somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Nights of Cabiria 1957 - Federico Fellini

০১ লা জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবি নিয়ে লেখার সময় আমার এই মনোভাব প্রায় সময় কাজ যায় যে, আমি যে ছবিটা নিয়ে লিখছি তার কোন বিশেষ দিকটা আমাকে সবচে’ বেশি আকৃষ্ট করেছে। যে কোনো ছবি নিয়ে লেখার আগে আমি সেটা কয়েকবার দেখি আর তার প্রতিটি অংশ, যেমন ক্যামেরার কাজ থেকে শুরু করে, আলোর ব্যবহার, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সঙ্গীত, অভিনয় প্রায় সব বিষয়েই মনোযোগী হতে চেষ্টা করি। অথচ ফেডরিকো ফেলিনির ছবি দেখার সময় আমি প্রায় সময়ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি, কারণ আমি পারি না একটানা আমার মনোযোগ ওনার ছবি দেখার সময় ধরে রাখতে। আমাকে থামতে হয়, সময় নিতে হয়, তারপর আবার শুরু করি। বিশ্ব চলচ্চিত্রে যে কয়েকজন পরিচালক সবসময় দর্শকদের গ্রহণক্ষমতার বিপরীতে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান, ফেলিনি অবশ্যই তাদের অন্যতম আর আমি এখনও পর্যন্ত একবারও চেষ্টা করিনি তার কোন ছবি নিয়ে লিখতে। অথচ এই ছবিটা নিয়ে লিখতে বাধ্য হলাম কেবলমাত্র ’জুলিয়েত্তা মাসিনার’ অভিনয়ের জন্য। ছোট-খাট, হালকা-পাতলা গড়নের এই নারী স্ক্রিনে আমার দেখা সবচে’ ব্যতিক্রমী পারফর্মার, বিশেষ করে শিশুতোষ ভাব-ভঙ্গীর যে প্রকাশ অভিনয়ের সময় তিনি চোখে-মুখে ফুটিয়ে তোলেন, তেমনটা আর কাউকেই দেখিনি। যারা ’লা স্ত্রাদা’ দেখেছেন, তারা হয়ত আমার সাথে একমত হবেন এবং স্বীকার না করে পারবেন না ’জেলসোমিনা’ চরিত্রে করা ওনার অনবদ্য অভিনয়ের কথা। খুব কম অভিনেতা বা অভিনেত্রী তাদের অভিনয় জীবনে এমন স্মরণীয় চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দু’বার পান। অথচ ১৯৫৪ সালে ’লা স্ত্রাদায়’ অমন অনবদ্য অভিনয় করার পর, ১৯৫৭ সালে তিনি পুনরায় আমাদের উপহার দিলেন নাইটস্ অব ক্যাবিরিয়ার ’ক্যাবিরিয়া’-র মত আরেকটি স্মরণীয় চরিত্র।

ফেলিনি ও তার ছবি নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, কারণ ওনাকে নিয়ে অজস্র লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা এরই মধ্যে হয়ে গেছে। তাই আমি ফেলিনি বা তার চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কিছু না বলে, বলতে চাইছি জুলিয়েত্তা মাসিনার অভিনয় শৈলীর কথা আর সেজন্যই আজ এই ছবিটা নিয়ে লিখতে বসা। যদিও ইচ্ছে ছিল ’লা স্ত্রাদা’ নিয়ে লেখার, কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মাসিনা নিজেও হয়ত বিশ্বাস করে থাকবেন যে, ’জেলসোমিনাই’ হল ওনার চলচ্চিত্র জীবনের সেরা পারফরমেন্স। কিন্তু সেটা করা থেকে বিরত থাকতে হল দ্বিতীয়বারের জন্য নাইটস্ অব ক্যাবিরিয়া দেখতে বসে। একঘন্টা দশ মিনিটের এই ছবিটি পুনরায় দেখতে বসে লক্ষ্য করলাম, প্রথমবার অনেক কিছুই আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে আর সেইসব এড়িয়ে যাওয়া বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে দেখতে গিয়ে কেবলই মনে হল, অভিনয় কিভাবে পারে এত নিখুঁত হতে? কীভাবে পারে একজন অভিনেত্রী ক্যামেরার সামনে অতটা সাবলীল হতে?

যেমন ছবির শুরুতেই জলে ডোবা থেকে তাকে বাঁচিয়ে নদীর ধারে এনে সবাই মিলে যখন তার পেট থেকে জল বের করে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে, তখন হঠাৎ তার জ্ঞান ফিরলে কাউকে কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক জর্জ নামের কাউকে উদ্ভ্রান্তের মত খুঁজতে থাকা ও সবাইকে ফেলে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যবর্তী যে অভিনয়, সেটা আমি প্রথমবার দেখার সময় লক্ষ্য করিনি। কারণ প্রথমবার ছবির শুরুটা আমাকে বেশ চমকে দিয়েছিল, যেখানে শহরের বাইরে নদীর ধারে একজোড়া সুখি প্রেমিক-প্রেমিকাকে দেখানো হয় এবং অল্পক্ষণের মধ্যে এও দেখানো হয়, কোন কারণ ছাড়াই প্রেমিকটি তার প্রেমিকাকে নদীর ধারে নিয়ে তাকে নদীতে ফেলে দিয়ে তার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিংবা, যখন অ্যালবার্ট লাজাটি নামের এক নামী অভিনেতা তাকে সাথে করে তার বাড়িতে নিয়ে আসে আর ক্যাবিরিয়া তাকে নিজের সম্পর্কে একনাগাড়ে অনেক কথা বলতে থাকে, তখন তার মুখোভঙ্গি ও অভিনয় শৈলী আমি নোট করিনি। নোট করিনি এও যে তিনি শুধু অভিনয় করে যাচ্ছিলেন না, বরং অভিনয়ের সাথে সাথে মুখের বিভিন্নরকম এক্সপ্রেশন জুড়ে দিয়ে তাকে করে তুলছিলেন অনবদ্য। এমন অনেক ছোটখাটো বিষয় প্রথবার দেখার সময় আমি সেভাবে লক্ষ্য করিনি, কিন্তু দ্বিতীয়বার দেখার সময় সেগুলো লক্ষ্য করে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে, আমার মনে হল ওনাকে দিয়ে চরিত্রের খুঁটিনাটি দর্শকের সামনে তুলে ধরার জন্য সেট, লোকেশান ইত্যাদি কোন কিছুরই দরকার নেই। শুধু সাদা স্ক্রিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেই হল, ওনার অভিনয় আর মুখের নানাবিধ এক্সপ্রেশনই যথেষ্ট চরিত্রের সবকিছু যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে।

নাইটস্ অব ক্যাবিরিয়া মূলতঃ ভ্রাম্যমান যৌনকর্মীদের নিয়ে বানানো ছবি, যেখানে ক্যাবিরিয়া নামের একটা মেয়ের জীবন-যাপন, প্রেম বিষয়ক তার রোমান্টিক ভাবনা ও প্রেমিককে বিশ্বাস করে বার বার ধোঁকা খাওয়া ইত্যাদি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। তার প্রেমিকরা তাকে বার বার ধোঁকা দিলেও সে ভেঙে পড়েনা, নতুন করে স্বপ্ন দেখে এবং পুনরায় প্রেমে পড়ে। শেষপর্যন্ত সে তার ঘনিষ্ঠ যৌনকর্মীর নিষেধ সত্ত্বেও সব কিছু বিক্রি করে এবং ডনফ্রিয়ো নামের এক অ্যাকাউন্ট্যান্টের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে। কিন্তু এবারও তার প্রেমিক তাকে ধোঁকা দেয় এবং পাহাড়ের ধারে নিয়ে গিয়ে, তার টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। পুরো ছবি জুড়ে মাসিনা ও তার অভিনয় এককভাবে আধিপত্য করে গেছে। ছবিতে অন্যান্য চরিত্রের কোন ছায়াই পড়েনি কোন অংশে। পরিশেষে এসে ফেলিনিকে হয়ত এড়িয়ে যাওয়া গেলনা ছবিটির একটি দৃশ্য মনে পড়ায়, যেখানে মঞ্চে একজন যাদুকর ও তার মোহাবিষ্ট করার ক্ষমতার মাধ্যমে ফেলিনি যেন নিজেকেই প্রকাশ করেছেন পরোক্ষভাবে। যেভাবে যাদুকর দর্শক সারি থেকে লোকজন তুলে এনে তাদের বশীভূত করে, নিজে যা যা বলছে, আচ্ছন্ন দর্শকরা তাই দেখতে পাচ্ছে, ফেলিনি নিজেও যেন আজীবন তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এই কাজটিই করে গেছেন। আর যাদুকরের মোহাবিষ্টতায় আচ্ছন্ন হয়ে আমরা ক্যাবিরিয়ার চরিত্রে যে মাসিনাকে দেখতে পাই, তাকেই হয়ত ফেলিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন এই ছবিতে আর দর্শক হিসেবে অমন অনবদ্য অভিনয় শৈলীর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে তাকে বহুদিন মনে রাখার জন্য আলাদা রকমের দূর্বলতা তৈরী করে ফেলি নিজের অজান্তেই।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×