ছবিটি শুরু হয় একটি শিশুর জন্ম, তা নিয়ে তার পিতার আনন্দ-উদ্বেগ এবং ৮মি.মি.-এর একটি ক্যামেরা কেনার মধ্যে দিয়ে। ছবিটির মূল চরিত্রে অভিনয় করা ফিলিপ মোজেজ (জার্জি স্টুয়ার) তার প্রথম সন্তানের জন্ম উপলক্ষে তার দু’মাসের বেতন দিয়ে ক্যামেরাটি কেনে। তার ইচ্ছা, সে তার সন্তানের প্রথম কয়েক বছরের বেড়ে ওঠা চিত্রায়িত করে রাখবে। কিন্তু যে মুহুর্ত থেকে সে ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে দেখে, সে মুহূর্ত থেকেই সে যেন ক্যামেরার সাথে গেঁথে যায়, এবং তারপর থেকেই সে তার বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, পরিচিত-অপরিচিতসহ যা কিছুই চলমান দেখে তাই চিত্রায়িত করতে থাকে। ঘটনাক্রমে ক্যামেরার খবর তার বস জানতে পারলে তাকে ডেকে পাঠায় এবং ফ্যাক্টরীর ২৫বছর উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্টানটি তাকে চিত্রায়িত করতে বলে। প্রথমে সে নিজেকে অপেশাদারীর অজুহাতে বিরত রাখতে চাইলেও শেষপর্যন্ত রাজী হয়, এবং উক্ত অনুষ্টানের প্রায় সব অংশই, এমনকি অনুষ্টান শেষে মঞ্চের পেছনে শিল্পীদের পারিশ্রমিক দেয়া থেকে শুরু করে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ধুমপান, টয়লেট যাওয়া, এমনকি জানালায় বসে থাকা পায়রা পর্যন্ত চিত্রায়িত করে। পরে ছবিটি দেখে তার বছর তাকে ছবি থেকে ঐসব অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো বাদ দিতে বললে সে বুঝতে পারে না কেন তাকে সেগুলো বাদ দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ছবিটি অপেশাদার চলচ্চিত্র উৎসবে তৃতীয় পুরস্কার পেলে মোজেজ ছবি বানানো নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে এবং তাতে সে এতটা জড়িয়ে পড়ে যে একসময় তার পরিবারে ভাঙন ধরে এবং তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। তবুও সে ছবি বানানো ছাড়ে না বরং বসের নির্দেশে ফ্যাক্টরীর জীবন-যাপন নিয়ে বানানো তার আরেকটি ডকুমেন্টারি, যাতে সে একজন খর্বকায় মানুষের ২৫ বছরের নিরলস কর্মজীবন এত চমৎকারভাবে তুলে ধরে যে সেটা টেলিভিশনে প্রচার হলে সে রীতিমত বিখ্যাত হয়ে যায়।
ছবিটির কাহিনী মূলত এই। কিন্তু এই কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে কিয়োলস্কি আমাদের যেসব নাটকীয়তার সামনে দাঁড় করিয়েছেন, বাস্তবতার যে এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় হাঁটিয়েছেন, তাতে আমরা নিজেরাও একাত্ন হয়েছি মোজেজের সাথে। মোজেজ যদিও একসময় তার স্ত্রীকে নিজের এই সৃষ্টিশীল উন্মাদনার পক্ষে বলে, ’আমি চাই শান্তি বা নিঃস্তব্ধতার চেয়েও বেশি কিছু, একটা ঘর বা পরিবারের চেয়ে অধিক কিছু’, কিন্তু পরে সে নিজেই দেখতে পায় যে তার ছবি বানানো নিয়ে নানারূপ বাধা আসতে শুরু করেছে, তার বস তাকে নিজ ইচ্ছায় কাজ করতে দিচ্ছে না, এমনকি বানানো ডকুমেন্টারি টেলিভিশনে প্রচারের ফলে তার সহকর্মীর চাকরি পর্যন্ত চলে যাচ্ছে, তখন সে অনুভব করে, তার এই নিরীহ শখ কীভাবে ক্রমশঃ অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। এমনকি তার সাদা-মাটা জীবন, সুখি পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। একধরনের হতাশা তাকে পেয়ে বসে।
অনেকেই ছবিটিকে কিয়োলস্কির নিজের আত্নজীবনীমূলক ডকুমেন্টারি বলে উল্লেখ করলেও তিনি নিজে ছবিটি সম্পর্কে বলেছেন যে, ছবিটি মোটেও তার নিজের জীবন থেকে নেয়া নয়। যদিও আমরা জানি তিনি নিজেও তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন ডকুমেন্টারির মাধ্যমেই এবং ১৯৭৯ সালে এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর নিজ দেশ পোলান্ডেই ছিলেন অপরিচিত। এই ছবিটি মুক্তি পাবার পরই তিনি চলে আসনে সামনে এবং পরবর্তী একদশকের মধ্যেই পুরো চলচ্চিত্র-বিশ্বকে জানিয়ে দেন তার সরব, ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীল উপস্থিতি। এই ছবিটিই আসলে কিয়োলস্কির চলচ্চিত্র জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, যা তাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করে তোলে। আর ছবিটিকে এত সুচারুভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরতে হয়ত তাকে খুব বেশি সাহায্য করেছিল জর্জ স্টুয়ারের সাবলীল ও দক্ষতাসম্পন্ন চমৎকার অভিনয়, যা দেখতে দেখতে একসময় আমার নিজেরই মনে হয়েছিল, ছবি নয় বরং মোজেজ নামের একজন বোকাসোকা, খুব সাধারণভাবে জীবনযাপন করা সুখি মানুষের বাস্তব জীবন প্রত্যক্ষ করছি, যে কিনা সস্তানের জন্মের খবর শুনে শিশুর মত কাঁদে আর আনন্দে উদ্বেল হয়ে বন্ধু-বান্ধবদের ক্ষণে ক্ষণে জড়িয়ে ধরে। অথচ সেই একই মানুষ পরবর্তীতে ছবি বানানোর নেশায় বুদ হয়ে ওঠে এবং শেষপর্যন্ত তার গোছানো সংসার ভেঙে গেলে একাকী ফ্লাটে, ক্যামেরা নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে নিজেকেই চিত্রায়িত করতে করতে রোমন্থন করতে থাকে সেই রাতের কথা, যে রাতে তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা ওঠে এবং তাকে সে কীভাবে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
যদিও ছবিটি কিয়োলস্কির পরের দিকের ছবিগুলোর তুলনায় ততটা মানসম্পন্ন নয়, তবুও আমি ছবিটা এ জন্য দেখতে বলব যে, এটা খুব সহজেই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, তা সে পেশাদার হোক কিংবা অপেশাদার। তাছাড়া কিয়োলস্কি মানেই আমার কাছে নতুন কিছু জানা বা শেখা এবং তা অবশ্যম্ভাবীরূপেই ব্যতিক্রমী দৃষ্টিকোণ থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ১:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





