রোমান পোলানস্কি, নামটা মনে হলেই আমার যে ছবিটির কথা সবার আগে মনে পড়ে, সেটা ’নাইফ ইন দ্য ওয়াটার’, আর এই ছবিটা দেখার পরেই আমি তাঁর অন্যান্য ছবি দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি প্রবলভাবে। কেন জানি ওনার কাজগুলো আমার কাছে খুব সহজাত মনে হয় এবং ছবির পরতে পরতে অনুভব করতে পারি ব্যতিক্রমী এক পরিচালকীয় মেজাজ, যা আমাকে দারুণভাবে টানে। ওনার ছবি নিয়ে অনেকের সাথেই আলোচনা করেছি, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কাউকেই দেখিনি এই ছবিটির নাম করতে। অথচ ছবিটা সম্পর্কে অনেকেই মত পোষন করে থাকেন যে, চলচ্চিত্র ইতিহাসে এটিই কোন পরিচালকের বেস্ট ডেব্যুট ফিল্ম। আর আমার নিজস্ব মন্তব্য হলো, যারা ’নাইফ ইন দ্য ওয়াটার’ দেখেনি তারা ওনার পরিচালকীয় মেজাজ-মর্জ্জি ও কাজ সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞাত রয়ে গেছে। ওনার অধিকাংশ ছবি দেখার পর আমার মনে হয়েছে এটিই তাঁর সেরা কাজগুলোর অন্যতম, যার সমান্তরালে কেবলমাত্র আর একটি ছবিকেই রাখা যায়, সেটি হল ’হোয়াট’।
১৯৬২ সালে সাদা-কালোয় নির্মিত ৯৪ মিনিটের এই ছবিটিকে অনেকই বলে থাকেন থ্রিলার, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এটি একটি উৎকৃষ্টমানের সাইকোলজিক্যাল ড্রামা, যেখানে হঠাৎ করেই আমাদের পরিচয় ঘটে যায় অসম বয়সের সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের তিনজন মানুষের সাথে, এবং দর্শক হিসেবে কোনকিছু গুছিয়ে ভাবা বা বোঝার আগেই, আমরা দ্রুত জড়িয়ে পড়ি তাদের একদিনের নৌকা ভ্রমণ, মানসিক দ্বন্দ্বপূর্ণ ঘাত-প্রতিঘাতে আর পরিচালক সেখানে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মত বসিয়ে রাখেন, বিস্তীর্ণ জলরাশি, সবুজ গাছাগাছালি ঘেরা জনমানবহীন লেক, খোলা আকাশ ও তার মধ্যে দিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে চলা সাদা পালতোলা নৌকা, এইসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলীর মনোরম আবেশে।
ছবিটি শুরু হয় আন্দ্রেজ (লিওন নিমক্রেজাক) ও ক্রিস্টিনা (জোলানটা উমেকা) দম্পতির সাপ্তাহিক অবসরে একদিনের জন্য নৌকা ভ্রমণে বেরুনো থেকে, এবং শুরুতেই চলমান গাড়ির মধ্যে এই দম্পতির বিপরীতধর্মী অভিব্যক্তি দেখে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারি না, তারা কেন বা কোথায় যাচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের গাড়ি ডেকে গিয়ে পৌঁছায়। আমরা দ্রুত প্রশ্নবিদ্ধ হই, বিভ্রান্ত বোধ করি আর সেই বিভ্রান্তি খুব শীঘ্রই নাটকীয়তার মোড় নেয়, যখন আন্দ্রেজ রাস্তার মাঝখানে এক হিচ-হিকার (মোটর বা লরি চালককে বলে বিনা পয়সার যে ভ্রমণ করে) যুবককে (জিগমান্ট মালানোভিচ) প্রায় গাড়ি চাপা দিতে বসে। এরপর তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়া, ডেকে পৌঁছানো এবং তাদের একদিনের ভ্রমণে সঙ্গে নেবার পর থেকেই যেন ছবিটি গতি পায় এবং ক্রমেই আমরা পরিচিত হতে শুরু করি তিনজন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মানসিক আচরণ, দ্বন্দ্ব ও সংকটের সাথে, যাকে চরম উপভোগ্য করে তোলে চিত্রনাট্যের বৈচিত্রতা, চরিত্রদের স্বল্প কথাবার্তা, বাঙ্ময় অভিব্যক্তি ও লোকেশানের খোলামেলা উপস্থিতি।
ছবিটি দেখতে দেখতে আমরা নানাবিধ প্রশ্নের সন্মুখীন হই অথচ কোন একটার উত্তর বা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার আগেই নতুন আরেকটি দ্বন্দ্বময় সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ি, যেখানে দু’জন অসমবয়সী পুরুষকে আমরা দেখতে পাই একটি নারীকে কেন্দ্র করে তাদের অস্তিত্বহীনতার সংকটে ভুগতে থাকা ও একে অপরের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায়। পোলানস্কির প্রথম দিকের ছবিগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে, তিনি যেন তাঁর কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন আর চেয়েছেন দর্শকের ভেতর কিছু রেখে দিতে, যা তারা নিজেদের মত গ্রহণ করবে, যেখানে তার নিজের দায়ভার এটুকুই, দেখিয়ে বা পরিচয় করিয়ে দেয়া। যদিও আমি সেই মেজাজী পোলানস্কিকে সেভাবে আর কখনোই খুঁজে পাইনি তার পরের কাজগুলোতে, যা পেয়েছিলাম এই ছবি কিংবা হোয়াট-এ। তবে এটা সত্যি, খুব সহজাত প্রতিভা না থাকলে একজন পরিচালক কখনোই পারে না তার জীবনের প্রথম ছবি এত চমৎকারভাবে বানাতে।
তাছাড়া ছবিটির লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো এখানে চরিত্রেরা অভিনয় বা কথা বলছে কম, কেবলমাত্র অভিব্যক্তি দিয়েই ফুটিয়ে চলেছে সবকিছু। ক্রিস্টিনা, আন্দ্রেজ অথবা হিচ-হিকার যুবক কাউকেই দেখা যায় না অতিরিক্ত কথায় ব্যস্ত হতে। যদিও বা আন্দ্রেজ অন্য দু’জনের চেয়ে কথা বলছিল বেশি, কিন্তু সে কথাগুলো বলছিল যবুকের সাথে, যাকে সে কিছুক্ষণ পরপরই নৌকা চালানো বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল এবং নিজেকে দক্ষনাবিক প্রমাণ করে তার উপর নিজের শ্রেষ্টত্ব প্রমাণ করতে চাইছিল, আর যবুকটি তার কথায় বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে নিজের গোঁয়ার্তুমি প্রকাশ করে চলেছিল উদ্ভট সব কার্যকলাপে। সেখানে ক্রিস্টিনা ছবির শুরু থেকে শেষ, সবসময়ই ছিল নিরাসক্ত ও চুপচাপ। আসলে আন্দ্রেজ ও যুবক দু’জনেই চাইছিল তাদের সঙ্গী রমণীটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে। ক্রমেই তাদের এই মানসিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের রুপ নেয় এবং একপর্যায়ে আন্দ্রেজ যুবকের কাছে থাকা তার প্রিয় শিকারি ছোরাটা জলে ফেলে দিলে তা মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। যুবকটি আন্দ্রেজের ধাক্কায় জলে পড়ে যায় এবং সে সাঁতার জানে না বলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই জলে নেমে তাকে খোঁজে, অথচ পায় না। ক্রিস্টিনা নৌকায় ফিরে স্বামীকে খুনী বলে চিৎকার করে তার উপর নিজের রাগ ও ঘৃণা প্রকাশ করে আর আন্দ্রেজ ভীত হয়ে নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে পালিয়ে যায়। আন্দ্রেজ পালিয়ে গেলে যুবকটি নৌকায় ফিরে আসে এবং ক্রিস্টিনার সাথে তার ক্ষণস্থায়ী প্রণয় হয়।
পরে নৌকা নিয়ে ক্রিস্টিনা একা একা ডেকে ফিরে আসে এবং গাড়িতে, বাড়ি ফেরার সময় তার স্বামীকে জানায় যে যুবকটি মরেনি, বরং সে পালিয়ে আসার পর ও ফিরে এসেছিল, যা আন্দ্রেজ বিশ্বাস করতে চায় না। এমনকি ক্রিস্টিনা যুবকের সাথে তার শারীরীক সম্পর্কের কথা বললেও আন্দ্রেজ পূর্বের মতই অবিশ্বাসী মনোভাব নিয়েই গাড়িটি একটা দ্বি-মুখী রাস্তার মোড়ে থামায়, যেখান থেকে গাড়িটি আর নড়ে না। এভাবেই ছবিটি শেষ হয়। মাত্র তিনটে চরিত্র নিয়ে বানানো এই ছবিটি আমি কখনোই ভুলতে পারি না, কারণ পোলানস্কির ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীল মেজাজ, যেখানে তিনি হুট করে কয়েকটা খাপছাড়া ও সামঞ্জস্যহীন চরিত্রকে একত্র করে, একই সাথে যেমন আমাদের ফেলে দেন বিভ্রান্তি ও সংকটে, তেমনি পরিচয় ঘটিয়ে দেন চমৎকার সৃষ্টিশীলতার সাথে।
আলোচিত ব্লগ
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।