃত। কয়েকদিন ধরে ’ওয়াং কার ওয়াই’-এর কিছু ছবি দেখছিলাম, এবং সত্যি বলতে ওনার স¤প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ২০৪৬ দেখতে দেখতে প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম চিত্রনাট্যের কারণে। যদিও পরে ’ইন দ্য মুড ফর লাভ’ দেখে ভাল লেগেছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত ওয়াং কার ওয়াই-এর ক্যামেরার কাজ ও রঙ-এর ব্যবহার ছাড়া অন্য কিছু আমার মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ’নুরী বিলগ্ ছেলানের’ এই ছবিটি দেখার পর সেটি পুনরায় দেখার একটা প্রবল ইচ্ছে আপনা-আপনিই জেগেছে। বিশেষ করে ওনার চিত্রনাট্যর বিন্যাস, শট নেয়ার কৌশল, ক্যামেরার কাজ, আলোর ব্যবহার যে কোন সচেতন চলচ্চিপ্রেমিকেই শুধু যে মুগ্ধ করবে তা নয়, বরং শ্লথ গতির এই ছবির সাথে একবার একাত্ন হতে পারলে, তারা বাধ্য হবে স্ক্রিনের সামনে অনড় বসে থাকতে। পুরো ছবি জুড়েই রয়েছে পরিচালনায় স্বকীয়তার ছাপ, বিশেষত ছবিতে ব্যবহৃত ধূসর রংয়ের চমৎকার ব্যবহার একে অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে। এছাড়াও ছবির শেষে ক্লোজ শটে দেখানো ইয়ূপের মুখসহ লং শটে যে দৃশ্যের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি, সেখানে বলতে বাধ্য হই, ক্যামেরার এত মেধাবী কাজ অনেকদিন দেখিনি। ক্লোজ শটে মানুষের অবয়ব নিয়ে আমার দেখা সেরা কাজ বার্গম্যানের, আর এতদিন পর সেই একিরকম শটে তারচেয়েও অনবদ্য একটি কাজ দেখে রীতিমত বিস্মিত। হয়ত সেখানে ইয়ূপের ভুমিকাটাই ছিল মুখ্য, যেখানে তার মুখ ও মুখের রেখাগুলো এমনভাবে সে ফুটিয়ে তুলেছিল যে, অমন ক্লোজ শট ও অবয়ব একবার দেখলে, ভোলা যায়না সহজে। সত্যি বলতে এই রিভিউটা লেখার কথা মাথায় আসে সেই ক্লোজ শট, এবং তারপরই দু’মিনিট ধরে দেখানো অপূর্ব একটি লং শট দেখে। শটটা আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, ছবি শেষ হয়ে যাবার পরও বুঝতে পারিনি। পুরো দু’মিনিট আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম স্ক্রিনের দিকে, চোখের সামনে ভেসে আছে কালো মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশ, সাগরের পাড়, কয়েকটা লঞ্চ, আর একটা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লোজশটে দেখানো মানুষ, যে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে, আর সমস্ত চরাচর জুড়ে ছেয়ে থাকা অন্যরকম নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে ট্রেনের চলে যাওয়া, মেঘের গর্জে ওঠা ও বৃষ্টির শব্দ। দু’মিনিটের এই দৃশ্য দেখার পর অনেকের মনে হবে, যেন তারা ছবি নয়, বরং বিশাল একটা ল্যান্ডস্কেপের সামনে দাঁড়িয়ে।

আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাল কাজগুলোর এই দিকটা আমার খুব ভাল লাগে যে, সেখানে বিনোদনই মুখ্য নয়, বরং সেই সঙ্গে থাকে শিল্পবোধের এমন এক সমন্বয়, যেখানে দর্শক বিনোদনের পাশাপাশি শিল্পের সাথেও একাত্ন হয়ে যায়। যেমন এই ছবিতে ইয়ূপের মৃত সন্তানের উপস্থিতি যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেখানে দর্শক চিত্রনাট্যর সাথে সেটার কোন সঙ্গতি খুঁজে না পেলেও, হতাশায় ভুগতে থাকা এক যুবকের মধ্যাহ্নকালীন চিন্তায় উঠে আসা মৃত ভাইয়ের স্মৃতিকে ছেলান যেভাবে তুলে এনেছেন, সেখানে অন্তত তারা অনুভব করতে পারে অন্যরকম সে বোধের, যা কেবল ঐরকম ভাবনার মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে। এছাড়াও ইয়ূপ, তার স্ত্রী ও মালিকের গোপন সম্পর্কের কথা জানার পর যখন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে, তখন পিছন থেকে একটা শিশুহাত তার গলা বেয়ে গালের দিকে এগিয়ে আসে, এবং একসময় বিছানা ছেড়ে চলে যায়, তখনও তারা অনুরূপ বোধের সাথে একাত্ন হতে পারে।

খুব সাধারণ ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো এই ছবিকে, শুধুমাত্র পরিচালনার গুণে ছেলান এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে, দর্শক বাধ্য হয়ে পড়ে ১০৯ মিনিট স্ক্রিনের সামনে বসে থাকতে। ছবির শুরুটাও বেশ চমৎকার, লং শটে ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় শুধুমাত্র হেডলাইটের আলোয় একটা গাড়ির চলে যাওয়া যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তাতে প্রথমেই আভাস পাওয়া যায় ছবিটির গুণগত মান সম্পর্কে। যদিও এরপর একজন রাজনীতিবিদের গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে মারা, তা থেকে বাঁচতে ইয়ূপকে প্রলোভন দেখিয়ে দুর্ঘটনার দায়ভার নিয়ে জেলে যেতে বলা, এবং ঘটনাক্রমে তার স্ত্রী হাছেরের সাথে সেই রাজনীতিবিদের অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি থেকে খুব সাধারণ ঘটনার আভাস পাওয়া গেলেও, ছেলে ইসমাইল, মা ও বাবার মালিককে বন্ধঘরে অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখে ফেলার পর থেকেই ছবিটি এমন কিছু নাটকীয়তা, মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় যে, পূর্বের সাধারণ ঘটনাবলী একসময় ভুলে যেতে শুরু করি, এবং ক্রমশঃ সামনে এগিয়ে যেতে যেতে, যেখানে দাঁড়াই সেখানে চোখের সামনে ভেসে থাকে সেই বিশাল ল্যান্ডস্কেপ, যা ছবিটির না বলা কথাগুলো ব্যক্ত করতে থাকে, ছবি শেষ হয়ে যাবার পরেও।

পরিশেষে বলতে চাই, শুধুমাত্র হালকা বিনোদনের জন্য যারা এই ছবিটি দেখতে যাবেন, তারা কেবল হতাশই হবেননা, বরং বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসবেন। আর যারা সত্যিকারের চলচ্চিত্রপ্রেমি, এবং মনোযোগ ও ধৈর্য্যের সাথে চলচ্চিত্রের ভাল কাজগুলো দেখে থাকেন, তারা এই ছবিটি একবার নয়, বার বার দেখবেন। ছেলানের প্রতিটি ছবিতেই রঙ, শব্দের ব্যবহার, ক্যামেরার কাজ, বিভিন্ন রকমের টিপিক্যাল শট, চিত্রনাট্যের বিন্যাস সবগুলো বিষয় এতটাই স্বকীয় যে, তা তরুণ পরিচালকদের জন্য অনিবার্যভাবে হয়ে ওঠে প্রথম পাঠ, আর চলচ্চিত্রপ্রেমিদের জন্য প্রথম পছন্দের।

৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×