১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই আর্জেন্টেনিয়ান ছবিটি নিয়ে লিখতে বসার মূল কারণ হলো, এর চিত্রনাট্য ও তার ব্যতিক্রমী বিস্তার। কীভাবে একটি কাহিনীকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে পুনরায় তাকে জুড়ে দিয়ে করে তোলা হচ্ছে বিশাল থেকে বিশালতর, এবং সবসমেত আমরা কত অনায়াস এটে যাচ্ছি সেই পরিধির মধ্যে। ১৯৮৩ সালে আর্জেন্টিনার সামরিক অভ্যুত্থান ও তার ফলে জনজীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ ও অশুভতার ছায়াতেই আলোকসম্পাত করতে চেয়েছেন ফার্নান্দো সোলানাস, যেখানে তিনি একাধারে তুলে এনেছেন জীবনের টানাপোড়েন, রাজনীতি, নিপীড়ন, প্রেম, প্রতারণা, অস্তিত্ব সংকট, এবং নতুন আশা। সবগুলো এত চমৎকারভাবে একে অপরের সাথে মিশেছে যে, এই ছবিটিকে ডিসেকশন করতে গেলে কোনো একক সত্ত্বা পাওয়া মুশকিল। কোনো বিশেষ চরিত্র বা অধ্যায়ের দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ তৈরী করে না এর চিত্রনাট্য। আর সোলানাস এতে নিজের মেধা ও মনন যোগ করে, তাকে তুলে নিয়ে গেছেন সেই পর্যায়ে, যেখানে যাবার জন্য অনেক পরিচালককেই আমরা বেরিয়ে আসতে দেখেছি প্রথাগত চলচ্চিত্র নির্মাণের অবস্থান থেকে, এবং নিজস্ব সৃষ্টিশীলতায় নির্মাণ করেছেন এমনসব চলচ্চিত্র, যা আমরা স্মরণ করি আজও, এবং করব, বহুবছর।
সোলানাসের সাথে আমার পরিচয় ঘটে, ১৯৬৮ সালে তাঁর নির্মিত ডকুমেন্টরি, “দি আওয়ার অব দ্য ফারনাসেস” এর মাধ্যমে, এবং সেটা দেখে মুগ্ধ হয়েই শুরু করেছিলাম তার ছবি সংগ্রহ করতে। এটি তার তৃতীয় ছবি, এবং তিনি খুব ভালভাবেই পেরেছেন আমাদের সামনে নিজের সৃষ্টিশীল মননের পরিচয় তুলে ধরতে। যদি আমি ছবিটিকে চারটি মূল অংশে ভাগ করি, যেমন, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সঙ্গীত ও অভিনয়, তবে নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি অংশই দাবী রাখে তাদের স্ব স্ব সৃষ্টিশীল অনন্যতার জন্য উচ্চাশ্বাস। বিশেষ করে এর চিত্রনাট্যটাই ছবিটিকে দিয়েছে এমন এক মাত্রা যে, যারা এটা দেখবে, তারা ষোলআনাই টের পাবে, কীভাবে একটি চিত্রনাট্য বার বার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, এবং আপনা আপনিই জুড়ে গিয়ে সম্পূর্ণ একটি কাহিনীর অনবদ্য অবয়ব গড়ে তুলছে এতটুকু অসুবিধা ছাড়াই। বস্তুত এর কাহিনী, একের ভেতরে অসংখ্য মানুষের গল্প, যা পর্যায়ক্রমে রূপ নিয়েছে একটি সমাজ, তথা জাতি, তথা দেশ, এমনকী মানবজীবনের প্রকৃত বাস্তব গল্প হিসেবে।
ছবিটির শুরু হয় একসন্ধ্যায়, রবার্টো নামের একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের জেল থেকে প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে, যেখানে সে সাজা শেষ করে ফিরে আসে নিজ মহল্লায়, এবং নিজের পরিচিত অবস্থানে ফিরে এসে এক এক করে স্মরণ করতে থাকে সেইসব উজ্জ্বল দিন, সঙ্গী-সাথী অথবা প্রিয়মানুষদের, যা আজ আর নেই। সে আবেগতাড়িত হয়, এবং নিজের ঘরে ফিরে না গিয়ে, ঘুরতে থাকে মহল্লার রাস্তায় রাস্তায় আর খোঁজ করতে থাকে তাদের, যারা একসময় ছিল খুব কাছের, এবং প্রিয়। পুরোনো সব স্মৃতি তাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে থাকে বার বার আর সে হাঁটতে থাকে উদ্ভ্রান্তের মতো। অতীতের প্রিয়-অপ্রিয় সমস্ত ঘটনাই মনে পড়তে থাকে এক এক করে আর সেইসব ঘটনায় সাথে জড়িত ব্যক্তিরা ফিরে আসতে থাকে তার সামনে, বাস্তবরূপে। নায়কের এই নির্মম স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়েই চিত্রনাট্যের বিস্তার ঘটতে থাকে ক্রমশঃ, যা কিনা পর্যায়ক্রমে তুলে আনে সামরিক অত্যাচার, বিপ্লব, নিপীড়ন, হত্যা, প্রেম, প্রতারণা, হতাশা, ঘৃণা ইত্যাদি, এবং শেষ হয় নতুন আশার মধ্যে দিয়ে। এক সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে ভোর পর্যন্ত একটিমাত্র রাতের পটভূমিতে আমাদের সামনে আঁকা হয় সেই বিশাল ক্যানভাস, যাতে ফুটে ওঠে জীবন ও বাস্তবতার বহুবিধ রঙ, যেখানে জীবিত বা মৃত উভয়ই এসে জড়ো হয়েছে আর কথা বলে গেছে একে অপরের সাথে, এমনকী, হয়ত, অলক্ষ্যে আমাদের সাথেও।
সবগুলো দিক থেকেই সোলানাস ছবিটিকে অনবদ্য করে তোলার প্রয়াস চালিয়েছেন। সঙ্গীত, আলোকসম্পাত, বিশেষ করে যারা ট্যাংগো ভালবাসেন তারা অবশ্যই মুগ্ধ হবেন প্রায় পুরো ছবিজুড়েই এ্যাস্টর পিজোলা ও বরার্টো গোয়েনচের মত খ্যাতিমান ট্যাংগো শিল্পীদের অনবদ্য সঙ্গীত শুনে। এছাড়া ছবিটির স্মৃতিচারণ বা আত্নকথন বর্ণনাকে, যেখানে মৃত ব্যক্তিরাও ফিরে আসছে, এবং বাস্তব চরিত্রের মত নায়কের সাথে কথপোকথনে বলে যাচ্ছে নিজেদের করুণ ও মর্মান্তিক পরিণতির কথা, তাকে মায়াবী কুহুকতা দিতে সোলানাস, ধোয়া, নীলরং, পরিমিত আলো, অসংখ্য টুকরো টুকরো কাগজ আর বাতাস যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে ছবিটি সত্যি-সত্যিই হয়ে উঠেছে স্মৃতির সেই মর্মান্তিক কবরস্থান, যেখানে আমাদের দর্শক সারিতে বসিয়ে রেখে, সোলানাস কমিউনিকেট করাচ্ছেন সেইসব আত্নার সাথে, যারা কোনো না কোনোভাবে হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনেরও অংশ।
সবমিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য ছবি এটি, যেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে নিপুণ দক্ষতায় বোনা হয়েছে জীবন বাস্তবতা ও প্রেমকে। মানুষের সামজিক জীবন ও নির্মম বাস্তবতাকে প্রায় সবকোণ থেকেই সোলানাস দেখিয়েছেন এই ছবিতে, সৃজনশীলতার চরম উৎকর্ষতা সহকারেই।
অরণ্য
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
Sur (The South) 1988 - Fernando E. Solanas
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?
অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।

১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।